বাংলাদেশের ঐশ্বর্য সন্ধান ২১:হেমনগরের পরির দালান
শেয়ার করুন
ফলো করুন

কী অপূর্ব চিনি-টিকরির কারুকাজ! বাংলাদেশের খুব কম বনেদি বাড়িতে আমি এ রকম চিনি–টিকরির নির্মাণশৈলী দেখেছি।
চিনি–টিকরির কারুকাজ আসলে কী
চিনি-টিকরি হলো একধরনের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প, যেখানে রঙিন চিনামাটির টুকরা, কাচ ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে স্থাপনার দেয়াল ও ছাদ সজ্জিত করা হয়। ঐতিহাসিক স্থাপনা, বিশেষ করে মসজিদ, জমিদারবাড়ির অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সজ্জায় এর ব্যবহার দেখা যায়।

চিনি–টিকরির অপূর্ব কারুকাজ
চিনি–টিকরির অপূর্ব কারুকাজ

এমন চিনি-টিকরির দেখা মেলে হেমনগর জমিদারবাড়িতে। এর স্থাপত্যশৈলী অপূর্ব। বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক মানচিত্রে ছড়িয়ে থাকা বনেদি বাড়িগুলো আমাদের অতীত দিনের চিত্র তুলে ধরে। এসব স্থাপত্য শুধু জমিদার পরিবারের প্রশস্তি বহন করে না, বরং ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির নানা পরিবর্তনের দলিলও হয়ে আছে।

বিজ্ঞাপন

টাঙ্গাইলের সুপরিচিত একটি জায়গার নাম গোপালপুর উপজেলার হেমনগর। টাঙ্গাইলের উত্তরাঞ্চলে গোপালপুর থানার পশ্চিম সীমানায় যমুনা নদী। সেই যমুনা থেকে অল্প দূরত্বে এখনো ইতিহাসের চিহ্ন বুকে দাঁড়িয়ে আছে হেমনগর জমিদারবাড়ি। হেমনগর সুপরিচিত হওয়ার কারণ হচ্ছে, এখানে রয়েছে তৎকালীন জমিদার হেমন্ত চন্দ্র চৌধুরী ওরফে হেমচন্দ্র চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত জমিদারবাড়ি। তাঁর নামেই এলাকাটির নাম হয়েছে হেমনগর।

ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের মূল শহরে যাওয়ার পর স্থানীয় বাস সার্ভিস রয়েছে গোপালপুর উপজেলায় যাওয়ার। স্থানীয় বাহনে উঠে বসার পর পথ যেন ফুরাচ্ছিলই না। টাঙ্গাইল শহর থেকে গোপালপুর উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। বাস নামিয়ে দিল হেমনগর রেলস্টেশনের কাছে। সেখানে নেমে অটোরিক্সা নিলাম।
চালক বললেন, ‘পরির দালানে যাইবেন?’
আমি বললাম, ‘সেটা তো এখন হেমনগর কলেজ।’
অটোরিকশাচালক জানান, হেমনগরের সবাই জমিদারবাড়িকে পরির দালান বলে।
প্রায় মিনিট বিশেক পর পৌঁছালাম পরির দালানের সামনে। সড়ক থেকে একটি বড় মাঠ পেরিয়ে জমিদারবাড়ির মূল ভবন। আমি তৎকালীন অবস্থা কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম। মাঠের তিন দিকেই সড়ক। আসলে কি তখন সড়ক এ রকম ছিল? এই মাঠ সে সময় কি কাজে ব্যবহার হতো? এসব ভাবছি আর মাঠ পার হচ্ছি। মূল ভবনের সামনে এসে আসলেই চোখ স্থির হয়ে গেল। চিনি-টিকরির কারুশৈলীতে নানা রকম নকশা ব্যবহার করা হয়েছে। কোথাও রয়েছে জ্যামিতিক মোটিফ, কোথাও চোখে পড়ছে ফ্লোরাল মোটিফ।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতল ভবনে অনেক কামরা। স্থানীয়দের কাছে জেনেছি, ১০০ কামরার পরির দালান। জানি না আসলে কতগুলো। হেমনগর জমিদারবাড়ির স্থাপত্যে ইউরোপীয় নিওক্ল্যাসিক্যাল ধারা ও ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী নকশার সমন্বয় লক্ষণীয়। এতে রয়েছে উঁচু দালান ও প্রশস্ত বারান্দা, অর্ধবৃত্তাকার খিলান, কারুকাজ করা কাঠের দরজা-জানালা, ইট-চুনের সমন্বয়ে নির্মিত শক্তিশালী গঠন।

পরীর দালানের সামনে লেখক
পরীর দালানের সামনে লেখক

বাড়ির মূল ফটক, কেন্দ্রীয় দালান, লম্বা করিডোর, দরবার হল, অতিথিশালা—এসব সেই সময়কার প্রভাবশালী জমিদার পরিবার ও তাদের সামাজিক প্রতিপত্তির চিত্র তুলে ধরে। এ বাড়ির আঙিনা, পুকুরঘাট ও চারপাশে বিস্তৃত বৃক্ষরাজি একসময় জমিদার পরিবারের আভিজাত্যের পরিচয় দেয়।

স্থানীয় সমাজে হেমনগর জমিদারবাড়ি একসময় ছিল কৃষ্টিচর্চার কেন্দ্র। পূজা-পার্বণ, নৌকাবাইচ, সাহিত্য আড্ডা, পল্লিসমাজের নানা সভা আয়োজনের কেন্দ্রস্থল ছিল এই বাড়ি। জমিদারেরা এলাকায় শিক্ষা বিস্তারেও ভূমিকা রাখেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার এবং দরিদ্রদের সহায়তা তাদের অন্যতম সামাজিক কার্যক্রম ছিল।

ভবনের পেছন দিকের কামরা
ভবনের পেছন দিকের কামরা

হেমচন্দ্র চৌধুরী শিক্ষা প্রসারের জন্য ১৯০০ সালে হেমনগরে তাঁর মায়ের নামে শশীমুখী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এ ছাড়া তিনি গোপালপুর উচ্চবিদ্যালয়ের জন্য জমিদানসহ পিংনা ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল স্কুল, গোপালপুর বালিকা বিদ্যালয় এবং বরিশাল মূক ও বধির বিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দান করেছিলেন। প্রজাদের স্বাস্থ্যসেবার কথা বিবেচনা করে হেমনগরে স্থাপন করেন হরদুর্গা দাতব্য চিকিৎসালয়।
মূল ভবনের শীর্ষে তাকালে ফ্লোরাল মোটিফের দুই পাশে দুটি পরির প্রতিমূর্তি দেখা যায়। হয়তো এ জন্যই এই স্থাপত্যের নাম হয়েছে পরির দালান। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, আরও দুটি উড়ন্ত পরির ভাস্কর্য ছিল ভবনের দুই দিকে।

ইতিহাসে হেমনগর জমিদারবাড়ির কথা পাওয়া যায় ১৮ শতকের শেষ ভাগে। স্থানীয় ঐতিহাসিকদের মতে, এ অঞ্চলের বণিক ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি সমৃদ্ধ হওয়ায় তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারি গড়ে ওঠে। এ অঞ্চলের কৃষি, নদীপথে বাণিজ্য ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে হেমনগর জমিদারদের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর জমিদার পরিবারের শক্তি ও প্রভাব কমে এলেও স্থাপত্যটি রয়ে গেছে ইতিহাসের বহমান চিহ্ন হিসেবে। আজকের দিনে হেমনগর জমিদারবাড়ি তার আগের মতো প্রাণচঞ্চল না হলেও এখনো টিকে আছে রাজকীয় স্থাপত্যে।

দুয়ারের লেয়ারে ভিন্ন ভিন্ন মোটিফ
দুয়ারের লেয়ারে ভিন্ন ভিন্ন মোটিফ

স্থানীয় লোকজন ও স্থানীয় লেখকদের বইয়ে হেমনগর জমিদারবাড়ি সম্পর্কে যে তথ্য পেয়েছি, সেগুলো কিছুটা এ রকম:
বাংলা ১২৫৪ সাল। মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়ার ভূস্বামী পদ্মলোচন রায় পুখুরিয়া পরগনার জমিদার ভৈরবচন্দের কাছ থেকে দুই আনার তালুক কেনেন। পদ্মলোচন মারা যাওয়ার পর পুত্র কালীচন্দ্র রায় ১২৬১ সালে ওই পরগনার নিলামে ওঠা বাকি চার আনা তালুকও কেনেন। তত দিনে আমবাড়িয়া জমিদারের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। কালীচন্দ্রের মৃত্যু হলে পুত্র হেমচন্দ্র রায় মুক্তাগাছার মহারাজা সূর্যকান্ত রায়ের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে জয়েনশাহী পরগনার নিলাম হওয়া তালুকের পাঁচ আনায় আড়াই গন্ডা (৮৫ হাজার একর) কেনেন। এভাবে উত্তর টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় চার লাখ একরে হেমচন্দ্র রায়ের জমিদারি বিস্তৃত হয়। তিনি রায় থেকে হন চৌধুরী।

নিকটবর্তী ধনবাড়ির মুসলিম জমিদার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর সঙ্গে রাজকাচারি, প্রজাস্বত্ব ও মৌজার সীমানা নিয়ে সহসাই বিরোধ দেখা দেয়। হেমচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন কুলীন ব্রা‏ম্মণ। ধর্মকর্মে নিষ্ঠাবান। অন্যদিকে নবাবজাদা নওয়াব আলী চৌধুরীও ছিলেন মুসলিম আভিজাত্যের প্রতীক। ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন তিনি। সুতরাং কুলীন ব্রাহ্মণ আর অভিজাত মুসলিম জমিদারের মধ্যে ক্রমান্বয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে।

হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৮৮০ সালে মধুপুর উপজেলার আমবাডিয়া রাজবাড়ি ত্যাগ করে গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের সুবর্ণখালি গ্রামে নতুন রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। সেখান থেকেই জমিদারি চালানো শুরু করেন। তখন বাংলার রাজধানী ছিল কলকাতা আর সুবর্ণখালি ছিল যমুনা তীরের বিখ্যাত নদীবন্দর। কলকাতার সঙ্গে নদীপথে সহজেই যোগাযোগ করা যেত। আসাম ও কলকাতার স্টিমার ভিড়ত তখন সুবর্ণখালিতে। জানা যায়, ১৯০৫ সালে হেমচন্দ্র চৌধুরীসহ কয়েকজন হিন্দু জমিদারের প্রচেষ্টায় ১৯০৫ সালে ময়মনসিংহ থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন সম্প্রসারণ করা হয়। স্টিমারে যমুনা পাড়ি দিয়ে সিরাজগঞ্জের মাধ্যমে কলকাতা পর্যন্ত রেলপথ সংযুক্ত করা হয়। ইতিপূর্বে ময়মনসিংহ-ঢাকা রেলপথ চালু থাকায় ঢাকা থেকে কলকাতা যাতায়াত সহজতর হয়। সরিষাবাড়ি উপজেলার জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে হেমচন্দ্র চৌধুরীর সুবর্ণখালির দূরত্ব ছিল মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। সড়কের এ অংশটুকু হেরিংবোন বন্ড করে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত টমটম অথবা পালকিতে যাওয়া-আসার বন্দোবস্ত করেন হেমচন্দ্র চৌধুরী। এ হেরিংবোন বন্ড সড়কটিই গোপালপুর উপজেলার ইতিহাসে প্রথম পাকা সড়ক। হেরিংবোন বন্ড হলো একধরনের ইটের গাঁথুনি বা প্যাটার্ন, যেখানে ইটগুলোকে সমান্তরালভাবে না বসিয়ে ৪৫ ডিগ্রি কোণে তীর্যকভাবে বসানো হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে যমুনা নদী বাঁক পরিবর্তন শুরু করলে ভাঙনে সুবর্ণখালি বন্দর বিলুপ্ত হয়। হেমচন্দ্র চৌধুরীর রাজবাড়িও নদীগর্ভে নিমজ্জিত হয়। সুবর্ণখালি ঐতিহ্য হারিয়ে বর্তমানে সোনামুই নাম ধারণ করে কোনোভাবে টিকে রয়েছে। হেমচন্দ্র চৌধুরী সুবর্ণখালি থেকে তিন কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে শিমলাপাড়া মৌজায় ১৮৯০ সালে নতুন একটি দ্বিতল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন, যার বর্তমান নামকরণ হয়েছে ‘পরির দালান’।

ভবনের শীর্ষে পরির মূর্তি
ভবনের শীর্ষে পরির মূর্তি

হেমনগর জমিদারবাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি অতীতের বর্ণময় ইতিহাসের স্পর্শময় স্মারক। সংরক্ষণ ও পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে এই ঐতিহ্য বোঝার ও জানার সুযোগ করে দেওয়া জরুরি।

জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৯৫২ সালে ভারতের কাশিতে মৃত্যুবরণ করেন বলে জানা যায়। জেনেছি, তাঁর বংশধরেরা এখনো কলকাতার যাদবপুরে বসবাস করেন। তাঁর এক উত্তরসূরি দুই বাংলার প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী পৌলমী গাঙ্গুলী। জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী দেশত্যাগের ৭০ বছর পর ২০১৫ সালের ২৮ জুলাই পৌলমী গাঙ্গুলী এসেছিলেন হেমনগর জমিদারবাড়িতে।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন