বাংলাদেশের ঐশ্বর্য সন্ধান ১১: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত তেরশ্রী এস্টেট
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ঈদুল আজহার সকাল।
বলার অপেক্ষা রাখে না রাস্তা অবশ্যই ফাঁকা। আমরা ঈদ ঐতিহ্য ভ্রমণ পালনে বের হয়েছি। এই যাত্রা অব্যাহত আছে ৬ বছর ধরে। পরিবার নিয়ে ঈদের সকালে বেরিয়ে পড়ি কোনো না কোনো ঐতিহাসিক স্থানে। মূলত আমার ছেলেকে দেশের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই দুই ঈদের ফাঁকা রাজপথ কাজে লাগাই।
আমার ছেলে এখন পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে আছে। তবে পরিবারের সঙ্গে আমি নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখি, যেন একই দিনে ফিরে আসতে পারি। বিষয়টি এ রকম—রাজধানী থেকে খুব দূরেও নয়, আবার খুব কাছেও নয়।

প্রবেশ দুয়ারের ক্ষয়ে যাওয়া নকশা
প্রবেশ দুয়ারের ক্ষয়ে যাওয়া নকশা

এবার বেছে নিয়েছি মানিকগঞ্জের ঘিওর এলাকা। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। ঘিওর এত দূরে কেন মনে হচ্ছে! চারপাশে তাকিয়ে দেখি প্রকৃতি কী দারুণ সবুজ। ধলেশ্বরী নদী, কালীগঙ্গা নদী পার হলাম। নদী পার হলাম মানে নদীর ওপর তৈরি ব্রিজ পার হলাম। কালীগঙ্গা নদীর ওপর যে ব্রিজ রয়েছে, সেটির নাম তরা ব্রিজ। এ জন্য আমি যখন কালীগঙ্গা ব্রিজ খুঁজছিলাম স্থানীয়রা চিনতে পারছিলেন না।

বিজ্ঞাপন

কালীগঙ্গা নদী থেকে খুব বেশি দূরে নয় তেরশ্রী গ্রাম। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের কাছে তেরশ্রী গ্রাম অবশ্যই পরিচিত। কারণ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা এই গ্রামের ৪৩ জনকে হত্যা করে। তেরশ্রী গ্রামে প্রবেশ করতেই ১৯৭১–এর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি দৃষ্টিগোচর হবে। পথের একপাশে রয়েছে শতবর্ষী তেরশ্রী কালী নারায়ণ ইনস্টিটিউট, অন্যপাশে একাত্তর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ
পিতা ও পুত্রের ছবি
পিতা ও পুত্রের ছবি

স্কুলের পাশ দিয়ে একটি সরু পথ গেছে। এটিই গ্রামে প্রবেশের একমাত্র পথ। কিছুদূর গেলে তেরশ্রী বাজার। বাজার পেরিয়ে একটি বড় দিঘি। দিঘির পাশ ধরে গেলেই পাওয়া যাবে বাড়িটি। আশপাশে জনবসতি গড়ে উঠেছে। তবে দূর থেকে একটি বনেদি বাড়ির প্রবেশদ্বারের ভগ্নাংশই বলে দিচ্ছে এটিই তেরশ্রী এস্টেট।

বিজ্ঞাপন

কাছে গিয়ে মনটা দমে গেল। কেবল দুয়ারের একটি অংশই টিকে আছে। আসলে মূল প্রবেশদুয়ার ছিল নাকি জানি না। আর্চ আর মাঝে একটি লোগো দেখে অনুমান করছি হয়তো মূল প্রবেশদুয়ার, অন্দরমহলের প্রবেশদ্বার কিংবা কাছারিঘরের দ্বার ছিল।
লোগোটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম অক্ষরগুলো। কার নাম লেখা আছে বোঝার চেষ্টা করলাম। তিনিই নিশ্চয় এই এস্টেটের গোড়াপত্তনকারী। লোগোতে অক্ষরগুলো মনে হয় উদ্ধার করতে পেরেছি। S P R C; কিন্তু পুরো নাম কী হবে? এমন সময় পেছনে এসে একজন নারী সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি জমিদারবাড়ির আত্মীয়?’

মন্দিরের পাশেই জমিদারদের বংশধরের আধুনিক বসতবাড়ি
মন্দিরের পাশেই জমিদারদের বংশধরের আধুনিক বসতবাড়ি

—জি না, আপু।
আমি ঈদের দিন এখানে আসার কারণ ব্যাখ্যা করলাম। আপুর নাম রানু। এখানকার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। জমিদারবাড়ির প্রতিবেশী। রানু আপুকে লোগোর অর্থ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি না–বোধক উত্তর দিলেন। এই গেটটি ছাড়া আর কিছু নেই? তিনি আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন একটু দূরে। সেখানে একটি আধুনিক বাড়ি আর বাড়ির একপাশে পুরোনো বনেদি বাড়ির আধভাঙা অংশ। রানু আপু বললেন, এটি মন্দির।

জমিদারের বংশধরেরা এই বাড়িতে থাকেন। আজ তালাবদ্ধ। ছুটিতে বেড়াতে গেছেন হয়তো। মন্দিরের যে অংশটুকু টিকে রয়েছে, সেটুকুও খুব বেশি ভালো অবস্থায় নেই।
আমি মন্দিরে কাজ করছি এমন সময় রানু আপা তাঁর কর্তাকে নিয়ে এলেন কথা বলার জন্য। ফারুক ভাই আমাকে বেশ কিছু তথ্য দিলেন এই জমিদারবাড়ি সম্পর্কে।

তেরশ্রী এস্টেট এর লোগোটি দেখছেন লেখক
তেরশ্রী এস্টেট এর লোগোটি দেখছেন লেখক

লোগোর কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন ভাঙা দুয়ারের কাছে। সেখানে লেখা আছে সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী। আমি এস পি আর সি আদ্যক্ষর সঠিক অনুমান করেছিলাম। এই জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা রামরতন রায় চৌধুরী। তেরশ্রী এস্টেটের পঞ্চম উত্তরসূরি সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী। বর্তমান উত্তরসূরি সোমেশ্বর প্রসাদ রায় চৌধুরী এখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন।

তেরশ্রী এস্টেটের বংশলতিকা দাঁড় করালে এ রকম হয়: রামরতন রায় চৌধুরী—নরনারায়ণ রায় চৌধুরী—হরনারায়ণ রায় চৌধুরী—কালী নারায়ণ রায় চৌধুরী—সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী—সোমেশ্বর প্রসাদ রায় চৌধুরী। মনে পড়ল তেরশ্রী গ্রামে প্রবেশমুখে শতবর্ষী তেরশ্রী কালী নারায়ণ ইনস্টিটিউট দেখেছিলাম। প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২২। বোঝা গেল প্রতিষ্ঠানটি এই জমিদারবাড়িরই অবদান। মানিকগঞ্জের প্রথম কলেজ ‘তেরশ্রী কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী ১৯৪২ সালে।

শতবছরের স্কুল
শতবছরের স্কুল

স্থানীয় লোকজন বলেছেন, এই জমিদারেরা ছিলেন শৌখিন ও রুচিশীল মানুষ। প্রজাহিতৈষী কাজ করতেন। জনবিচ্ছিন্ন শাসক ছিলেন না তাঁরা। বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনিও ছিলেন ৮টি ভাষায় সুপণ্ডিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। তিনি ঢাকার জাতীয় জাদুঘর ও বাংলা একাডেমিতে দুষ্প্রাপ্য বই, অর্থ ও রাজকীয় সরঞ্জাম দান করেন। প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয়, ডাকঘর, তেরশ্রী বাজারসহ বহু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী।

তেরশ্রী এস্টেটের টিকে আছে দুটি দিঘি, একটি আধভাঙা প্রবেশদুয়ার ও মন্দির। আর জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠিত স্কুল। কালীগঙ্গা নদীর পাড়ে ছায়াঘেরা ঐশ্বর্যমণ্ডিত গ্রাম তেরশ্রী। এর রয়েছে গৌরবময় অতীত ঐতিহ্য। এই গ্রামের কয়েক শতাব্দীর স্মৃতির ধারক তেরশ্রী এস্টেট। সময়ের পরিক্রমায় ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

জমিদার বাড়ির টিকে থাকা একমাত্র মন্দির প্রাঙ্গণে লেখক
জমিদার বাড়ির টিকে থাকা একমাত্র মন্দির প্রাঙ্গণে লেখক

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশে যে কয়েকটি বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার অন্যতম মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামের গণহত্যা। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা আক্রমণ চালায় জেলার প্রগতিশীল মানুষের আশ্রয়স্থল তেরশ্রী গ্রামে। গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং তেরশ্রী এস্টেটের সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান, কে এন ইনস্টিটিউশনের দপ্তরি মাখন লালসহ ৪৩ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি গ্রামের প্রবেশমুখে দেখেছি।

আমাদের ঢাকায় ফিরে যাবার সময় হলো। বিদায় নিলাম রানু আপু ও ফারুক ভাইয়ের কাছ থেকে। অল্প সময়ে তাঁদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছে। অথচ এক দিন আগেও কেউ কাউকে চিনতাম না। ভ্রমণ আমাকে এ রকম হাজার হাজার মানবিক সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছে দেশজুড়ে, অনেক সময় দেশের সীমানা পেরিয়েও।

জমিদার বাড়ির প্রতিবেশী রানু আপু
জমিদার বাড়ির প্রতিবেশী রানু আপু

তেরশ্রী এস্টেটের এতসব তথ্য জানিয়েছেন ফারুক ভাই ও তেরশ্রী কালী নারায়ণ ইনস্টিটিউটের এক শ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত একটি স্মারকগ্রন্থ শতযোগ। রানু আপু আমাকে উপহার দিয়েছেন বইটি।

ফেরার পথে কালীগঙ্গায় সুর্যাস্ত
ফেরার পথে কালীগঙ্গায় সুর্যাস্ত

ফেরার সময় খানিক দাঁড়ালাম কালীগঙ্গা নদীর পাড়ে সূর্যাস্ত দেখার জন্য। ফেরার পুরো সময়টা মাথায় ছিল তেরশ্রী এস্টেট। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিতে এক অনন্য পরিবার তেরশ্রী জমিদারবাড়ি।
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন