গবেষকেরা বলেন, ভ্রমণের মতো রোমাঞ্চে ভরা কার্যক্রমগুলো করার সময় অনেক ক্ষেত্রে অনেক বেশি হ্যাপি হরোমন নিঃসৃত হয়; এর মাত্রা বেশি হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই অভিযাত্রীরা অসতর্ক হয়ে পড়েন, যার ফলে ঘটে চরম দুর্ঘটনা।
গত দুই দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি মর্মান্তিক খবর ঘুরে বেড়াচ্ছে। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার ক্রিসতং পাহাড়, থানচির লিমান লিবলু এবং সাকাহাফং অভিযানে বের হওয়া ৩৩ জনের একটি ট্রেকিং দলের তিনজন সদস্য খরস্রোতা তৈনখাল পাড় হতে গিয়ে হঠাৎ নেমে আসা ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা হড়কা বানে ভেসে যান। তাঁদের মধ্যে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, একজন এখনো নিখোঁজ। এই ঘটনাটি শুধু দুর্ঘটনা নয়, বরং আমাদের ভ্রমণবোধের অভাব ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। ঠিক এক বছর আগেও এমন দুটি হৃদয়বিদারক সংবাদ আমাদের সামনে এসেছিল, বান্দরবানের সাইংপ্রা ঝরনায় পা পিছলে পড়ে একজন পর্যটকের মৃত্যু এবং কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হাওড়ে ঘুরতে গিয়ে নৌকা থেকে পড়ে এক তরুণের করুণ মৃত্যু।
দুঃখজনক ও চিন্তার বিষয় হলো, গতবছর বান্দরবানে সাইংপ্রা ঝরনায় মৃত্যুবরণকারী রাফির নামে ফেসবুকে ‘ট্রেক উইথ রাফি’ নামে একটি ভ্রমণ গ্রুপ তৈরি করা হয়। এবং বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। তবে বেশ কয়েক মাস আগে গ্রুপটির নাম পাল্টে রাখা হয় ‘ট্যুর এক্সপার্ট’। গ্রুপটি পরিচালনা করেন রাফির স্ত্রী বর্ষা। যে গ্রুপ থেকেই ৩৩ জনকে নিয়ে বৃষ্টিভেজা পাহাড়ে ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। শেষ পর্যন্ত এই ভ্রমণের পরিণতি হয় তিনটি অকাল মৃত্যু।
আমরা যারা পাহাড় ভালোবাসি, প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই, তারা নিশ্চয়ই জানি-বর্ষাকালে পাহাড়ি পরিবেশ কতটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে হঠাৎ সৃষ্ট কিউমুলোনিম্বাস মেঘের কারণে প্রবল বর্ষণে তৈরি হয় ভয়াবহ ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা হড়কা বান। এমন পরিস্থিতিতে নদীগুলোর পানি আচমকা বেড়ে যায়, তৈরি হয় প্রবল স্রোত। পাশাপাশি, পাথরে জমে থাকা শেওলা পিচ্ছিল হয়ে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
এই মৌসুমে আমি নিজেও গিয়েছিলাম মিরসরাইয়ের বারৈয়াডালা জাতীয় উদ্যানের কমলদহ ট্রেইলে। সেখানে দেখেছি কী ভয়ানক হয়ে ওঠে পাহাড়ি ঝিরিপথ, কীভাবে ছোট্ট ভুল একেবারে প্রাণঘাতী হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সচেতনতার বিকল্প নেই। বর্ষাকালে পাহাড়ে না যাওয়াই ভালো। যদি যেতেই হয় বিশেষ ভাবে মনোযোগ দিতে হবে বেশ কয়েকটি বিষয়ে।
· অভিজ্ঞ ট্রাভেল গাইড।
· পাহাড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত থাকা।
· আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে যথাযথ ধারণা নেওয়া।
কোনো একটি গ্রুপের নামের শেষে “এক্সপার্ট” লেখা থাকলেই তারা প্রকৃতপক্ষে নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করবে এমন নাও হতে পারে। প্রকৃতি কখন কীভাবে রূপ বদলায়, তা কেবল অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত গাইডরাই বুঝতে পারেন।
এসব দুর্গম অঞ্চলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবা পাওয়া সম্ভব নয়। একইভাবে সাঁতার জানেন বা না জানেন লাইফ জ্যাকেট ছাড়া যেকোনো হাওড় বা জলপ্রবণ এলাকায় এ সময় ভ্রমণ জীবনসংশয়ের কারণ হতে পারে। এমনিতেই ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢলে আবারও নদ–নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে, সে কারণে এই মুহূর্তে নৌভ্রমণ অনুচিত। অনেক সময় দেখা যায়, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায়, বিশেষত ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের সময় একদল অত্যুৎসাহী অভিযাত্রী চলে যান উপকূলীয় অঞ্চল কিংবা কক্সবাজারে। এই প্রবণতা আসলেই বিপজ্জনক। এই সময় স্থানীয় ব্যক্তিরাই থাকেন নানা সংকটে। ফলে সব সময় সাহায্যও পাওয়া যায় না।
এখানকার ঝরনাগুলোয় এখন প্রচুর ফ্ল্যাশ ফ্লাডের কারণে বিপজ্জনক হয়ে আছে। এমনিতেই দুর্গম, তার ওপরে শেওলা জমা পিচ্ছিল পাথরে পা হড়কে পড়ে গতকালই একজনের মৃত্যু হয়েছে। বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দির হামহাম বা চিতা জলপ্রপাত। অনেক ঝিরিপথ থাকার জন্য একে বলা যায় জোকের স্বর্গরাজ্য। সেই সঙ্গে জিরির পানিতে হচ্ছে ফ্ল্যাশ ফ্লাড। তাই এ সময় এখানে ভ্রমণ না করাই শ্রেয়।
এখানে ছোট–বড় বেশ কিছু ঝরনা আছে। ফ্ল্যাশ ফ্লাডের কারণে পাথর আর পাহাড়ি টিলা বেশ পিচ্ছিল হয়ে আছে, তাই এখানে এখন ভ্রমণ না করাই ভালো।
এমনিতেই রয়েছে পাহাড়ি নদী, সেই সঙ্গে এখানে নেটওয়ার্ক না থাকায় এই দুর্গম এলাকায় অত্যুৎসাহী হয়ে এই সময় না যাওয়াই শ্রেয়।
এসব জায়গায় এই মুহূর্তে পাহাড়ি ঢলে অনেক পানি। গভীরতা বেশি। এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তাই ভ্রমণ করা উচিত নয়; বরং আবহাওয়া স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই শ্রেয়। জলপ্রবণ স্থান ও পাহাড়ে ভ্রমণ এড়িয়ে চলুন। নচেৎ যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করুন। বেঁচে থাকলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করতে পারবেন। কিছু পর্যটন স্থানে তাই আপাতত না গিয়ে অন্য কোনো কাজে নিজেকে নিয়োজিত করাই হবে উত্তম।
যেহেতু পানি অনেক বেশি, তাই এই মুহূর্তে না যাওয়াই ভালো এবং গেলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেটসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করে তারপরই যেতে হবে।
ছবি: লেখক