শায়েস্তাগঞ্জে তখন ভোর আড়মোড়া ভাঙছে। হাইওয়ের পাশের চিলতে দোকানগুলো তখনো জেগে। এর মধ্যেই আমাদের ১১ জনের দল আধঘুম চোখে এসে নামল। সে এক বিচিত্র দৃশ্য! সবার পিঠে বড় ব্যাকপ্যাক, নিচে তাঁবু ঝুলছে, সঙ্গে ইনস্যুলেশন শিটের জোড়াবন্দী।
মাটি থেকে উঠে আসা মাঘের ঠান্ডা ঠেকাতে পাতলা ফয়েল মোড়ানো এই শিটটা ভারি কাজে দেয়। ঘরের আরামের বিছানা ছেড়ে মাটিতে শখ করে শুতে আসা মানুষগুলোর কাছে এর ভারি কদর আজ। আগামী রাত রেমা-কালেঙ্গার অভয়ারণ্যের এককোণে ক্যাম্পিং করে থাকার উদ্দেশ্যেই যে এসেছে সবাই!
পয়লা ফেব্রুয়ারি রাতের বাসে আমিও এই দলের সঙ্গেই রওনা দিলাম পোষা বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে। কোনো এক কালে সে–ও তো বুনোই ছিল, মানুষের প্রভাবে পোষা হয়ে গেছে টিকে থাকার চেষ্টায়।
ফেসবুকভিত্তিক অবাণিজ্যিক ভ্রমণগ্রুপ ট্রাভেলার্স উইন্ডোর এই ভ্রমণপিপাসু দলটির উদ্দেশ্য রেমা-কালেঙ্গার অভয়ারণ্য ঘুরে দেখা। এই বন নিয়ে কত যে কৌতূহল সবার। উইকিপিডিয়া বলছে, নির্বিচার গাছ চুরি ও বন ধ্বংসের পরেও যে কয়টি প্রাকৃতিক বনাঞ্চল এখনো কোনো রকম তার সন্তানদের নিয়ে টিকে আছে, তাদের মধ্যে সুন্দরবনের পরেই রেমা-কালেঙ্গার স্থান। কালেঙ্গা, রেমা আর ছনবাড়ী বিট নিয়ে তৈরি বনটির মূল প্রবেশপথ কালেঙ্গাবাজার হলেও আমাদের লক্ষ্য রেমা দিয়ে প্রবেশ করা। ওই দিকে প্রকৃতি এখনো সবুজ, পথেঘাটে শখের ট্যুরিস্টদের ছড়িয়ে আসা পলিথিনের পরিমাণও তুলনামূলকভাবে এখনো কম।
লগি-ঠেলা বোটে দাঁড়িয়ে, খোয়াই নদ পার হয়ে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। পাড়ের আঁকাবাঁকা পথ হারিয়ে গেছে জনপদে, দুই পাশে ধানখেত। ধান কাটা হয়ে গেছে, শুকনা খড়ের দল বিছিয়ে আছে মাঠজুড়ে। পথের দুই পাশে না-জানি কত বছরের পুরোনো গাছেরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এখনো। সেখানেই দেখা মিলল এক জোড়া শকুনের। কিছুটা আকাঙ্ক্ষিতই ছিল বলা চলে। কারণ, এই বনাঞ্চল শকুনের জন্য নিরাপদ বলে ইতিমধ্যেই ঘোষিত। পথ মাড়িয়ে, জনপদ পেরিয়ে অবশেষে বনের প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম সবাই।
সে এক গভীর রহস্যে মোড়া পৃথিবী যেন! নানা জাতের, উচ্চতার আর রঙের গাছের দল দাঁড়িয়ে আছে জড়াজড়ি করে, বাকলগুলো তাদের কুরে খেয়েছে উইপোকারা, সারা শরীর মুড়ে রয়েছে মাটির রেখায়। তবু তাদের কী অদ্ভুত প্রাণশক্তি। ডালগুলো যেন আকাশের পানে হাত বাড়িয়ে উঠেই চলেছে ওপরে। চোখের সীমানার বাইরে পাতাগুলো যেন খসখস করে নিজেদের সঙ্গে কথা বলে চলেছে আনমনে। কিছু গাছের শরীর বেয়ে ঝুলে আছে পুরোনো লতার বেণি।
মানুষ আর বুনো পশুর পায়ে চলা পথ ঢেকে আছে লাল, বাদামি সবুজ রঙের পাতার কার্পেটে। একটু পরেই দেখা মেলে সোঁদা-গন্ধ-জল ভাসা চিকন খালের। পাড়ের কাদামাটিতে আমাদের কৌতূহলী চোখ ঘুরে বেড়ায়, কোনো বুনো প্রাণীর পায়ের ছাপের দেখা মেলে কি? কোনোভাবে কি দেখা মিলবে এই বনের আদি সন্তান, বন্য শূকর, মেছো বাঘ, হরিণ কিংবা মেছো বিড়ালের? কী হবে যদি বুনো কুকুরের পালের সামনে পড়ে যাই? আমাদের কল্পনাবিলাসী মন শিউরে ওঠে।
গাইড জানালেন, এই খালগুলোয় বুনো প্রাণীরা মাঝেমধ্যে পানি খেতে আসে। তবে তাদের ভরদুপুরে দেখতে পাওয়া মুশকিল। মানুষ যেভাবে নির্বিচার গাছ কাটতে আসে, লোকালয়ে ওরা বের হয় খুব কম। শুনে দলনেতা সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলেন সবাইকে। বলে দিলেন, বনের মধ্যে শব্দ করা চলবে না একদম। চোখে না দেখলেও কানে বনের গান শোনেন। নির্দেশ শুনে আমরা নিশ্চুপ হয়ে হাঁটতে থাকি। আর মনভরে উপভোগ করি বুনো পাখির ডাক, ডানা ঝাপটানোর শব্দ। বনের গায়ক পাখিদের যেন কনসার্ট বসেছে তখন।
রেমা-কালেঙ্গার এই বন পাখির জন্যও বিখ্যাত। টুনটুনি থেকে শুরু করে ভীমরাজ, টিয়া, পাতি ময়না, লালমাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, রাজধনেশ, কালো মথুরা, লাল বনমোরগ, প্যাঁচা, মাছরাঙা, ইগল, চিলের রাজত্ব এই বনে। তাদের কলতানে হঠাৎ ব্যাঘাত! ‘গেঁ-কো, গেঁ-কো’ শব্দে ডেকে উঠল কে যেন, সঙ্গে গাছের ডালে হুটোপুটি। একদল হনুমান যাচ্ছিল মাথার ওপর দিয়ে, মানুষ দেখেই দলনেতা সাবধান করে দিচ্ছে অন্য সদস্যদের!
এভাবেই বুনো পথ পেরিয়ে, বেতের ঝাড় এড়িয়ে আমরা পৌঁছালাম বনের সবচেয়ে উঁচু গর্জন গাছটার গোড়ায়। তিন মানুষ বেড় দিয়েও তার কাণ্ড পরিমাপ করা যায় না, মাথায় কেমন পাতা, তা–ও আসে না নজরে, এতই উঁচু সে। যাঁরা গাছ ভালোবাসেন, তাঁরাই বুঝবেন, চোখের সামনে শতবর্ষী একটা গাছের গাম্ভীর্য কেমন প্রভাব ফেলে মনে।
এই ভূখণ্ডের কত ইতিহাস না জানি সে দেখেছে গম্ভীর দাঁড়িয়ে, কত ঝড়ঝাপটা দেখেছে, আমরা হয়তো তা কল্পনাও করতে পারি না। এমন বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে আমাদের মন নরম হয়ে আসে শ্রদ্ধায়। সঙ্গে একটুখানি আফসোস, এই গাছগুলো কী নির্বিচার অর্থের লোভে মাটিতে নামিয়ে আনি আমরা। একবার ভাবিও না, প্রতিটি গাছ কাটার পরে কেমন অসহায় হয়ে পড়ে এই বনের সন্তানেরাও। গাছ তো ওদের মায়ের মতোই। মাকে সরিয়ে নিলে সন্তানেরা যাবে কোথায়?
এমনই এক অদ্ভুত অনুভূতির মধ্য দিয়ে কালেঙ্গা বাজারের মাথা হয়ে শেষ হলো ভ্রমণের প্রথম দিন। রাতে বনের উপকণ্ঠেই তাঁবুবাস, পরদিন অফ-ট্রেইলে, বেতের বন পেরিয়ে, হুগলিছড়া চা–বাগান পেরোতেই সন্ধ্যা। অগত্যা পাশের রবার বাগানেই আবার তাঁবু খাটিয়ে থেকে যাওয়া। পাশের চা-বাগানে শিয়ালের কোলাহল, নিশাচর পাখিদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে আরেকটা রাত কেটে যায় স্বপ্নের মতো। এখনো সেই স্বপ্নের ঘোরেই আছি। বনের গন্ধ একবার যে পেয়েছে, সে কি আর শহুরে ইট-সিমেন্টের জঙ্গলে ফিরতে চায়? নাকি ফিরতে পারে কখনো?
১. রেমা-কালেঙ্গার জঙ্গলের কাঁচা রাস্তা বেশ এবড়োখেবড়ো, বেতের কাঁটা ফুটে যাওয়ার ভয়ও আছে। তাই ভালো মানের ট্রেকিং কেডস আর মোজা পরে যাওয়াই উত্তম।
২. অনেকখানি পথ হাঁটতে হয় বিধায় পায়ে ফোসকা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ফার্স্ট এইডের ছোট্ট একটা ব্যবস্থা অবশ্যই রাখবেন।
৩. সব সময় চেষ্টা করতে হবে দলের সবাই যেন দৃষ্টিসীমায় থাকে। আমাদের দলের চারজনই একদম সেকেন্ডের মাথায় হারিয়ে গিয়েছিল। দুটি ঘণ্টা বন তোলপাড় করে তাদের খুঁজে আনতে হয়েছে। পাশেই ভারতের বর্ডার, তাই হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি না নেওয়ায় ভালো। জিপিএস ট্র্যাকার সঙ্গে রাখা শ্রেয়।
৪. বনের মধ্যে কখনোই বেখেয়ালে পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের পাফ ফেলা যাবে না। মাটি-পানি দূষিত হয় তো বটেই, দাবানলের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
৫. ব্যাগ হালকা রাখার চেষ্টা করতে হবে। শুকনা খাবার, পানি, পাওয়ার ব্যাংক, চার্জিং কেব্লের পাশাপাশি ছোট একটা তোয়ালে সঙ্গে রাখতে হবে।
৬. শীতের সময় জোঁক থাকে না, তবে রক্তচোষা আঠালি পোকা বেড়ে যায়। শরীরের অনাবৃত অংশে ওডোমস মেখে নিলে ভালো। আর পোকা টেনে ছাড়ানোর চেষ্টা করা যাবে না। ভ্যাসলিন মাখিয়ে দিলে আঠালি পোকা এমনিতেই শ্বাসরোধ হয়ে ঝরে পড়বে।
ছবি: আলিমুর রশীদ