ইতিহাসের জনপদ চাঁপাইনবাবগঞ্জে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

উত্তরবঙ্গে এখন আমের পূর্ণ মৌসুম শুরু হচ্ছে। যদিও উত্তরবঙ্গ বেড়াতে যাওয়া যায় যেকোনো সময়ে। তবে আমের মৌসুমে ভ্রমণ করলে দিগন্ত বিস্তৃত আমবাগান এবং আমের বিশাল বাজার ছাড়া বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল ঘুরে আসতে পারবেন। গ্রীষ্মকালে আম ও লিচুর মৌসুমে রাজশাহী অঞ্চল ভ্রমণ করলে আমবাগান ঘুরে দেখা চমৎকার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই। বিশেষত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও দিনাজপুর ভ্রমণে একসঙ্গে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয়; পাশাপাশি মৌসুমি ফলাহারের স্বাদ দারুণ মাত্রা যুক্ত করতে পারে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত আমবাগান এবং আমের বিশাল বাজার
চাঁপাইনবাবগঞ্জে রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত আমবাগান এবং আমের বিশাল বাজার

বাংলাদেশের আম, রেশম, স্থলবন্দর, ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদ ও ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরার দেশ চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বরেন্দ্রভূমি, পদ্মা, মহানন্দা, পুনর্ভবা, নন্দকুজা নদীর অববাহিকার পলিমাটিসমৃদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রায় সারা বছর সবুজ হয়ে থাকে। একসময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুর্শিদাবাদের নবাবদের বিলাস ও শিকারের জায়গা ছিল। মালদহ ও রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত নবাবগঞ্জ মহকুমাকে ১৯৮৪ সালে জেলা ঘোষণা করা হয়। মুর্শিদাবাদের নবাবেরা এখানে এসে তাঁবু স্থাপন করে শিকার ও অবকাশ যাপন করতেন। এ জন্য স্থানটির নাম নবাবগঞ্জ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তা ছাড়া নবাবগঞ্জের অদূরে মহেশপুর নামক স্থানে একজন আলোচিত বাইজি থাকতেন। তাঁর নৃত্যে নবাবেরা খুশি হয়ে তাঁকে ‘চম্পারানী’ ডাকতেন। যে কারণে চম্পারানী নামের অপভ্রংশ চম্পাবাই থেকে ক্রমে ‘চাঁপাই’ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। নবাবদের তাঁবু ফেলার স্থানকে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ বলা হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র ছোট সোনা মসজিদ
চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র ছোট সোনা মসজিদ

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র ছোট সোনা মসজিদ। শিবগঞ্জ উপজেলায় এর অবস্থান। প্রায় ৪০০ বছর আগে মোগল সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে ওয়ালী মোহাম্মদ এটি নির্মাণ করেন। এর নির্মাণকাল ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ সাল। মসজিদটিতে মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে। মসজিদের দৈর্ঘ্য ৮২ ফুট, প্রস্থ ৫২ ফুট ও উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। মসজিদে ১৫টি ছোট-বড় গম্বুজ রয়েছে। প্রতিটি গম্বুজ কারুকার্যখচিত। মসজিদের উত্তর কোণে রয়েছে একটি বৃহৎ দিঘি। এর পাশেই রয়েছে দুটি বড় আকারের পাথর। এগুলোর একটিকে জিন্দা ও অপরটিকে খুদা পাথর বলা হয়। মসজিদের আঙিনায় রয়েছে নির্মাণকারী ওয়ালী মোহাম্মদ এবং তাঁর নিকটাত্মীয়ের কবর। মসজিদ কম্পাউন্ডের ভেতরেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।

সোনা মসজিদের অদূরে অবিস্থত তোহাখানা। এটি মূলত একটি কবরস্থান
সোনা মসজিদের অদূরে অবিস্থত তোহাখানা। এটি মূলত একটি কবরস্থান

সোনা মসজিদের অদূরে অবিস্থত তোহাখানা। এটি মূলত একটি কবরস্থান। সুলতানি আমলে সুলতানের নিকটাত্মীয় ও সৈন্যদের এখানে কবর দেওয়া হতো। তোহাখানার পাশে একটি বিশাল দিঘি রয়েছে। তোহাখানা ও সোনা মসজিদ এখন একটি পিকনিক স্পট। সোনা মসজিদের অভ্যন্তরে বাদশাহের বসার স্থানকে ‘বাদশা কা তখ্ত’ বলা হয়। এ ছাড়া এই মসজিদে নারীদের নামাজ পড়ার জন্য আলাদা একটি জেনানাখানা আছে। তোহাখানার দিঘির কোল ঘেঁষে আছে একটি হাওয়াখানা, এর প্রায় একতলা অংশ পানি এবং মাটির নিচে অবস্থিত মসজিদের খানিক দূরেই দেখতে পাই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর। এই বন্দর সোনা মসজিদ নামেই পরিচিত। স্থলবন্দরে দাঁড়ালেই পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার গৌড় রাজ্যের সীমানাপ্রাচীর নজরে পড়বে।

বিজ্ঞাপন

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম একটি উপজেলা ভোলাহাট। ভোলাহাটে বাংলাদেশের অন্যতম রেশম উৎপাদন কেন্দ্র। ভোলাহাটের গ্রামগুলোয় রেশমশিল্প–সংশ্লিষ্ট কাজকর্ম দেখা যাবে।

কানসাট হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের রাজধানী। দেশের সুবিখ্যাত আমবাগানের উপস্থিতি এখানে সবচেয়ে বেশি। যেদিকে দৃষ্টি পড়ে চারদিকে শুধু আমবাগান আর আমবাগান। এখানে শতাধিক প্রজাতির আম উৎপন্ন হয়।

গ্রীষ্মকালে আম ও লিচুর মৌসুমে ভ্রমণ করলে আমবাগান ঘুরে দেখা চমৎকার অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে
গ্রীষ্মকালে আম ও লিচুর মৌসুমে ভ্রমণ করলে আমবাগান ঘুরে দেখা চমৎকার অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে

চাঁপাই এলে নাচোল থানায় আসতে ভুলবেন না, ইলা মিত্রের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন ইতিহাসের গর্বের বিষয়। এখানকার আপামর জনগণের ‘রানীমাতা’ ইলা মিত্রের বাড়ি নাচোলে। তাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভ্রমণের সময় নাচোলের ‘রাজবাড়ী’ দেখে যাওয়া ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ভ্রমণপিপাসুদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ। এ ছাড়া নাচোলের লালমাটির দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের পাশে সাঁওতালপল্লির আদিবাসীদের সহজ–সরল জীবনাচরণ ও তাদের উন্নত সংস্কৃতি অবলোকন ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরও সমৃদ্ধ করবে। সারা দিনের ভ্রমণ শেষে রাতে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করতে পারেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে থাকার খুব ভালো হোটেল নেই। তাই পরিবার নিয়ে এলে রাজশাহীতে থাকাই ভালো। রাজশাহীতে থাকার জন্য যেমন সরকারি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভালো মানের অনেক হোটেলও।

আবার রাজশাহী দিয়ে ঢুকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁর সাপাহার ও পোরশা হয়ে সরাসরি ঢাকা চলে আসতে পারেন। আর ট্রেনে যাঁরা ভ্রমণ করতে চান, তাঁদের নওগাঁ সদরে চলে আসতে হবে। জেলা সদর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে বিখ্যাত সান্তাহার জংশন রেলস্টেশন। এখান থেকে নীলসাগর, রংপুর এক্সপ্রেস, দ্রুতযান কিংবা লালমনিরহাট এক্সপ্রেসে চড়ে ঢাকা চলে আসতে পারবেন।

ট্রেনে যাঁরা ভ্রমণ করতে চান, তাঁদের নওগাঁ সদরে চলে আসতে হবে। জেলা সদর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে বিখ্যাত সান্তাহার জংশন রেলস্টেশন
ট্রেনে যাঁরা ভ্রমণ করতে চান, তাঁদের নওগাঁ সদরে চলে আসতে হবে। জেলা সদর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে বিখ্যাত সান্তাহার জংশন রেলস্টেশন

চাঁপাইনবাবগঞ্জ গেলে অবশ্যই বিভিন্ন ভর্তা দিয়ে কালাই রুটি খেয়ে আসবেন; সেই সঙ্গে শিবগঞ্জের চমচম আর নসিপুরের দইসহ বিভিন্ন মুখরোচক খাবার খেতে ভুলবেন না।

ছবি: হাল ফ্যাশন ও প্রথম আলো

বিজ্ঞাপন
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ০৯: ০০
বিজ্ঞাপন