বাংলাদেশের ঐশ্বর্য সন্ধান ১০: যেভাবে খুঁজে পেয়েছি পাঁচকড়ি জমিদারবাড়ি
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ভাই থামেন, থামেন!
গাড়ির চালক থামলেন।
ওই যে একটি মঠ-মন্দিরের সুচালো মাথা দেখা যাচ্ছে। এই মাটির রাস্তা ধরে যাই।  
হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের এমাথা-ওমাথা খুঁজে বেড়াচ্ছি; কিন্তু পাঁচকড়ি জমিদারবাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না। পথে যাঁকেই জিজ্ঞাসা করছি, বলছেন, ‘একটু সামনে, একটু সামনে।’

জমিদার বাড়ির চত্বরে লেখক
জমিদার বাড়ির চত্বরে লেখক

নেটওয়ার্কের জন্য গুগল ম্যাপও কাজ করছে না। পাঁচকড়ি জমিদারবাড়ি সার্চ করলে ভিন্ন পথ দেখাচ্ছে। এই রাস্তা দিয়ে একবার গেছি। খুঁজে না পেয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার একই পথে হাটহাজারী শহরের দিকে যাচ্ছি। একটি মঠ–মন্দিরের অংশবিশেষ দেখে মনে হলো হয়তো এর কাছাকাছি হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

আমার অনুমান সঠিক ছিল। কিন্তু কাছে গিয়ে গেট বন্ধ পেলাম। এলাকার কয়েকটি শিশু সেখানে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো, ওরা কেবলই বেরিয়ে এল জমিদারবাড়ির চত্বর থেকে। তারপর গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের সহায়তায় আমরা ভেতরে গেলাম।

জমিদার বাড়ির মূল ভবন
জমিদার বাড়ির মূল ভবন

ভেতরে ঢুকেই দেখলাম এল প্যাটার্নের একটি দ্বিতল বাড়ি। আগে কেমন ছিল জানি না। যেখান থেকে বাড়িটি শুরু হয়েছে, সে ভবনগুলো একেবারে ক্ষয়ে গেছে। কিন্তু বাড়ির একটি লম্বা অংশ কিছুটা ভালো আছে। বাড়ির স্থাপত্যশৈলী বলছে, এটি বনেদি বাড়ি।
বাড়ির একদিকে কাঠের একটি মন্দির দেখলাম। কাঠের কারুকাজ এখনো দারুণ।

বিজ্ঞাপন

মন্দিরের সামনেই একজন নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাছে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। এই বাড়িতে আসার কারণ ব্যাখ্যা করলাম। তিনি বললেন, ‘আমরা আসলে চাই না আমাদের বাড়ি নিয়ে বেশি কথা হোক।’ কথাটি আমার কাছে সত্যি মনে হলো। কারণ, খুব অল্প তথ্য রয়েছে এই বাড়ি সম্পর্কে। গুগল খুব বেশি সহায়তা করতে পারেনি আমাকে। প্রথমে তিনি আগ্রহী না হলেও খানিক পরেই বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাদের বাড়ির অন্দরমহলে নিয়ে গেলেন।

ভেতরে গিয়ে তো আরও ভালো লাগল। বাড়ির পেছনের কারুকাজ আরও বেশি সুন্দর। যে দিদি আমাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন, তিনি এই বাড়ির চতুর্থ প্রজন্মের পুত্রবধূ।  

এই বাড়িতে থাকেন পাঁচকড়ি জমিদারবাড়ির চতুর্থ বংশধর অংশুমান রায়চৌধুরী ও তাঁর পরিবার। কথা হলো তাঁদের সঙ্গে। জানা হলো পাঁচকড়ি জমিদারবাড়ির পত্তনের ইতিহাস। স্বল্পভাষী কিন্তু সদালাপী অংশুমান রায়চৌধুরী আগ্রহভরে কথা বলেছেন আমার সঙ্গে।

অংশুমান রায় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী
অংশুমান রায় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী

বাড়ির ঘরগুলোও ঘুরে দেখেছি আমরা। ভেতরে কাঠের সিঁড়িগুলো বেশ সুন্দর। পুরো বাড়ির চত্বর ভীষণ নির্জন। বড় বড় গাছ আর পাখির কলকাকলিতে মুখর। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই এত নীরবতা। এত বড় বাড়িতে থাকেন মাত্র চারজন সদস্য। এই জমিদারবাড়িতে রাত কাটানোর অনুভূতি কেমন, কে জানে!

ঝটিতি ভ্রমণে এলে একটি জমিদারবাড়ির ইতিহাস পুরোটা জানা হয় না।
মোটামুটি ইতিহাস যেটুকু বুঝেছি, তা হলো এই জমিদারবাড়ির নির্মাতা অর্পণাচরণ রায়চৌধুরী। অংশুমান রায়চৌধুরীর মতে, জমিদারবাড়িটি অর্পণাচরণ রায়চৌধুরী নির্মাণ করলেও তাঁর পুত্র পাঁচকড়ি রায়চৌধুরী তথা মনমোহন রায়চৌধুরীর নামে বাড়িটি ‘পাঁচকড়ি জমিদারবাড়ি’ নামে অধিক পরিচিত। পাঁচকড়ি মনমোহন রায়চৌধুরীর ডাকনাম। পূর্বপুরুষ লালা-লাল চন্দ্র রায় তৎকালীন মোগল ভারতের পাঞ্জাব থেকে এসেছেন বলে ধারণা করা হয়।  

অন্দরমহলে কাঠের সিঁড়ি
অন্দরমহলে কাঠের সিঁড়ি

অংশুমান রায়চৌধুরী বলেন, ‘এটি জমিদারের গ্রামের বাড়ি। আমাদের আরও ৩১টি বাড়ি ছিল চট্টগ্রাম শহরে। বাড়িগুলো হাতবদল হয়েছে। আমাদের পরিবারের ট্র্যাজেডি হলো, কেউ ৫০ বছরের বেশি বেঁচে থাকেন না। তাই নাবালক সম্পত্তি হিসেবে অনেক বাড়ি আমাদের হাতছাড়া হয়েছে।’

প্রথমে ঢুকে যে জীর্ণ দ্বিতল ভবন দেখেছি, সেটি ছিল কাছারিঘর। মূল বাড়ি থেকে কাছারিঘরে যাওয়ার জন্য একটি প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি ছিল। সিঁড়িঘরটি একদম পরিত্যক্ত।

এল প্যাটার্নের মত দেখাচ্ছে ভবনগুলো
এল প্যাটার্নের মত দেখাচ্ছে ভবনগুলো

অংশুমান রায়চৌধুরীর আরো জানান, অপর্ণাচরণ সিটি কর্পোরেশন গার্লস হাই স্কুল , চট্টগ্রাম শহরে নন্দনকানন এলাকায় অবস্থিত। এটি ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া শিকারপুর ইউনিয়নের লালাচন্দ্র বিল এই জমিদারির পূর্ব-পুরুষের স্মৃতি বহন করে। 

কথা বলতে বলতে প্রায় সন্ধে হয়ে এল। অংশুমান রায়চৌধুরী আমাদের নিয়ে গেলেন বাড়ির সমাধিক্ষেত্র ও দিঘির কাছে। দিঘিটি বেশ বড়। যে মঠ–মন্দিরের শীর্ষ দেখে খুঁজে পেয়েছিলাম পাঁচকড়ি জমিদারবাড়ি, সেটি এই জমিদারির সূচনাকারী অর্পণাচরণ রায়চৌধুরীর সমাধি। বেশ ক্ষয়ে গেছে।

ভাবার চেষ্টা করছিলাম, অর্পণা রায়চৌধুরী কি জানতেন, প্রায় ২০০ বছর পর তাঁর বাড়ির খোঁজে কেউ প্রায় ৩০০ মাইল দূর থেকে আসবে! অংশুমান রায়চৌধুরীকে বিদায় জানিয়ে আমরা চট্টগ্রাম শহরমুখী  হলাম।

জমিদার বাড়ির দিঘী
জমিদার বাড়ির দিঘী

অংশুমান রায়চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে জমিদারবাড়ির একটি ইট সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছি। বাড়ির উঠানেই কয়েকটি আধভাঙা ইট দেখেছি, যাতে খচিত রয়েছে অর্পণা রায়চৌধুরী নামের আদ্যক্ষর। পুরো অট্টালিকা নির্মিত হয়েছে এই ইট দিয়ে।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন