'হোক না সে আকাশ নীল কিংবা কালো মেঘে ঢাকা। আমার পথের সঙ্গী তো ওই আকাশই। কখনোবা পাহাড়, সমুদ্র অথবা নদী। আপনি কি নিজেকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত? একবার নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেই দেখুন, নিজেকে একবার প্রমাণ করুন। আমরা টিভির পর্দায় বিভিন্ন চ্যানেলে অনেক বিদেশির অ্যাডভেঞ্চার চ্যালেঞ্জিং প্রোগ্রাম দেখে থাকি, কিন্তু নিজেকে সেই জায়গায় কখনো চিন্তা করে দেখেছি কি? নিজের সাধ্য অনুযায়ী তো একটা চ্যালেঞ্জ নেওয়া যেতেই পারে, তাই না'? আপন মনে বলে চলছিলেন সাইফুল ইসলাম শান্ত। তিনি একজন পরিব্রাজক। কুমিল্লার ছেলে শান্ত স্নাতক করেছে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে। বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেছেন পায়ে হেঁটে। খুব শিগগিরই যাচ্ছেন পদব্রজে বিশ্বভ্রমণে। হাল ফ্যাশনের পক্ষ থেকে নাদিয়া ইসলামের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে জানলেন নিজের রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প।
শান্তর বয়ানে, 'সেই ইচ্ছা থেকেই নিজের দেশ, সংস্কৃতি, মানুষের জীবনধারা জানার জন্য ২০২০ সালে কুমিল্লা জেলার নিজ উপজেলা থেকে পা বাড়াই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে। একে একে বিভিন্ন প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে অসম্ভব সুন্দর স্মৃতি নিয়ে হেঁটে পাড়ি দিই এক হাজার কিলোমিটার পথ। কুমিল্লা থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত। এই রোমাঞ্চকর পথে জেনেছি নিজেকে, দেশের মানুষের আন্তরিকতা সম্পর্কে, না-জানা অনেক ইতিহাস আর নিজের দেশ সম্পর্কে। এই ভ্রমণে আমি সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করেছি জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন। পথে গাছ কাটা, প্লাস্টিকের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাকে পীড়া দিয়েছে। এই পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার দিকটা আমাকে খুব ভাবিয়ে তোলে। ভেবেছি, কিছু হয়তো করা উচিত। নিজের যতটা সামর্থ্য, তা দিয়ে সবার কাছে এই ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে চেয়েছি নতুনভাবে। আমার কাছে মনে হয়, মানুষের খুব কাছাকাছি যাওয়া যায় হেঁটে ভ্রমণ করলে। নানা উপায়েই তো ভ্রমণ করাই যায়। কেউ সাইকেলে ভ্রমণ করেন,কেউ অন্যান্য যানবাহন। কিন্তু হেঁটে ভ্রমণ সবচেয়ে কার্যকর যেকোনো সচেতনতামূলক বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দিতে। আর এতে খুব কাছ থেকে সবকিছু উপলব্ধি করা যায় রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে। সেই ভাবনা থেকেই ২০২২ সালে ৭৫ দিন ধরে একে একে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার তিন হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটে ভ্রমণ সম্পন্ন করেছি এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। শুধু বাংলাদেশে নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। ২০২২ সালের শেষের দিকে ৬৪ দিনে ঢাকা থেকে ভারতের পশ্চিম বাংলায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে ভ্রমণ সম্পন্ন করি। আসলে প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েই চলেছে, যা আমাদের স্বাভাবিক জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ জন্য এই সচেতনতার বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি'।
কেন ৬৪ জেলা হেঁটে ভ্রমণ করেছেন?
স্কুলে পড়ার সময় জসীম স্যার সমাজ ক্লাস করানোর সময় প্রায়ই ম্যাপ এঁকে আমাদের ক্লাস করাতেন। তখন ম্যাপে দেখা জায়গায়গুলোয় ভ্রমণের ইচ্ছা জাগত। কিন্তু ছোট অবস্থায় সেগুলো স্বপ্নই ছিল। অবশ্য পায়ে হেঁটে যাব, সেটা কখনোই ভাবিনি। তখন সবে ক্লাস নাইনে উঠেছি। জানুয়ারি মাস। তেমন ক্লাসের চাপ নেই। তাই কয়েকজন বন্ধু মিলে ঘুরতে বের হয়ে যেতাম। তখন আমরা কয়েক বন্ধু রনি, ফারুক, মনির,আফজাল গোমতী নদীর তীর ধরে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে হেঁটে ঘুরে বেড়াতাম।
স্নাতকে ভর্তি হই যাত্রাবাড়ী দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে। তখন থেকে হেঁটে ঘোরাঘুরিটা শুরু হয়। ঢাকার অলিগলি দেখার উদ্দেশ্য হেঁটে হেঁটে ঘোরাঘুরি করতাম। আর তখন থেকেই একা একা ঘোরার প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়। পরে ভাবলাম, যেহেতু হেঁটে ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষ, প্রকৃতি খুব কাছ থেকে দেখা যায়, তাহলে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছানোর একটা ভালো মাধ্যম হতে পারে হেঁটে ভ্রমণ। শান্ত আরও বললেন, যেহেতু দিন দিন প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, বৃক্ষ নিধন, প্লাস্টিকের অত্যধিক ব্যবহার, যেখানে-সেখানে প্লাস্টিক ফেলার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, তাই আমি আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করেছি পদযাত্রার মাধ্যমে মানুষের কাছে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে।
৬৪ জেলায় পদযাত্রার প্রতিপাদ্য বিষয় কী ছিল?
প্রথমত, প্রকৃতি রক্ষায় বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব। প্রতিনিয়তই বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটা আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। যদি এখনো বৃক্ষ সংরক্ষণ এবং রোপণে এগিয়ে না আসি, তাহলে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি তা আমাদের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হবে। এ বিষয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি।
এরপরই আসে পরিবেশ সুরক্ষায় প্লাস্টিক ব্যবহারে সচেতনতার বিষয়টি। মানুষের অসচেতনতাই প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণ। মাটিতে প্লাস্টিক পচতে সময় লাগে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ বছর অথবা তার চেয়েও বেশি। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আজকাল আমরা যা যা ব্যবহার করি, তার অধিকাংশই প্লাস্টিকের তৈরি এবং এই প্লাস্টিক যেখানে-সেখানে ফেলার কারণে মাটি, পানি, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। আমরা প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করতে পারব না, কিন্তু কমিয়ে আনতে পারব। এই বিষয়টিও ভ্রমণের সময় তুলে ধরেছি। এ ছাড়া জীবন বাঁচাতে রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেছি। জীবন বাঁচাতে রক্তদানের গুরুত্ব এবং স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছি।
৬৪ জেলা হেঁটে ভ্রমণের আগে কখনো হেঁটে এভাবে কোথাও গিয়েছেন কি?
৬৪ জেলায় হাঁটার আগে ২০২০ সালে এক হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটেছি। কুমিল্লা থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত ৪০ দিনে এক হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটে ভ্রমণ করেছি। যাত্রা শুরু করি ২০২০ সালের ১২ আগস্ট থেকে। এই ভ্রমণ সম্পন্ন করি একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বরে। তখন হেঁটেছিলাম বাংলাদেশের ১৬টি জেলা।
ভ্রমণপথের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
অভিজ্ঞতা অসাধারণ। কখনো হাইওয়ে, কখনো গ্রামের মেঠো পথ ধরে যেতে যেতে সাধারণ মানুষের অনেক শুভেচ্ছা পেয়েছি। সবাই খুব ভালোভাবেই গ্রহণ করেছেন আমাকে। তবে মাঝেমধ্যে অনেকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলেন, যখন সচেতনতার বার্তা দিতে চেয়েছি, কিন্তু সেটি খুবই কম। সব সময় যে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি খুব ভালো ছিল, তা-ও নয়। অনেক সময় অনেকেই পাগল ডেকেছেন, তুচ্ছ করে কথা বলেছেন। তবে বেশির ভাগ মানুষ ভালোভাবে নিয়েছেন ব্যাপারটা। তাই আর তাদের কথা মাথায় নিই না।
যাত্রাপথে রাতযাপন আর খাবারের ব্যবস্থা কীভাবে করেছেন
রাতে থেকেছি কখনো উপজেলা পরিষদের ডাকবাংলো, হোটেল অথবা পরিচিত কোনো বন্ধুর বাসায়। আর যখন যেখানে খাবারের সময় হয়েছে, পথে হোটেল থেকে কিনে খেয়েছি। বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় খাবার কিনতে পাওয়া যায়। তাই খাবার নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি।
ব্যাগে কী কী প্রয়োজনীয় জিনিস ছিল?
যেহেতু সম্পূর্ণ পথ হেঁটে যেতে হয়, সে জন্য সব সময় ব্যাগ হালকা রাখার চেষ্টা করি। তবু প্রয়োজনীয় কাপড়, ট্রাউজার, মেডিসিন, ক্যাপ, ছাতা, লাইট ইত্যাদি তো রাখতেই হয়।
যাত্রাপথে প্রতিবন্ধকতা কী ছিল?
যাত্রাপথে তেমন কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হইনি। তবে রাঙামাটি, বান্দরবান—এসব পার্বত্য এলাকা একা একা হাঁটার সময় বেশ ভয় লেগেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে যাত্রা।
নদীপথ কীভাবে অতিক্রম করেছেন?
যেখানে হাঁটার মতো কোনো উপায় নেই, সেখানে নৌকার মাধ্যমে পার হয়েছি। আর যেসব সেতুতে হেঁটে যাওয়ার অনুমতি নেই, সেখানে গাড়ি ব্যবহার করে সেতু পার হতে হয়েছে, যেমন পদ্মা সেতু।
পারিবারিক সাপোর্ট কেমন ছিল?
সত্যি বলতে, বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার করা খুবই কঠিন। পরিবার বা সমাজ খুব সহজে সাপোর্ট করে না। নানা সময় নানাভাবে অনেক কথা শোনায় এসব অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে। তবে আমি পরিবার থেকে যথেষ্ট সাপোর্ট পেয়েছি, যার কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এমন অভিযান করতে পেরেছি।
এই অভিযানের স্পনসর কারা ছিলেন?
স্পনসর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার করতে চাই, তাঁদের জন্য। বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার করার জন্য স্পনসর পাওয়া খুবই কঠিন। এই স্পনসরের জন্য যে কত ঘুরেছি, তার হিসাব নেই। অবশেষে আমার প্রজেক্টে এগিয়ে আসে ষড়জ অ্যাডভেঞ্চার। ষড়জ অ্যাডভেঞ্চারের প্রধান লিপটন সরকার ভাইয়ার কাছে চিরকৃতজ্ঞ আমি। তিনি এগিয়ে না এলে হয়তো এই প্রজেক্ট করা সম্ভব ছিল না। প্রধান স্পনসর ছিল ষড়জ অ্যাডভেঞ্চার। এ ছাড়া অন্যান্য সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, হাঁটাহাঁটি the Walk, Walking Bangladesh
যাত্রাপথ মনিটরিং করেছেন কে?
আমার এই যাত্রাপথে গতিপথ সম্পূর্ণ মনিটরিং করেন Hiker’s society of Bangladesh। প্রধান শাহদাত হোসাইন। স্ট্রাভা অ্যাপের মাধ্যমে আমার এই যাত্রাপথ রেকর্ড করি।
এই পুরো বিষয়ে অনুপ্রেরণা কে?
আয়রনম্যান শামসুজ্জামান আরাফাত সব সময় বলেন, যুদ্ধটা নিজের সঙ্গে। প্রতিনিয়তই নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে। আমাকে তিনি ও তাঁর এই কথাই অনুপ্রাণিত করেছে।
পরিশেষে সাইফুল ইসলাম শান্ত বলেন, হাইকিং নিয়ে বাংলাদেশে অনেক স্বপ্ন দেখি। অসুস্থ বিনোদন থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশে একদিন অ্যাডভেঞ্চার হয়ে উঠবে সবার প্রিয়। গঠন হবে একটি সুস্থ সমাজ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হেঁটে যেতে চাই। শুধু স্পনসরের অভাবে সেই সুযোগ হচ্ছে না। তবে হাল ছাড়ছি না। ইনশা আল্লাহ একদিন হবে। পৃথিবীর সব মহাদেশে আমার পদচিহ্ন এঁকে দিতে চাই। এরই ধারাবাহিকতায় খুব শিগগিরই পায়ে হেঁটে বিশ্বভ্রমণে বের হব, তবে তার জন্য স্পনসর প্রয়োজন।