বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর বাড়িতে একদিন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

অটোরিকশা থেকে যে জায়গায় নামলাম, তার নাম নীলগঞ্জ। নীলগঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নরসুন্দা নদী। গন্তব্য চন্দ্রাবতীর বাড়ি। চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের আদিকবিদের একজন। আরও জোরালো শব্দে লিখতে গেলে ব্যাপারটি দাঁড়ায়, চন্দ্রাবতী ছিলেন মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি। জন্মেছিলেন আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি সীতার চোখে রামায়ণের কাহিনি দেখেছিলেন। এ যুক্তিতে নারীবাদের জননী বোধ হয় তাঁকে বলাই যায়। প্রভু রামকে নয়, দেবী সীতাকে প্রধান চরিত্র বানিয়ে নারীপ্রধান ন্যারেটিভে রামায়ণ লিখেছিলেন! তবে লেখা শেষ করতে পারেননি। থেকে যায় অসমাপ্ত। এ ছাড়া তিনি লিখেছেন ‘মলুয়া’ ও ‘দস্যু কেনারামের পালা’। চন্দ্রাবতীর মায়ের নাম সুলোচনা। আর এ কাজে তাঁকে আগ্রহ জুগিয়েছিলেন বাবা বংশীদাস ভট্টাচার্য্য। দ্বিজ বংশীদাস ভট্টাচার্য্য নিজেও বড় মাপের কবি ছিলেন। লিখেছিলেন ‘মনসামঙ্গল’।

চন্দ্রাবতীর বাড়ির ধংসাবশেষ
চন্দ্রাবতীর বাড়ির ধংসাবশেষ

আগে বেশ কয়েকবার কিশোরগঞ্জে ঢুঁ মারা হলেও চন্দ্রাবতীর বাড়ির দোর অবধি পৌঁছাতে পারিনি। তাই এবার শুধু চন্দ্রাবতীর বাড়ি দেখতেই বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে আছে এক বন্ধু। সে স্থানীয়। তাই তার কাঁধে গুরুদায়িত্ব পড়েছে আমাকে চন্দ্রাবতীর বাড়ি ঘুরিয়ে দেখানোর। একটু আবদার করতেই সে রাজি হয়ে যায়। যদিও তার সাহিত্য বা পুরোনো বাড়িঘর কোনোটাতেই বিশেষ আগ্রহ নেই!

বিজ্ঞাপন

কিশোরগঞ্জ সদর থেকে অটোরিকশায় নীলগঞ্জ। নীলগঞ্জে একবার অটোরিকশা বদল করে এরপর পৌঁছে যাই চন্দ্রাবতীর বাড়িতে। রাস্তায় বেশ কিছু তথ্য পেলাম। গোটা রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নরসুন্দা নদী। নরসুন্দার আগের জৌলুশ আজ আর নেই। একে ‘মরা নদী’ বলেই এখন লোকে ভালো চেনে। শুনলাম, ভালোবাসার মানুষকে না পেয়ে এই নদীতেই নাকি ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন চন্দ্রাবতী।

শিবমন্দিরের সামনে লেখক
শিবমন্দিরের সামনে লেখক

মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারিপাড়ায় চন্দ্রাবতীর বাড়ি ও শিবমন্দির। অটোরিকশা থেকে নেমে প্রথমেই চোখে পড়ে দুটি শিবমন্দির। প্রথমটি খানিকটা নিচু। কিছুটা দূরেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি শিবমন্দির। এটি বেশ উঁচু। লোকমুখে প্রচলিত আছে, চন্দ্রাবতীর সঙ্গে শৈশব থেকেই প্রেম ছিল জয়ানন্দ বা জয়চন্দ্র চক্রবর্তীর। শৈশবকাল পেরিয়ে যৌবনে উত্তীর্ণ হলে বিয়ে ঠিক হয় তাঁদের। কিন্তু সে প্রেম পরিণতি পায়নি। জয়ানন্দ প্রেমে পড়ে যান এক মুসলমান মেয়ের। সেই যুবতীর নাম আসমানী।

বিজ্ঞাপন

জয়ানন্দের প্রেম এতই গভীর ছিল যে তিনি আসমানীকে বিয়ে করতে ধর্মান্তরিত হওয়ারও সিদ্ধান্ত নেন। ধর্মান্তরিত হয়ে তাঁর নাম হয় জয়নাল। জয়নাল ও আসমানীর বিয়ের দিন ধার্য হয় সেই দিন, যেদিন জয়ানন্দ আর চন্দ্রাবতীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। প্রিয়তমের ধর্মান্তরিত হওয়া ও বিয়ের খবরে শোকবিহ্বল চন্দ্রাবতী সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি শিবসাধিকা হবেন। বিয়ে করবেন না আর কোনো দিন। বাবাকে তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানান। একমাত্র কন্যার ইচ্ছেপূরণে দ্বিজ বংশীদাস নির্মাণ করে দেন শিবমন্দিরটি। এটি আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত। মন্দিরটির গায়ের পোড়ামাটির নকশা একে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়।

ছোট শিবমন্দির
ছোট শিবমন্দির

মন্দির বলতে এখানে বড় আকৃতির মন্দিরটির কথাই বলছি। ভেতরে ঢোকার জন্য আছে ছোট একটি কাঠের দরজা; এটা এখন তালাবদ্ধ। চন্দ্রাবতী নাকি এই মন্দিরেই নিজেকে তালাবদ্ধ করে সাধনায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন। এরপর জয়ানন্দ একদিন তাঁর ভুল বুঝতে পেরে চন্দ্রাবতীর কাছে ফিরে এলেও শিবসাধনায় নিমগ্ন চন্দ্রাবতীর সাড়া না পেয়ে পাশেই বয়ে চলা ফুলেশ্বরী নদীতে ডুবে প্রাণ দেন। প্রিয়তমের মৃতদেহ নদীর জলে ভাসতে দেখে চন্দ্রাবতীও এ নদীর জলে ডুবেই আত্মহত্যা করেন বলে দাবি করেন অনেকে। তবে ফুলেশ্বরী এখন মৃত নদী। তার খোঁজ কেউ দিতে পারে না। হয়তো নরসুন্দার সঙ্গেই মিলে এক হয়ে গেছে সে।

শিবমন্দির থেকে খানিক দূরেই চন্দ্রাবতীর বাড়ি। বাড়িটি এখন ধ্বংসপ্রায়। দোতলা বাড়ির নড়বড়ে দরজা খুলে পড়ছে। বাড়িটির সামনে টিনের ঘর তুলে বসবাস করছে দুটি পরিবার। চন্দ্রাবতী সম্পর্কে জানতে চাইলে মধ্যবয়সী এক নারী খানিক বিরক্ত হয়েই জানান, এ ব্যাপারে কিছু জানেন না তিনি। শিবমন্দিরকে দাবি করেন ‘মঠ’ হিসেবে। শিবমন্দিরের সামনে বাংলাদেশ পুরাকীর্তি বিভাগের সাইনবোর্ড ঝোলানো থাকলেও কালের নীরব সাক্ষী এই পুরাকীর্তি যে ঠিকঠাক সংরক্ষিত হচ্ছে না, তা বেশ বোঝা গেল।

বন্ধুর সঙ্গে সেলফি
বন্ধুর সঙ্গে সেলফি

শিবমন্দিরের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে লালরঙা দালানের চন্দ্রাবতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭৬ সাল। বিদ্যালয়ের সামনের একচিলতে আঙিনায় কচি–কাঁচারা গোলাপি ইউনিফর্ম পরে জাতীয় সংগীত গাইছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আমি রওনা দিই বাড়ির উদ্দেশে।

চন্দ্রাবতীর বাড়ির পথে ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিলাম কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসে। স্টেশনে নেমে চল্লিশ টাকা রিকশাভাড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলাম কিশোরগঞ্জ সদরে। এরপর সেখান থেকেই দুবার অটো বদলে শেষমেশ যাওয়া হয় চন্দ্রাবতীর বাড়িতে। এতকাল আগের অজপাড়াগাঁয়ের এক রমণী হয়েও চন্দ্রাবতী কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন ভেবে বেশ গর্ব হলো। ফেরার পথে শিবমন্দিরের পোড়ামাটির নকশার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, ‘চন্দ্রাবতীর মায়া পৃথিবী যায়নি আজও ভুলে…’
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন