কক্সবাজার জেলার একটি উপজেলা টেকনাফ। এর অবস্থান বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে। কক্সবাজার জেলা সদর থেকে দূরত্ব প্রায় ৮২ কিলোমিটার। নির্জন সমুদ্রসৈকত, পাহাড় আর নাফ নদী সব মিলিয়ে টেকনাফে আছে দেখার অনেক কিছু। বসন্তের শুরুতে পাহাড়ে গেলে নাম না-জানা ফুলের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হবে আপনার।
টেকনাফ থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে গেম রিজার্ভের সর্বোচ্চ চূড়ার নাম তৈঙ্গা চূড়া। গেম রিজার্ভ বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম সংরক্ষিত বনাঞ্চল, যার পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নাফ নদী; আর এর ঠিক পরপরই মিয়ানমার সীমান্ত এবং পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ফুট উচ্চতায় অভয়ারণ্য তৈঙ্গা চূড়া অবস্থিত।। তৈঙ্গা চূড়া বনের উল্লেখযোগ্য গাছ হলো চাপালিশ, গর্জন, উরাআম, আশোক, জলপাই প্রভৃতি গাছ। এই বনে রয়েছে ২৯০ প্রজাতির বিভিন্ন উদ্ভিদ, ১৩০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, উভচর এবং ২৮৫ প্রজাতির পাখির বসবাস। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এশীয় বন্য হাতি বনের মূল আকর্ষণ। এ ছাড়া দেখা মিলবে বিলুপ্তপ্রায় বুনো কুকুর, ভালুক, সম্বর হরিণ, উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি, শজারুসহ প্রভৃতি প্রাণীর। বনের আশপাশে চাকমা, মারমা ও রাখাইন আদিবাসীদের বসবাস। আর শিলাময় পাহাড়ের ধাপে ধাপে প্রবাহিত হচ্ছে অপূর্ব তৈঙ্গা ঝিরি।
কক্সবাজারের রামু উপজেলার উখিয়াঘোনা পাহাড়ের ঝিরি বা পাহাড়ি নালা পার হয়ে যাওয়ার পর দেখার মতো ঐতিহাসিক দার্শনিক সুড়ঙ্গ এটি। যার অপর নাম ‘কানা রাজার সুড়ঙ্গ’। ৩৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের সুড়ঙ্গ এটি, যেখানে ৭০ ফুট পায়ে হেঁটে যাওয়ার পর হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়। সেখানে আছে একটি বড় পুরোনো রঙ্গশালা বা বৈঠকখানা, দেয়ালে সাজিয়ে রাখা আছে অনেক ছবি। সুড়ঙ্গের থেকে একটু ভেতরে গেলেই দেখা যায় চারটি পথ। যার মধ্যে লুকিয়ে আছে জানা-আজানা নানা রহস্য। ‘কক্সবাজারের ইতিহাস’ নামের একটি বইয়ে এই সুড়ঙ্গের বর্ণনা আছে।
টেকনাফ থানার প্রাঙ্গণে অবস্থিত, যেটি প্রেমের আত্মত্যাগের নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করে রেখেছে পুলিশ প্রশাসন। প্রায় ৮০ বছর আগে সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন। একদিন ভোরে মৃদু গুঞ্জনের আওয়াজে তিনি থানার বারান্দায় এসে দেখেন কুয়ায় পানি নিতে আসা বেশ কিছু রাখাইন কন্যারা সুউচ্চ কলহাস্যে মুখরিত করে রেখেছে কুয়ার প্রাঙ্গণ। ওই রাখাইন কন্যাদের মধ্যে ধীরেজ দেখতে পান টেকনাফের জমিদারের একমাত্র কন্যা মাথিনকে। রোজ মাথিনের পানি নিতে আসায় ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় ধীরাজ ও মাথিনের ভালোবাসার সম্পর্ক। দুজন সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার। এরই মধ্যে কলকাতা থেকে ধীরাজের বাবার চিঠি আসে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার জন্য। মাথিনকে না জানিয়ে কলকাতায় ফিরে জান ধীরাজ। এদিকে ১৪-১৫ বছরের মাথিন ধীরাজকে হারানোর কষ্টে অনাহারে বিরহে জীবনযাপন করতে করতেই এই কুয়ায় আত্মত্যাগ করেন। তাই আজও মাথিনের অমর প্রেমের সাক্ষী হয়ে আছে এই ‘মাথিনের কুয়া’।
বেশির ভাগ সময় থাকে জনমানবহীন। টেকনাফ শহর ছেড়ে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে শিলখালী সুউচ্চ গর্জন বনের ভেতর দিয়ে ১০ কিলোমিটার পথ গেলেই আসে এই নির্জন সৈকত। পশ্চিমে সমুদ্র আর পূর্বে পাহাড়ের অপূর্ব একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। এই সৈকতের তীর ঘেঁষে রয়েছে ছোট আর মাঝারি আকৃতির ঝাউগাছের জঙ্গল আর সমুদ্রের নীল জলরাশিতে সারি সারি পাথরের মেলা। সৈকতটি খুবই প্রশস্ত ও পাথরে ঘেরা; আর ওই পাথরের ফাঁকে ফাঁকে জমা সমুদ্রের জলে ছোট ছোট লাল কাঁকড়া, মাছ, শামুক, ঝিনুকসহ আরও কত কী পাওয়া যায়! খুব সকাল কিংবা বিকেলে এ সৈকতে নামে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়াদের দল। একটু দূরে সমুদ্রের সৈকতজুড়ে রয়েছে নোঙর করে রাখা সারি সারি নৌকা। বিকেলে সূর্যাস্তের প্রাক্কালে অন্তগামী সূর্যের ছায়া সমুদ্রের জলের সঙ্গে মিলেমিশে সৃষ্টি হওয়া অপরূপ শোভা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভ্রমণে যাঁরা নির্জনতা পছন্দ করেন তাঁদের জন্য আদর্শ জায়গা হচ্ছে শাপলাপুর সৈকত।
টেকনাফ-মিয়ানমার জেটিঘাট হচ্ছে নৌকা, জাহাজ, ট্রলার ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা পর্যটক ও স্থানীয়দের নিরাপত্তার জন্য তৈরি। রোহিঙ্গাদের অবৈধ আগমন নিয়ন্ত্রণ করাতে অনেক কঠিন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। ঘাটে পর্যটক ও স্থানীয় লোকজনের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। জেটির মাধ্যমে নাফ নদীর মাঝামাঝি স্থানে পৌঁছানো যায়, এ কারণে পর্যটকদের কাছে এটি আকর্ষণের। অল্প সময়ে, অল্প খরচে বিনোদনের জন্য উপযুক্ত জায়গা জেটিঘাট। এখানে কিছু রেস্তোরাঁ আছে। জেটিঘাটের দুই পাশে ভ্রমণপিপাসুদের বসে প্রকৃতির আনন্দ নেওয়ার জন্য রাখা আছে কিছু ছাতা ও চেয়ার। পর্যটকেরা ঘাটে বসে দেখতে পাবেন চিংড়ির পোনা শিকারিরা তাদের নিজেদের কৌশল কীভাবে ব্যবহার করে পোনা ধরে।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত নদী। নাফ নদীর ডান তীরে বাংলাদেশ এবং বাম তীরে মিয়ানমার অবস্থিত। সীমান্ত প্রহরীরা এই নদীতে বার্মা সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে। এই নদীর সর্বোচ্চ গভীরতা আনুমানিক ৪২০ ফুট। নদীর দৈর্ঘ্য ৬৩ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৩৬৪ মিটার। আরাকান ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য পাহাড় থেকে নাফ নদীর উৎসারিত হয়ে বঙ্গোপসাগরের বর্ধিত অংশ হিসেবে মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। তাই নদীর পানি লবণাক্ত। টেকনাফ উপজেলার ১৫ হাজার পরিবার নাফ নদীর ওপরে ভরসা করেই জীবিকা নির্বাহ করছে। এই নদীর দিয়েই সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যেতে হয়। নদীতে পালতোলা নৌকায় জেলেরা মাছ ধরেন। পর্যটকেরা নদীতে ট্রলারে করে রোমাঞ্চকর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিতে পারেন।
টেকনাফে থাকার জন্য আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল নে টং। এসি ডবল রুম, এসি রুম এবং সাধারণ দ্বৈত কক্ষ এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে। পর্যটনের এই মোটেল টেকনাফ শহরের প্রায় আট কিলোমিটার আগে। ঢাকার পর্যটন করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় থেকে এই মোটেলে বুকিং করা যায়। তবে যাঁরা টেকনাফ সমুদ্রসৈকতের একেবারে কাছাকাছি থাকতে চান তাঁদের জন্য আছে সেন্ট্রাল রিসোর্ট। এ ছাড়া এখানে সাগরকন্যা, মেঘবালিকা ও নীলাচল নামে তিনটি কটেজ আছে। প্রতিটি কটেজে আছে দুটি করে রুম। ভাড়া ২ হাজার টাকা করে।
ঢাকা থেকেও এই রিসোর্টে আগাম বুকিং দেওয়া যায়।
ঢাকা থেকে সরাসরি টেকনাফ যাওয়া যায় সড়কপথে। এ পথে চলাচলকারী এসি বাস হলো সেন্ট মার্টিন সার্ভিস। ভাড়া ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।
এ ছাড়া শ্যামলী পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহন, ইউনিক সার্ভিস, হানিফ এন্টারপ্রাইজের নন-এসি বাসও চলে এই পথে। ভাড়া ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
কক্সবাজার থেকে বাস ও মাইক্রোবাসে টেকনাফ যাওয়া যায়। বাসভাড়া ৮০ থেকে ১২০ টাকা। আর মাইক্রোবাসে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
কক্সবাজার থেকে টেকনাফের বাস ছাড়ে আন্তজেলা বাস টার্মিনাল থেকে আর মাইক্রোবাস ছাড়ে শহরের কলাতলী এবং টেকনাফ বাইপাস মোড় থেকে।
টেকনাফ শহর থেকে সমুদ্রসৈকতে যাওয়া যাবে অটোরিকশায়। সময় লাগে আধা ঘণ্টার কম।
টেকনাফ সমুদ্রসৈকতে লাইফ গার্ডের কোনো ব্যবস্থা নেই। জোয়ার-ভাটার সাংকেতিক কোনো চিহ্ন থাকে না এ সৈকতে। এখানকার জেলেদের কাছে জোয়ার-ভাটার সময়ের সঠিক তথ্য থাকে।
তাই সমুদ্র নামতে চাইলে জোয়ার-ভাটা সম্পর্কে জেনে নিন। ভাটার সময় কিংবা একাকী সমুদ্রে নামবেন না।