বাংলাদেশের ঐশ্বর্য সন্ধান ৭: ধানকোড়া জমিদারবাড়ির অজানা ইতিহাস
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ঢাকার অদূরে ধানকোড়া গ্রাম! খুব বিখ্যাত কোনো গ্রাম নয় যে নাম বললেই যে কেউ চিনবে। তবে নামটি বেশ লেগেছে। আমার মাঝে আগ্রহ তৈরি করেছে। টপোনমি মানে, স্থান-নামের উৎস জানতে আমি আগ্রহী থাকি। তাই ধানকোড়া নামের উৎস জেনেছি স্থানীয় লোকজনের কাছে। ধান তো বোঝাই যাচ্ছে। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার এই স্থানে আমন ধানের আবাদ হতো। আমন ধানখেতে কোড়া পাখি দেখা যেত।

সিংহদুয়ারের দুপাশে ওয়াচ টাওয়ার
সিংহদুয়ারের দুপাশে ওয়াচ টাওয়ার

পাখি সম্পর্কে আমার জ্ঞান একেবারে সীমিত। ময়না, টিয়া, শালিক, দোয়েল, চড়ুই ছাড়া দেশীয় পাখি চিনি না বললেই চলে। কোড়ার ইংরেজি নাম ‘ওয়াটার কক’। পোষা কোড়া দিয়ে জংলি কোড়া শিকার দেশের শিকার–ঐতিহ্যের একটি অংশ ছিল। তবে কথা হলো, এখন আর আমনের চাষ হয় না, এসেছে হাইব্রিড ইরি ধান। বর্ষা আসে বর্ষা যায়, কিন্তু কোড়ার ডাক আর শুনতে পাওয়া যায় না।

বিজ্ঞাপন

কোড়া পাখি যেহেতু আমাদের দেশের শিকার–ঐতিহ্যের অংশ, তাই অল্প দুকথা বললাম কোড়া পাখি সম্পর্কে। আমি অবশ্যই ধানকোড়া গ্রামে পাখি খুঁজতে যাইনি। গিয়েছিলাম ধানকোড়া জমিদারবাড়ির খোঁজে। খুঁজে পেতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। অবশ্য ভ্রমণে আমি একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করি। কোনো কোনো সময় পদ্ধতিটি দারুণ কাজ করে। আবার কোনো সময় বিফল হই।

দেয়ালের কারুকাজ
দেয়ালের কারুকাজ

গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জের বাসে চড়লাম। কোথায় নামলে খুঁজে পেতে সহজ হবে জানি না। তাই বাসে বসা আশপাশের যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ জুড়লাম। সবাই মানিকগঞ্জের যাত্রী। এই পদ্ধতিতে দ্রুত সমাধান পাওয়া যায়। সাটুরিয়া উপজেলার ধানকোড়া গ্রামে যেতে হলে ঢাকার গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জের বাসে চড়ে নয়াডিংগী বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশা বা অটোরিকশাতে ধানকোড়া গ্রামে গেলেই পাবেন জমিদারবাড়ি।

বিজ্ঞাপন

নয়াডিংগী বাসস্ট্যান্ডে নেমে অটোরিকশাকে জিজ্ঞাসা করতেই ১০ মিনিট পর নামিয়ে দিল ধানকোড়া জমিদারবাড়ির সদর দুয়ারে। সদর দুয়ারই হবে। সিংহের প্রতিমূর্তি এখনো আছে। যদিও পলেস্তারা খসে পড়েছে। জমিদারবাড়ির সিংহদরজার দুই পাশের ওয়াচ টাওয়ার। সেটিও একেবারে জরাজীর্ণ। সম্ভবত ওয়াচ টাওয়ার। স্থাপত্যের অবয়ব দেখে আন্দাজ করে বললাম।

মূল ভবনের একাংশ
মূল ভবনের একাংশ

মূল ফটকের দুই পাশে দ্বিতল গোলাকার মিনারের মতো। সদর দুয়ার পেরিয়ে কাছারিবাড়ি বা বৈঠকখানা। তারপর মূল ভবন। ভবনে মেলা কামরা। প্রতিটি কামরার মেঝে রংবেরঙের। আলাদা আলাদা ডিজাইনে তৈরি। ধুলা সরিয়ে দেখতে হচ্ছিল। জানি না মোজাইক নাকি দামি কোনো পাথরের টালি। ঘাটবাঁধানো পুকুরও রয়েছে। দেখে মনে হয় এই জমিদারি বেশ জৌলুসপূর্ণ ছিল। আঠারো বা উনিশ শতকের জমিদারবাড়িগুলোর সঠিক ইতিহাস বলা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে। কারণ, এই সময়ের জমিদারি সম্পর্কে লিখিত তথ্য খুব কম পাওয়া যায়। প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক বইগুলোতে আসলে জমিদারবাড়ির তেমন বর্ণনা থাকে না। কথা, উপকথা বা জনশ্রুতিই তখন সম্বল হয়।

ধানকোড়া জমিদারবাড়ি সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি তা হলো, এই জমিদারির গোড়াপত্তন করেন নরসিংহ রায়চৌধুরী। তিনি এসেছিলেন দিল্লি থেকে। স্থানীয় লোকজন অবশ্য এই পরিত্যক্ত বাড়িকে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর বাড়ি বলেই জানেন। জমিদারবাড়ির পাশেই জমিদারেরা একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১৭ সালে। বিদ্যালয়টি জমিদার হেমচন্দ্র তাঁর বাবা গিরিশ গোবিন্দ রায়চৌধুরীর নামে প্রতিষ্ঠা করেন।

মূল ভবনের সামনে লেখক
মূল ভবনের সামনে লেখক
জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল
জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল

বংশপরম্পরায় জমিদারিটি ছিল এরূপ—নরসিংহ রায়চৌধুরীর ছেলে ছিলেন গিরিশ গোবিন্দ রায়চৌধুরী, তাঁর ছেলে ছিলেন হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী। তাঁর ছিল তিন ছেলে অমূল্যচন্দ্র রায়চৌধুরী, বীরেনচন্দ্র রায়চৌধুরী ও নির্মলচন্দ্র রায়চৌধুরী। লোকমুখে শোনা, এই জমিদার বংশের আওতায় মোট ২৪টি কাছারি ছিল। বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার জগন্নাথপুর ও খালিয়াজুরি নামক এলাকাও ছিল তাঁদের জমিদারির অধীন। ১৯৫০ সালের দিকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে নরসিংহের উত্তরসূরিরা ভারতে চলে যায়।

একটি ছোট্ট তথ্য, পুরো মানিকগঞ্জ জেলায় জমিদারবাড়ি আছে ১১টি। মানে আমি বিভিন্ন সময়ে ভ্রমণ করে খুঁজে পেয়েছি। তার মাঝে জনপ্রিয় জমিদারবাড়িগুলো হলো বালিয়াটি, তেওতা ও বেতিলা। এই সব স্থাপত্য ঢাকা থেকে এক দিনেই ঘুরে আসা যায়।
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন