চট্টগ্রামের ব্যস্ত নগরীর প্রাণকেন্দ্র ষোলশহর। রেললাইনের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র যেন বিস্মৃত ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। প্রতিদিন শত শত ট্রেন ছুটে যায়, হাজারো মানুষ স্টেশন অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছান।
অথচ এই কোলাহলময় শহরের বুকেই দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক অতীতের ভান্ডার। গেট পেরোতেই মনে হয়, ইতিহাসের সরণি ধরে যেন ফিরে যাওয়া ৩০০ বছর আগের সময়ে! দুপুরের আলো-আঁধারিতে হঠাৎ গাছের পাতার ফাঁক গলে পড়ে রোদের কড়া আঁচ, তৈরি হয় রহস্যময় আবহ।
ঔপনিবেশিক আমল থেকেই চট্টগ্রাম ছিল বাণিজ্য ও সামরিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সেই সময়েই গড়ে ওঠে এই সমাধিক্ষেত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছে। চারপাশে ঝোপঝাড়, ভাঙা দেয়াল, অযত্ন-অবহেলা—সব মিলিয়ে হারাতে বসেছে জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
একটি সমাধিফলকে দৃষ্টি আটকে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগের এক হৃদয়স্পর্শী কাহিনি বহন করছে এটি। সমাধিটি মাত্র ১৬ মাস বয়সে মৃত্যুবরণ করা শিশু ক্ল্যারিসা স্টোনহাউসের। নামফলকের শিলালিপিতে খোদাই করা আছে—পিতা জন স্টোনহাউস ও মাতা সারাহ স্টোনহাউস। হয়তো তাঁরা এসেছিলেন ইংল্যান্ড থেকে, ব্যবসা বা চাকরিসূত্রে। অনুন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার কারণে সে সময়ে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ভয়াবহ। তাই এই সমাধি কেবল এক শিশুর নয়; বরং এক যুগের ইউরোপীয় অভিবাসীজীবনের দুঃখ ও সংগ্রামেরও নীরব সাক্ষ্য।
আরেকটি সমাধির কেন্দ্রে আছে উঁচু স্তম্ভাকৃতি ওবেলিস্ক, যা ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব বহন করছে। সাধারণত মর্যাদাপূর্ণ বা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য এ ধরনের সমাধিফলক ব্যবহৃত হতো। এটি হানাহ স্মিথ নামের এক নারীর সমাধি। যদিও তারিখ ও বয়স স্পষ্ট নয়, তবে এটি ঔপনিবেশিক বাংলায় ইউরোপীয় সমাজের অস্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়।
শেওলা জমে যাওয়া প্রাচীন শিলালিপি, পাশে ছোট-বড় নানা সমাধি—কোথাও সরল নকশা, কোথাও ক্রুশচিহ্ন বা স্তম্ভ দিয়ে সজ্জিত। ইউরোপীয় প্রভাব স্পষ্ট হলেও স্থানীয় পাথর ও কারিগরের ছোঁয়া রয়েছে প্রতিটি স্থাপত্যে।
সতেরো শতকে পর্তুগিজদের প্রতিষ্ঠিত এই প্রোটেস্টান্ট সিমেট্রির সবচেয়ে পুরোনো সমাধি পাওয়া যায় ১৭৭৪ সালে—জেমস রসের স্ত্রী হানাহ রস, যিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সে মারা যান!
এ ছাড়া রয়েছে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির কবর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের বন্ধু, চট্টগ্রামের চিফ কালেক্টর চার্লস ক্রফটসের দৃষ্টিনন্দন সমাধি (মৃত্যু: ১৭৮৬)। পাশাপাশি আছে সেই সময়ের পাদরি, টি-প্ল্যান্টার, নাবিক, সিভিল সার্জন, ব্যবসায়ী, সামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সমাধি—যা ফরেস্ট হিলের পাদদেশে শত শত বছর ধরে শান্তভাবে শায়িত।
পলাশীর যুদ্ধের আগে থেকে সিপাহী বিদ্রোহ, দুই বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, আমাদের স্বাধীনতা—ইতিহাসের পাতা যেন থমকে আছে এই সমাধিক্ষেত্রের নিস্তব্ধতায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত সৈনিকদেরও এখানে সমাহিত করা হয়েছিল। পরে তাঁদের দেহাবশেষ স্থানান্তরিত হয় ওয়ার সিমেট্রিতে। একসময় যে মহার্ঘ্য মার্বেল পাথরের এপিটাফগুলো প্রিয়জনদের স্মৃতিচিহ্ন বহন করত, সেগুলো চুরি হয়ে গেছে বহু আগেই। নতুন নামফলকগুলো তেমন প্রাচীন নয়।
বর্তমানে এখানকার একাংশ এখনো ব্যবহৃত হয়, তবে ব্যাপটিস্ট সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত পৃথক প্রবেশপথ দখলদারদের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয়দের মতে, একসময় এখানে নিয়মিত মানুষ আসতেন, প্রার্থনা করতেন, ইতিহাস খুঁজতেন। এখন তা সীমিত কয়েকজনেই। অনেক সমাধিস্তম্ভ ভেঙে পড়েছে, দেয়াল ক্ষয়ে গেছে কিংবা অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে।
ষোলশহর রেললাইনের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এই সমাধিক্ষেত্র কেবল মৃতদের আশ্রয়স্থল নয়, এটি আসলে এক জীবন্ত ঐতিহাসিক দলিল। যথাযথ সংরক্ষণ ও পরিচর্যা করা গেলে এটি হয়ে উঠতে পারে শহরের এক মূল্যবান ঐতিহ্য, যা বর্তমান প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেবে বিস্মৃত অতীতের সঙ্গে।
ছবি: কমল দাশ