ইংল্যান্ডের স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভন (Stratford-upon-Avon) শহরে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাঁর পৈতৃক বাড়িতে জন্মেছিলেন। এখন সে বাড়ির অফিসিয়াল নাম এখন ‘দি শেক্সপিয়ার সেন্টার’। পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্যপ্রেমীর ঈশ্বর কিংবা সাহিত্যের ঈশ্বর শেক্সপিয়ার। সাহিত্যের পন্ডিতেরা তাঁকে নাম দিয়েছেন ‘ব্যালার্ড অব অ্যাভন’ অর্থাৎ অ্যাভনের চারণ কবি। হাটে, মাঠে, ঘাটে ঘুরে ঘুরে যেসব কবিরা কাব্য চর্চা করেন তাঁদের বলা হয় চারণ কবি। তিনি সেই নাট্যকার যার নাটক পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার মঞ্চস্থ হয়েছে বলে দাবি করেন তাঁর ভক্তরা। শেক্সপিয়ারের এই পৈত্রিক বাড়ির উঠানে স্থাপতি হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের আরেক কিংবদন্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য। বিশ্বসাহিত্যের দুই দিকপাল — শেক্সপিয়ার ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই উদ্যোগ একটি দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক সংযোগ — প্রাচ্য পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক বন্ধন।
১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর ৩০০ বছর উপলক্ষে একটি কবিতা লেখেন, শেক্সপিয়ারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনের এক অনুষ্ঠানে সে কথা স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন, শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর তিনশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির অনুরোধে উপলক্ষে তিনি এটি রচনা করেছিলেন। সেদিন তিনি আরও উল্লেখ করেন, এটি তিনি শেলাইদহে লিখেছিলেন। এ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ উইলিয়াম শেক্সপিয়রকেই বিশ্বকবি আখ্যা দিয়েছেন।
১৯৬৪ সালে, শেক্সপিয়ারের জন্মের চারশত বছর উদযাপনের সময় কলকাতা আর্ট সোসাইটি রবি ঠাকুরের লেখা সেই কবিতাটি উপহার দেয় যুক্তরাজ্যের শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট (Shakespeare Birthplace Trust) সংগ্রহশালায়। উপহার দেবার সময় কবিতাটি একটি হাতির দাঁতের ফলকে বাংলায় খোদাই করে লেখা হয়েছিল এবং সেই ফলক উপহার দেয়া হয়েছিলো। রবি ঠাকুর অবশ্য কবিতাটি যখন লিখেছিলেন তখন কাগজেই লিখেছিলেন। সেই থেকে রবিঠাকুরের লেখা এই কবিতাটি শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট এর সংগ্রহশালার অংশ হয়ে ওঠে। কয়েক দশক পরে, ১৯৯০-এর দশকে, যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় হাই কমিশনার ড. এলএম সিংভি শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট পরিদর্শনের সময় এই কবিতা ফলকটির মুখোমুখি হন।
রবিঠাকুর এবং শেক্সপিয়ারের সাংস্কৃতিক অনুরণনে অনুপ্রাণিত হয়ে স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-এভনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ভাস্কর্য স্থাপনের পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন তিনি। এই ধারাবাহিকতায় ভাস্কর দেবব্রত চক্রবর্তীর উপর অর্পিত হয় ভাস্কর্য তৈরির দায়িত্ব। ভারত সরকার যুক্তরাজ্যের শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্টের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। যুক্তরাজ্যের শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট এই প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয় এবং স্থান নির্বাচন, নকশা অনুমোদন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা শুরু করার সুযোগ তৈরি হয়। ১৯৯৫ সালে কলকাতার ভাস্কর দেবব্রত চক্রবর্তী নির্মিত ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তিটি শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্টকে উপহার দেওয়া হয় এবং তখনই স্থাপন করা হয় শেক্সপিয়ারের পৈত্রিক বাড়ির উঠানে ।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে (শিলাইদহ, ১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩২২) শিলাইদহে বসে শেক্সপিয়ারকে লেখা সেই কবিতা-
যেদিন উদিলে তুমি, বিশ্বকবি, দূর সিন্ধুপারে,
ইংলণ্ডে দিকপ্রান্ত পেয়েছিল সেদিন তোমারে
আপন বক্ষের কাছে, ভেবেছিল বুঝি তারি তুমি
কেবল আপন ধন; উজ্জ্বল ললাট তব চুমি
রেখেছিল কিছুকাল অরণ্যশাখার বাহুজালে,
ঢেকেছিল কিছুকাল কুয়াশা-অঞ্চল-অন্তরালে
বনপুষ্প-বিকশিত তৃণঘন শিশির-উজ্জ্বল
পরীদের খেলার প্রাঙ্গণে। দ্বীপের নিকুঞ্জতল
তখনো ওঠে নি জেগে কবিসূর্য-বন্দনাসংগীতে।
তার পরে ধীরে ধীরে অনন্তের নিঃশব্দ ইঙ্গিতে
দিগন্তের কোল ছাড়ি শতাব্দীর প্রহরে প্রহরে
উঠিয়াছ দীপ্তজ্যোতি মাধ্যাহ্নের গগনের 'পরে;
নিয়েছ আসন তব সকল দিকের কেন্দ্রদেশে
বিশ্বচিত্ত উদ্ভাসিয়া; তাই হেরো যুগান্তর-শেষে
ভারতসমুদ্রতীরে কম্পমান শাখাপুঞ্জে আজি
নারিকেলকুঞ্জবনে জয়ধ্বনি উঠিতেছে বাজি।
১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদও করেছিলেন। এটি রবিঠাকুরের নিজস্ব অনুবাদ।
'When by the far-away sea your fiery disc appeared from
behind the unseen, O Poet, O Sun, England's horizon felt
you near her breast and took you to be her own.
She kissed your forehead, caught you in the arms of her
forest branches, hid you behind her mist-mantle and
watched you in the green sward where fairies love to play among meadow flowers.
A few early birds sang your hymn of praise while the rest
of the woodland choir were asleep.
Then at the silent beckoning of the Eternal you rose higher
and higher till you reached the mid-sky, making all quarters
of heaven your own.
Therefore at this moment, after the end of centuries,
the palm groves by the Indian sea raise their tremulous branches to the sky murmuring your praise.'
শেক্সপিয়ারের প্রতি রবিঠাকুরের গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ পায় এ ভাস্কর্য স্থাপনের মধ্যে। এটি ভারত ও যুক্তরাজ্যের সাংস্কৃতিক সম্পর্কের প্রতীক। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের মেলবন্ধন।
বিশ্বসাহিত্যের দুই মনীষীর মধ্যে অনন্য সংযোগ। শেক্সপিয়ার — যাঁর নাটক ও কবিতা ইংরেজি সাহিত্যের শিখর। রবীন্দ্রনাথ — যিনি বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যে তাঁর গভীরতা ও দার্শনিকতায় এক অনন্য স্থান অধিকার করেছেন।
উঠানে বেশ গাছগাছালি। উঠানের বাগানের বৃহৎ সবুজের এক কোণে স্থাপিত রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য। পাশেই একটি মাঝারি আকারের বিলবোর্ড। বিলবোর্ডে বর্ণনা করা হয়েছে শেক্সপিয়ারের সাথে রবীন্দ্রনাথের যোগ এবং কিভাবে, কেন স্থাপিত হল এ ভাস্কর্য তার বিশদ বিবরণ।
ভারত সরকার ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেসময় এখানে আবার রবীন্দ্রনাথ স্মরণে অনুষ্ঠান আয়জিত হয়। উপস্থিত ছিলেন শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্টের সদস্যরা, যুক্তরাজ্যের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি, ভারতীয় হাইকমিশনের প্রতিনিধি এবং সাহিত্যপ্রেমীরা। রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের একটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ ছিল এটি।
সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে ট্রেনে দু ঘন্টা সময় লাগে শেক্সপিয়ারের শহর ‘স্ট্রাটফোর্ড-আপন-অ্যাভন’ পৌঁছাতে। নদী অ্যাভনের পাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে ‘স্ট্রাটফোর্ড-আপন-অ্যাভন’। অ্যাভন নদীর তীরে জন্মেছেন শেক্সপিয়ার — যে নদী সাক্ষী তাঁর শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের।
লেখক: ভূ-পর্যটক ও লেখক
তথ্যসূত্র: শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট
ছবি: লেখক