দামতুয়া ঝরনা বা ডামতুয়া ঝরনা বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলায় অবস্থিত। এখানে দুই দিক থেকে পানি পড়ার কারণে ঝরনাসহ খোলা জায়গাটায় চাঁদের আলোয় অন্য রকম সৌন্দর্য বিরাজ করে। তাই স্থানীয় মুরং ভাষায় এটাকে ‘লামোনই’ ঝরনা বলা হয়। লামো অর্থ চাঁদ ও নই অর্থ আলো। লামোনই অর্থ চাঁদের আলো। আলীকদম থেকে চাঁদের গাড়িতে করে ১৭ কিলোমিটার দূরে আদুপাড়ার পাশ দিয়ে ঝরনার পথ।
এখানে যাওয়ার পথে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় কয়েকটি ভিউ পয়েন্ট পাবেন, যেখানে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন অদৃশ্য মায়ায়। সাধারণত সারা বছর এখানে মানুষের আনাগোনা থাকে। প্রতিবছর বিভিন্ন ছুটির দিনে পাহাড়প্রেমী অসংখ্য পর্যটকের আগমন ঘটে এখানে। এখানকার প্রতিটি পরতে আছে প্রকৃতির অনাবিল প্রশান্তি। চারদিকে পাহাড় আর সবুজ মুগ্ধতায় ভরিয়ে রেখেছে। ঝরনাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে খানিকটা মুক্ত করতে পারবে।
নিজেদের একটু উজ্জীবিত করতে আমরা ১২ বন্ধু (আবদুল্লাহ্, মারুফ, তামিম, ফাহাদ, শফিক, আকাশ, মিশু, রাফি, হারুন, রাশেদ, তওহিদ, সাখাওয়াত) বেরিয়ে পড়লাম সেই গন্তব্যে। ভোরে উঠে আলীকদম বাজার থেকে সকালে খাওয়াদাওয়া করলাম। এরপর নিজেদের প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে চাঁদের গাড়িতে করে রওনা দিলাম মূল গন্তব্যের দিকে। আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চলছে, আমাদের মনে হচ্ছে যেন মেঘের মধ্য দিয়ে আমাদের গাড়ি ভেদ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে আপনি যখন ডিম পাহাড় পাড়ি দেবেন তখন এই অনুভবটা আরও বেশি হবে। মূল ঝরনায় যাওয়ার আগে কয়েকটি ভিউ পয়েন্টে গাড়ি থামিয়ে নিজেরা কিছু সময় উপভোগ করলাম।
আমরা ভোরেই রওনা দিয়েছিলাম, তাই তেমন কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি। অবশ্যই ওদিকে যাওয়ার সময় সেনাবাহিনীর খাতায় এন্ট্রি করে যেতে হবে। তাই আপনার ভ্রমণে জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্মনিবন্ধনের ফটোকপি সঙ্গে রাখতে ভুলবেন না।
গাড়িতে গান আর আড্ডা দিতে দিতে কখন যে আমরা ১৭ কিলোমিটারে পৌঁছেছি, টেরই পাইনি। গাড়ি থেকে নেমে মূল ঝরনায় পৌঁছাতে হলে হেঁটে অন্তত ৭ থেকে ১০ কিলোমিটার যেতে হবে। সবাই নেমে সেই গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। কারও হাতে ছোট ছোট বাঁশ, আবার কারও হাতে ছোট লাঠি। এটা নেওয়ার একমাত্র কারণ, যাতে হাঁটার সময় একটু শক্তি সঞ্চার হয়। পাহাড়ের পর পাহাড়, একটি পাড়ি দিয়ে আবার পাহাড়!
আমাদের এই পাহাড়যাত্রার আনন্দ আরও বাড়িয়ে দেয় সঙ্গে থাকা ছোট সাউন্ডবক্স। ক্লান্তি অনুভব করলে সবাই মিলে গান গেয়ে নাচানাচি করে চাঙা হয়েছি।
পাহাড়ি ঝিরিপথ দিয়ে হাঁটার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ পা পিছলে পড়েও গিয়েছিল, বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয় সাখাওয়াত।
আর কোনো ধরনের ক্লান্তির ছাপ ছাড়া অনবরত হেঁটে রেকর্ড করেছে রাশেদ। আবার সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে শফিক ও রাফি। এ যাত্রায় পাহাড়ি মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেক ধারণা হয়েছে। উঁচু পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট দোচালা স্কুলে পড়াশোনা করছে পাহাড়ি ছেলেমেয়ে। অসাধারণ এই পাহাড়যাত্রার সবকিছু ছিল আমাদের জন্য নতুন এবং আনন্দদায়ক। কৌতূহলোদ্দীপকও। সেখানকার পাহাড়িদের জুমচাষ, তাঁদের জীবনযাপন—সবকিছু মিলিয়ে পাহাড়ের যাত্রাটি ছিল অসাধারণ।
দামতুয়া যাওয়ার পথে ছোট-বড় মিলিয়ে তিনটি ঝরনা দেখতে পাবেন। একটি ঝরনা থেকে আরেকটির দূরত্ব ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। তবে মূল ঝরনায় যাওয়ার জন্য একটি পাহাড় পাড়ি দিয়ে একটু ঝিরিপথ, আবার সেই পাহাড়। এই পথে দেখা যাবে পাহাড়িদের জুমচাষ। এই দৃশ্য দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। অবশ্যই যাওয়ার সময় সঙ্গে শুকনা খাবার নিয়ে যেতে হবে। এখানে খাবার পাওয়া যায় না। প্রায় তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে প্রধান ঝরনার দৃশ্য দেখে সবার ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে যায়। ঝরনার পানিতে সবাই গোসল করি। আহা, কী আনন্দ! প্রকাশ করার মতো নয়। আমরা এতটা মজার সময় কাটিয়েছি যে ভুলেই গিয়েছিলাম আমাদের আবার ফিরতে হবে।
কিছুক্ষণ পর আবার নিজেদের সেই আসল গন্তব্যে রওনা দিলাম। ফেরার সময় প্রায় সবার শক্তি কিছুটা কমে আসে, আমাদের সঙ্গে যে শুকনা খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম তা–ও শেষ হয়ে যায়। তবে পথে কিছু জায়গায় পাহাড়িদের চাষ করা ফল (কলা, শসা ইত্যাদি) পেয়েছিলাম, সেগুলো খেয়ে ফিরতে থাকি। যেহেতু আমরা একদম সকাল সকাল রওনা দিয়েছিলাম, সে কারণে একটু সুবিধা হয়েছিল। আপনারাও যাওয়ার সময় পর্যাপ্ত শুকনা খাবার নিয়ে যাবেন। ভোরে রওনা দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
সাধারণত এই ঝরনায় সারা বছর যাওয়া যায়। প্রাকৃতিক ঝরনার যৌবন হলো বর্ষাকাল। এ সময়ে প্রচণ্ড গতিতে জলধারা গড়িয়ে পড়ে। শীতে সেটা তেমন নয়। বর্ষাকালেই ঝরনা প্রাণ ফিরে পায়। তাই বর্ষাকালেই ঝরনা দেখা শ্রেয়। তবে পাহাড়ধসের সতর্কতা মনে রাখতে হবে। ভারী বর্ষণ হলে ঝিরিপথে পানির স্রোত বেশি থাকে। এতে করে যাওয়া অসম্ভব ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। বৃষ্টি হলে যাওয়ার পথ অনেক কঠিন হয়ে যায়।
দামতুয়া ঝরনায় যেতে হলে আপনাকে প্রথমে আলীকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলোমিটার পয়েন্টের জায়গায় আসতে হবে। আগে শুধু একভাবে যাওয়া যেত, এখন আপনি ১৯ কিলোমিটার দিয়েও যেতে পারবেন। যদি ১৯ কিলোমিটার দিয়ে রওনা দেন তাহলে কম হাঁটতে হবে। এখানে আসা যায় দুইভাবে। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা থেকে আলীকদম হয়ে অথবা সরাসরি আলীকদম গিয়ে। আরেকটি পথ হলো, বান্দরবান শহর থেকে আলীকদম যাওয়ার রোড ধরে। সবচেয়ে সহজ হচ্ছে চকরিয়া থেকে আলীকদম হয়ে যাওয়া। আপনারা একসঙ্গে বেশি মানুষ থাকলে আলীকদম থেকে চান্দের গাড়ি/জিপ ভাড়া করে নিতে পারবেন। আলীকদম থেকে যাওয়ার পথে ১০ কিলোমিটার যাওয়ার পর আর্মি ক্যাম্প আছে। সেখানে সবার জাতীয় পরিচয়পত্র ও ফোন নম্বর দিয়ে নাম এন্ট্রি করে সামনে যাওয়ার জন্য অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। আর মনে রাখতে হবে, আপনাকে অবশ্যই সেদিনই ট্র্যাকিং শেষ করে বিকেল পাঁচটার আগে এই ১০ কিলোমিটারের আর্মি ক্যাম্পে ফিরে এসে রিপোর্ট করতে হবে। তাই সময়ের দিকে খেয়াল রাখা উচিত।
আপনাদের সময় এবং সবকিছু বিবেচনা করে সঙ্গে একজন ট্যুর গাইড হিসেবে স্থানীয় কাউকে নিয়ে গেলে সুবিধা হয়। আলীকদম এলাকা থেকে স্থানীয় প্রশাসনের আওতায় নিবন্ধিত গাইড নিয়ে যাবেন। এলাকায় পর্যটকদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনেক চাকমা ছেলে আছে। সকাল ৯টা-১০টার মধ্যে হাঁটা শুরু করলে সুবিধা হয়। এ সময় রওনা দিলে ভালো করে সব কটি ঝরনা দেখে বিকেলের মধ্যে ফিরে আসা যাবে। প্রয়োজনীয় ও চাহিদামতো খাবার, প্রাথমিক চিকিৎসা-উপকরণ, পানি, লাঠি, ছুরি, কাপড়, জুতা ইত্যাদি নিলে সুবিধা হবে। কারণ, ওখানে কোনো দোকান নেই।
একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, আর্মি ক্যাম্প থেকে দামতুয়া যাওয়ার পথে থাকতে দেয় না। আপনাকে দামতুয়া ঝরনা দেখে সেদিনই আলীকদম ফিরে আসতে হবে। আর আলীকদমে থাকার মতো তেমন ভালো কোনো হোটেল বা আবাসিক ব্যবস্থা নেই। যদি একান্ত থাকার প্রয়োজন হয় তাহলে জেলা প্রশাসনের বাংলোতে থাকতে পারবেন। তবে তাদের সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়া ভালো। ঢাকা থেকে গেলে সকালে পৌঁছে সারা দিন ঘুরে আলীকদম থেকে সন্ধ্যার ফিরতি বাসে ঢাকায় চলে আসতে পারবেন। খাওয়ার জন্য আলীকদমে বা আলীকদমের পানবাজারে মোটামুটি মানের বেশ কিছু হোটেল আছে। সেখানে দেশীয় খাবারের ব্যবস্থা আছে, অল্প খরচে খেয়ে নিতে পারবেন।
ঝরনায় যাওয়ার রাস্তা বেশ দুর্গম এবং পাথরের জায়গা পিচ্ছিল থাকতে পারে। তাই সতর্কতার সঙ্গে পথ চলতে হবে। মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ওই দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফিরে আসা অনেক কঠিন হবে। তাই ট্র্যাকিংসহায়ক জুতা নিতে ভুলবেন না।
ছবি: লেখক