বাংলাদেশের ঐশ্বর্য সন্ধান ১২: রাজকীয় অতীতের নিঃশব্দ সাক্ষী চট্টগ্রামের বড়উঠান মিয়াবাড়ি
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আঁকাবাঁকা সড়ক পেরিয়ে বড়উঠান এলাকায় আমাদের সিএনজি একটি দিঘির পাশ দিয়ে গিয়ে ধ্বংসস্তূপের সামনে এসে থামল। দূর থেকে স্থাপনার অবয়ব দেখে কোনো জমিদারবাড়ির কাছারিঘরের মতো লাগছে। ইতিহাস অনুরাগী  হিসেবে, ৬৪ জেলার স্থাপত্যগুলো ঘুরতে ঘুরতে অবয়ব দেখে, এখন কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারি।
সিএনজি থেকে নামলাম আমিসহ চারজন। আনোয়ারার হারুন ভাই ও মোরশেদ ভাই আর এই এলাকার এক তরুণ। আমি ছাড়া সবাই স্থানীয়জন।

ক্ষয়ে যাওয়া দ্বিতল ভবন
ক্ষয়ে যাওয়া দ্বিতল ভবন

স্থাপনার দিকে এগোলাম। ধ্বংসস্তূপের মাঝেও কাছারিঘরের পিলারগুলো চোখে পড়ল। কাছারিঘরের পাশ দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার প্রবেশ দুয়ার। প্রবেশ দুয়ারের পিলারগুলো বলে দিচ্ছে একসময় কত জৌলুশপূর্ণ ছিল বাড়িটি। মোরশেদ ভাই আর হারুন ভাই বললেন, এই জমিদারবাড়ি ৩০০ বছরের পুরোনো। কিন্তু এখন একেবারেই পরিত্যক্ত। ভেতরের দিকে গিয়ে দেখলাম দ্বিতল একটি ভবন, সেটিও একেবারে মুছে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

দিঘিতে এলাকার লোকজন গোসল করছেন। যাঁরা গোসল করছেন, তাঁরা আমার সঙ্গীদের পরিচিতজন। মোরশেদ ভাইয়ের সঙ্গে কিছু দূর হেঁটে গিয়ে দেখলাম একটি মসজিদ। স্থাপত্যশৈলী দেখে মোগল মসজিদ মনে হলো। কিন্তু মূল স্থাপনাকে পেছনে রেখে মসজিদের সামনের জায়গায় নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। যার কারণে আদি স্থাপনা ঢাকা পড়েছে। কেন যে এ রকম রূপ দেওয়া হয় প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলোর! দেশজুড়ে এত মসজিদ রয়েছে। প্রতিটি এলাকায় কিছু দূর পরপর মসজিদ থাকার পরও পুরাকীর্তি হিসেবে এই মোগল মসজিদগুলোকে সংস্কার কিংবা পরিধি বাড়ানোর কাজ থেকে কি মুক্তি দেওয়া যায় না! মসজিদের নাম ইলিয়াছ খান মসজিদ।

ইলিয়াছ খান মসজিদ
ইলিয়াছ খান মসজিদ

এতক্ষণ বলছিলাম চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো জমিদারবাড়ির কথা। স্থানীয়ভাবে এই জমিদারবাড়িটি ‘বড়উঠান মিয়া বাড়ি’ নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠাতা রাজা শ্যামরায়। দেয়াঙ পাহাড়ের পাদদেশে রাজা শ্যামরায়ের পরগনা ছিল। পরগনার নাম দেয়াঙ। বর্তমানে স্থানটি কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নে।

বিজ্ঞাপন

 আমি আগ্রহী ছিলাম জানতে, রাজা শ্যামরায়ের বাড়ির নাম কী করে বড়উঠান মিয়াবাড়ি হলো। চট্টগ্রামের পুরোনো স্থাপত্য ও ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের লেখা গ্রন্থে এই জমিদারি সম্পর্কে নানা তথ্য পেয়েছি। সেসব তথ্য থেকে একটি তুলে ধরছি।

না জানি কত জৌলুসপূর্ণ ছিল
না জানি কত জৌলুসপূর্ণ ছিল

চট্টগ্রামের স্থানীয় লেখক জামালউদ্দিনের ‘দেয়াঙ পরগনার ইতিহাস’ বইয়ে এই জমিদারি সম্পর্কে লেখা রয়েছে: এই জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা রাজা শ্যামরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তাঁর নাম হয় দেওয়ান মনোহর আলী খান। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার নবাব শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম বিজয় করেছিলেন। শায়েস্তা খান তাঁর কন্যাকে মনোহর আলীর সঙ্গে বিয়ে দেন। এই বিয়ের পর মনোহর আলীর ভাগে চলে আসে চট্টগ্রামের বিশাল ভূসম্পদের জমিদারি। মনে করা হয়, মনোহর আলী ছিলেন মোগল সময়ে চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তর জমিদার। এই জমিদারি মোগল সময় থেকে ব্রিটিশ শাসনামল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর ধীরে ধীরে শ্রীহীন হতে শুরু করে জমিদারির সব স্থাপনা।

আনোয়ারার মোর্শেদ ভাই আমাকে এই পরিবারের ষোড়শ বংশধর সাজ্জাদ আলী খানের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিলেন। তিনি থাকেন চট্টগ্রাম শহরে। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে গ্রামে আসেন। তাঁর বয়ানেও জানলাম এই বাড়ির তথ্য। ৭০ থেকে ৭৫ বছর বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। নবাব শায়েস্তা খাঁ যখন চট্টগ্রাম বিজয় করেন, তখন তাঁর প্রধান সেনাপতি ছিলেন বড় ছেলে বুজুর্গ উমেদ খান। উমেদ খানের সহযোগী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন রাজা শ্যামরায়। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নাম পরিবর্তন করেন মনোহর আলী খান হয়েছিলেন। এই পরিবারটির বয়স প্রায় সাড়ে তিন শ বছর।

কাছারি ঘরের পিলার
কাছারি ঘরের পিলার

সাজ্জাদ আলী খান আরও জানালেন, শায়েস্তা খাঁর এক কন্যার সঙ্গে মনোহর আলী খানের বিয়ে হয়েছিল। তবে সেই কন্যার নাম নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তাঁর দুটো নাম প্রচলিত আছে। একটি পরীবিবি, অন্যটি নুরজাহান। চট্টগ্রাম শহরেও আছে এই পরিবারের কীর্তিচিহ্ন। কিংবদন্তি নাকি এই তথ্যের ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, সেটি জানা নেই। শায়েস্তা খাঁ একদিন রাজার ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য বলেন, এক রাতের মধ্যে শ্যামরায় যদি নবাবের বাড়ির সামনে একটি দিঘি খনন করতে পারেন, তবে তিনি আনন্দিত হবেন। সকালে নবাব দেখেন সত্যি সত্যি তাঁর বাসস্থানের সামনে এক বিশাল দিঘি। কমলদহ দিঘির সৃষ্টি নাকি এভাবেই হয়েছে। দিঘির অবস্থান চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে।

মসজিদের দিঘির ঘাট
মসজিদের দিঘির ঘাট

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেল, চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদার পরিবার ছিল এটি। চট্টগ্রামের বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে তাঁরা জড়িত ছিলেন। একবিংশ শতাব্দীতে এই জমিদারির বাস্তবতা সবার সামনেই রয়েছে।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন