পুরোনো ঢাকায় ওয়ারীর র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে নামলাম। সবাই নিশ্চয়ই জানেন ওয়ারীকে একসময় বলা হতো ঢাকার সবচেয়ে পরিকল্পিত নগরী। শহরের মধে৵ ভিন্ন আরেকটি শহর ছিল পুরোনো ঢাকার ওয়ারী। খুঁজছি আসলে ৩৮ নম্বর র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের একটি বাড়ি। নাম ধল্লা হাউস। আশপাশে তাকিয়ে দু–একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ধল্লা হাউস কোন দিকে! সবাই না–বোধক উত্তর দিলেন।
পথের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ভাবছি, কী করা যায়। মনে মনে একজন বয়স্ক পথচারী খুঁজছি, যাকে জিজ্ঞাসা করব। আমার এই পদ্ধতি বেশ কাজে লেগেছে বাংলাদেশে যেকোনো অঞ্চলে স্থাপনা খুঁজে পেতে। অবশেষে পথের উল্টো পাশে চায়ের দোকানে একজন ষাটোর্ধ্ব চাচাকে দেখতে পেলাম। মোবাইলে ধল্লা হাউসের ছবি দেখলাম গুগল থেকে ডাউনলোড করা। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘সোজা গিয়ে ডান দিকে।’
৩৮, র্যাঙ্কিন স্ট্রিট পেলাম। গেটে লেখা রয়েছে—জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, আবাসিক ভবন। বুঝতে অসুবিধা হলো না, এটি এখন একটি সরকারি বাসভবন। লাল ইটের মোগল ও ব্রিটিশ নকশার মিশেলে তৈরি ধল্লা হাউস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের কথা মনে করিয়ে দেয়। শুনেছি, ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার এ বাড়িকে ‘টেক্সট বুক ভবন’ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।
গেট খোলাই ছিল। ঢুকলাম মৃদুপায়ে। অল্প দূরেই দ্বিতল লালরঙা বাসভবন। একজন জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবেন? বললাম, বাড়িটা দেখতে এসেছি। উনি অন্য কিছু বলার আগে নিজেই বলে ফেললাম, আমি জানি, এখানে পরিবার–পরিজন আছে। আমি কোনো রুমে ঢুকব না। বারান্দা আর খালি জায়গায় ছবি তুলব আর ভিডিও করব। ভদ্রলোক নিমরাজি অবস্থায় সায় দিলেন। আমি অপেক্ষা না করে দ্রুত লাল স্থাপনার দিকে পা বাড়ালাম। ভদ্রলোক বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগলেন। আমি বিশেষ পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। আগের অনেক অভিজ্ঞতা থেকে এগুলো শিখেছি। নিজের কাজ করে বের হতে হবে, তাতে সামনের পক্ষ রাজি থাকুক আর না থাকুক।
পাঁচ–ছয়টি সিঁড়ি ভেঙে নিচতলার বারান্দায় গেলাম। ২০ শতকের বাড়ির পুরোনো ফ্লোর দেখে স্মিত হাসি দিলাম নিজেকেই। তারপর চোখ পড়ল দোতলায় যাওয়ার সিঁড়িতে। এবার দাঁত বের করা হাসি দিলাম। কাঠের সিঁড়ির হাতলগুলোতে দারুণ কারুকাজ করা। পাটাতনগুলো পাথরের। কাঠের সিঁড়ি। ঢাকায় আরও কয়েকটি বনেদি ভবনে কাঠের সিঁড়ি আছে— পোগোজ স্কুল, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, বর্ধমান হাউস ও কার্জন হল। এগুলোর মধে৵ বাফা মানে বুলবুল ললিতকলা একাডেমির সিঁড়িটি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ধল্লা হাউসকে কেউ কেউ ধলা জমিদার বাড়িও বলেন।
সিঁড়ির হাতলগুলো বেশ খানিকটা ক্ষয়ে গেছে। যত্নের অভাব। নানাজন নানাভাবে, মানে বলতে চাইছি অসতর্কভাবে ব্যবহার করে। আর এর বয়স এক শর কম হওয়ার কথা নয়। নির্মাণকাল জানা নেই। ধলা জমিদারবাড়ি সম্পর্কে আর কোনো তথ্য জানা নেই। কে ছিলেন এই ধলা জমিদার? কোথা থেকে এলেন? কেন তাঁর নাম ধলা ইত্যাদি প্রশ্ন মনে রয়েছে; কিন্তু উত্তর জানা নেই। তবে দ্বিতল ভবনটি দেখে আমার এটিকে অভিজাত বণিকের বাড়ি বলে মনে হচ্ছে।
কাজ করতে করতে গেট থেকে বারবার আমাকে ডাকছিলেন কর্তব্যরত গার্ড। গার্ড কিনা আমি জানি না। হয়তো কেয়ারটেকারও হতে পারেন। তাঁর ভাষ্য, সরকার কিনে নিয়েছে ভবনটি। এটি এখন সরকারি ভবন। তাহলে এত বিধিনিষেধ কেন বুঝতে পারলাম না। আর এটি কোনো অফিস নয়, আবাসন? এদের আবাসনে কি মেহমান বেড়াতে আসে না! আমি কোনো রুমেও ঢুকছি না। খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে কাজ করছি। অসুবিধা কোথায় বুঝতে পারলাম না।
চারদিকের হাবভাব দেখে আমার মনে হলো, এখানে যাঁরা বসবাস করছেন, তাঁরা সাবলেট হিসেবে কাউকে কাউকে ভাড়া দিয়েছেন। এটি পুরোটাই আমার ধারণা, সেখানে বসবাসকারী কারও সঙ্গে আমার এ বিষয়ে কথা হয়নি। তবে আমার কাজ ওয়াচ করা হচ্ছিল—এটি পুরোপুরি আমি বুঝতে পারছিলাম।
বের হওয়ার সময় একটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে আমি কথা বলার চেষ্টা করছিলাম। ঠিক কথা বলার জন্য নয়, শুধু কুশল বিনিময়। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, গেট থেকে লোকটি দ্রুত পায়ে হেঁটে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারপর সে আর অপেক্ষা না করে বলে বসলেন, ‘আপা, অনেক কাজ করেছেন, এবার যান। বাইরের লোক আসবার অনুমতি নেই।’ আমি গেট থেকে বের হওয়ার পরপরই গেট ভেতর থেকে লাগানোর শব্দ পেলাম।
ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত এলাকা ওয়ারীর পেছনের কথা একটু বলি। ব্রিটিশ সরকার ১৮৮০ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের কথা ভেবে ৭০১ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে ওয়ারীতে। প্রতিটি প্লটের জন্য জমি নির্ধারিত হয় ১ বিঘা। তাহলে সেই হিসাবে ধল্লা হাউস চত্বরের আয়তন ১ বিঘা হওয়ার কথা। প্রতিটি রাস্তা নাকি ৩০ ফুট প্রশস্ত ছিল। এখন দেখে বোঝার জো নেই। জমি বরাদ্দ দেওয়ার সময় ব্রিটিশ সরকার শর্ত দেয়, তিন বছরের মধ্যে পাকা বাড়ি তুলতে হবে। ১৮৮৪ সালের পর অল্প সময়েই একটি পরিকল্পিত এক নগর হিসেবে গড়ে উঠেছিল ওয়ারী। ঢাকার ইংরেজ কর্মকর্তাদের নামানুসারে ওয়ারীর রাস্তাগুলোর নাম রাখা হয় র্যাঙ্কিন স্ট্রিট, লারমিনি স্ট্রিট, ওয়্যার স্ট্রিট বা হেয়ার স্ট্রিট।
ওয়ারীর নামকরণ নিয়ে দুই ধরনের ইতিহাস প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলেন, তৎকালীন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়্যারের নাম থেকে ওয়ারী নাম হয়েছে। আবার কেউ বলেন, ওয়ারী একটি ফারসি শব্দ যার অর্থ বড় তাঁবু। মোগল আমলে এখানে সেনানিবাস ছিল। বড় বড় তাঁবুতেই মোগল সেনারা বসবাস করতেন। নামটি সেখান থেকেই এসেছে ।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এটি অভিজাত এলাকা হয়ে ওঠে। বাইরে বেরিয়ে ধলা জমিদারি সম্পর্কে তথ্য খোঁজার চেষ্টা করলাম; কিন্তু পেলাম না। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ওয়ারীর মতো পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে এলাকা ঢাকায় আর দ্বিতীয়টি ছিল না।
সম্পাদক–সাংবাদিক আবুল হাসনাত স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘কত খ্যাতিমান ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষ জীবন অতিবাহিত করেছেন এই এলাকায়। সরকারি আমলা, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাজীবী, চিকিৎসক, অধ্যাপক আর অনেক সাংবাদিকের বাসস্থান ছিল সেখানে।
হেয়ার স্ট্রিটের ২ নম্বর বাড়িটায় শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ ও সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী থাকতেন। র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে থাকতেন অ্যাডভোকেট সবিতা রঞ্জন পাল, রাজনীতিবিদ শুধাংশু শেখর হালদার, বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য প্রমুখ। লারমিনি স্ট্রিটে চল্লিশের দশকে ছিলেন অমর্ত্য সেনরা।’
র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের ৩৭ নম্বর বাড়িটিও কিন্তু ঐতিহাসিক। সেই গল্প অন্য সময় বলব।
ছবি: লেখক