মনোমুগ্ধকর নির্মানশৈলীতে কালের সাক্ষী হয়ে আছে ঢাকা নগরীর এই ৫ মসজিদ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

মোগল আমল থেকে ইন্দো-ইসলামিক রীতিতে মসজিদ নির্মাণ বাড়তে থাকে ঢাকায়। ‘মসজিদের শহর’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে সংখ্যাধিক্যের কারণে। মূলত মোগল আমল থেকেই মসজিদের নগরীতে পরিণত হয় এই শহর। পরবর্তী সময়ে ১৯ শতকে পাকিস্তান আমলে মসজিদের নির্মাণ আরও বাড়ে। ঢাকায় ৭০০ বছরের পুরোনো মসজিদ যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে নবনির্মিত অনেক মসজিদও। ছোট–বড় মসজিদের ভিড়ে এখনো সৌন্দর্যের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে প্রাচীন মসজিদগুলো। ছুটির দিনে চলে যাওয়া যেতে পারে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন এসব শতবর্ষী মসজিদে।

বিজ্ঞাপন

বিনাত বিবির মসজিদ

পুরান ঢাকায় অবস্থিত মধ্যযুগীয় এ মসজিদটি ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো মুসলিম স্থাপনার নিদর্শন হিসেবে অনুমিত। নারিন্দার যে প্রাচীন পুলের পাশে মসজিদটি অবস্থিত, তার নাম হায়াত ব্যাপারীর পুল। মসজিদটির নির্মাতা মরহুম আরকান আলী সওদাগর। ব্যবসার প্রয়োজনে তিনি ঢাকার ধোলাইখালে আসেন সপরিবার। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল ‘মারহামা’ ও কন্যার নাম ‘বখত বিন বিবি’। হুট করে অসুস্থ হয়ে তাঁর কন্যার মৃত্যু হয়। এরপর তাঁরা এখানেই স্থায়ী হয়ে যান এবং নির্মাণ করেন এই মসজিদ। তাঁদের কবর মসজিদের পাশেই রয়েছে। দেয়ালে থাকা শিলালিপি অনুসারে ৮৬১ হিজরি সালে অর্থাৎ ১৪৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার স্বাধীন সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে এটি নির্মিত হয়।

মসজিদের ভেতরের অংশ
মসজিদের ভেতরের অংশ

ঢাকায় প্রাপ্ত শিলালিপির মধ্যে এটি প্রথম মুসলিপ শিলালিপি বলে ধারণা করা হয়। প্রথমে এখানে একটি গম্বুজ ছিল, পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় গম্বুজটি নির্মাণ করা হয়। প্রথম গম্বুজ নির্মাণের ১৫০ বছর পর দ্বিতীয় গম্বুজ নির্মাণ করা হয়; তারপর দুই গম্বুজের মাঝখানে নির্মাণ করা হয় মেহরান। মসজিদের ভেতরে প্রাচীন স্থাপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। পাশেই রয়েছে বর্ধিত নতুন অংশ, যেখানে আছে ২৩তলা সমান মিনার। বিগত ৬০০ বছরে বহু মানুষ এখানে নামাজ পড়েছেন যার সাক্ষী হয়ে আছে সুপ্রাচীন এই মসজিদ।

বিজ্ঞাপন

চকবাজার শাহি মসজিদ

চকবাজার শাহী মসজিদের ভিতরে। এই মসজিদ ৪০০ বছরের পুরোনো
চকবাজার শাহী মসজিদের ভিতরে। এই মসজিদ ৪০০ বছরের পুরোনো

পুরান ঢাকার চকবাজারে অবস্থিত মোগল আমলের মসজিদ, যা 8০০ বছরের পুরোনো। মসজিদের ভেতরে একটি শিলালিপিতে ফার্সিতে লেখা রয়েছে মোগল সুবেদার শায়েস্তা খান এটিকে ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেন। তিনটি গম্বুজ আর বিশাল মিনার এ মসজিদের মূল আকর্ষণ। চকবাজারের কেন্দ্রস্থল চক সার্কুলার রোডে এর অবস্থান। মোগল  আমলের মসজিদগুলো মাটি থেকে উঁচু প্ল্যাটফর্মে নির্মাণ করা হতো। চক মসজিদটি মাটি থেকে ১০ ফুট উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্মিত। ঢাকার প্রাচীন ইমারতের মধ্যে এটি সবচেয়ে উঁচু বলে ধারণা করা হয়।

নির্মাণের পর এর আয়তন ছিল আড়াই হাজার বর্গফুট। নির্মাণের সময় এর তিনটি গম্বুজ ছিল। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার এর সংস্কার হয়। মূল কাঠামোটি রেখে এর আয়তন বেড়ে এখন ১০ হাজার বর্গফুট। এর সঙ্গে সংযুক্ত মিনারটি ছিল ৭০ ফুট। ১৯৮০ সালে সংস্কারে বর্ধিত করে করা হয় ১২০ ফুট। মোগল ও ইসলামি শাসনামলে নায়েবে নাজিমরা এখানে নামাজ পড়তেন। সে সময় ঈদের প্রধান জামাত হতো এই মসজিদে। ঈদের চাঁদ দেখা গেলে এই মসজিদের সামনে থেকে তোপধ্বনি দেওয়া হতো। প্রাচীন এই মসজিদ দেখতে দেশের বাইরে থেকে অনেকেই আসেন।

কর্তালাব খান মসজিদ

পুরোনো জেলখানার পাশে অবস্থিত এ মসজিদটিই  কর্তালাব খান মসজিদ
পুরোনো জেলখানার পাশে অবস্থিত এ মসজিদটিই কর্তালাব খান মসজিদ

পুরান ঢাকার বেগম বাজারে পুরোনো জেলখানার পাশে অবস্থিত এ মসজিদটি বেগম বাজার মসজিদ নামেও পরিচিত। ১৭০১ থেকে ১৭০৪ সালের মধ্যে নির্মিত এই মসজিদ তৎকালীন দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খানের নামে করা হয়। মুর্শিদকুলি খান কর্তালাব খান নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ঢাকার সুবেদার থাকাকালে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। পাঁচ গম্বুজের দোতলা মসজিদ এটি। মসজিদের উপরি ভাগে রয়েছে কারুকার্যময় ছোট ছোট মিনার। মসজিদের উত্তর দিকের সিঁড়ি দিয়ে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে, নকশা করা পাঁচটি কাঠের দরজা। মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে পাঁচটি মেহরাব। মসজিদটি বর্তমানে খানিকটা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ৩০০ বছরের বেশি পুরানো এই মসজিদের নির্মাণশৈলী নান্দনিকতা মুগ্ধ করে সবাইকে।

তারা মসজিদ

তারা মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ঢাকার জমিদার মির্জা গোলাম পীর
তারা মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ঢাকার জমিদার মির্জা গোলাম পীর

মোগল স্থাপত্যশিল্পের ঐতিহ্য ধারণ করে পুরান ঢাকায় নির্মাণ করা হয় তারা মসজিদ। খ্রিষ্টীয় আঠারো শতকে ঢাকার জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান) এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তারা মসজিদের আরও কিছু প্রচলিত নাম আছে; যেমন মির্জা গোলাম পীরের মসজিদ বা সিতারা মসজিদ। মসজিদটির অবস্থান পুরান ঢাকার আরমানিটোলায়, ৬/৩ আবুল খয়রাত রোডে। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। পরে ১৯২৬ সালে ঢাকার ব্যবসায়ী আলী জান ব্যাপারী মসজিদটির সংস্কার করেন।

তারা মসজিদের ভিতরে
তারা মসজিদের ভিতরে

মির্জা গোলামের সময় মসজিদটি ছিল তিন গম্বুজওয়ালা; এর দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট আর প্রস্থ ১২ ফুট। আলী জানের সংস্কারের সময়, ১৯২৬ সালে, মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বারান্দা বাড়ানো হয়। ১৯৮৭ সালে তিন গম্বুজ থেকে পাঁচ গম্বুজ করা হয়। পুরোনো একটি মেহরাব ভেঙে দুটি গম্বুজ আর তিনটি নতুন মেহরাব বানানো হয়। ১৭০০ শতকে দিল্লি, আগ্রা ও লাহোরে নির্মিত মোগল স্থাপত্যশৈলী অনুসরণে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদের কোথাও এটি তৈরির সময় উল্লেখ নেই বলে  কবে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়, তার সুস্পষ্ট কোনো নথি পাওয়া যায়নি। তবে মসজিদটি তৈরির পর ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে মির্জা গোলাম পীর মৃত্যুবরণ করেন।

মুসা খান মসজিদ

মুসা খাঁর মসজিদ
মুসা খাঁর মসজিদ

মুসা খানের মসজিদ বা মুসা খাঁর মসজিদ ঢাকা শহরে অবস্থিত মোগল স্থাপত্য অনুসরণে নির্মিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের উত্তর-পশ্চিম কোণে এর অবস্থান। সেই আমলে শহীদুল্লাহ হল এলাকাটি বাগ-ই-মুসা খাঁ বা মুসা খাঁর বাগান নামে পরিচিত ছিল। তিনি ছিলেন বাংলার বারভূঁইয়ার অন্যতম ঈসা খাঁর পুত্র। মসজিদের পাশেই আছে তাঁর কবর। জনশ্রুতি অনুযায়ী সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে মুসা খানের পুত্র মাসুম খান মসজিদটি নির্মাণ করেন। এই মসজিদ তিন গম্বুজবিশিষ্ট।

মসজিদের পাশে এই কবরটি মুসা খাঁর।
মসজিদের পাশে এই কবরটি মুসা খাঁর।

মসজিদের সামনের দিকের খোপ সদৃশ দরজা ও নকশা করা। উপরিভাগে আছে অষ্ট কোনাকার পিলারের ওপর স্কন্ধ আকৃতির গম্বুজ ও অতিরিক্ত মিনার, যার সংখ্যা ১৬। প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্মিত মসজিদের নিচের অংশে বেশ কিছু কক্ষ আছে, যেগুলোতে আগে মসজিদের লোকজন থাকত; এগুলো বর্তমানে পরিত্যক্ত। ঢাকা শহরে বিনত বিবির মসজিদের পাশাপাশি এটি প্রাক্‌-মুঘল স্থাপত্যের একটি নিদর্শন। উঁচু প্ল্যাটফর্মের বেদির উপরে ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ আছে। পূর্ব দিকে রয়েছে খোলা বারান্দা। সেখানে পাঁচটি খিলান দরজা রয়েছে। পশ্চিমের দেয়ালে রয়েছে তিনটি মেহরাব। ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীর এই মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

ছবি: উইকিপিডিয়া

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ২৩: ০০
বিজ্ঞাপন