বিখ্যাত লেখক মুজতবা আলী বলেছেন, ‘আমরা তেতো, নোনতা, ঝাল, টক, মিষ্টি—এই পাঁচ রস দিয়ে ভোজন সমাপন করি। ইংরেজ খায় মিষ্টি আর নোনতা, ঝাল সামান্য, টক তার চেয়েও কম এবং তেতো জিনিস যে খাওয়া যায়, ইংরেজের সেটা জানা নেই। তাই ইংরেজি রান্না আমাদের কাছে ভোঁতা ও বিস্বাদ বলে মনে হয়।’
কথা কিন্তু সত্যি; বাঙালির স্বাদগ্রন্থি আর রন্ধনশৈলীকে টেক্কা অন্তত উপমহাদেশের বাইরের কোনো বড় রন্ধনশিল্পী দিতে পারবেন কি না বলা মুশকিল। আমাদের হাজার বছরের রন্ধনের রসায়ন জিনগতভাবেই যেন মস্তিষ্কের স্বাদগ্রন্থিতে বসে গেছে। বাংলাদেশের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় গেলেই খাবারের স্বাদে পাওয়া যায় ভিন্নতা আর অভিনবত্ব। বাঙালি নেতিবাচকতা আর বিবাদ নিয়ে যতটা সময় কাটায়, তার চেয়ে আমাদের প্রাচুর্য নিয়ে চর্চা করলে, এর চেয়ে ঢের বেশি ভালো কিছু অর্জন হতো।
সে যাহোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। কক্সবাজার বাংলাদেশের সবচেয়ে পর্যটক সমাদৃত এলাকা। কেবল বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের যেসব পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণে আসেন; তাঁদের বেশির ভাগ কক্সবাজারে আসেন পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতসহ বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি পর্যটন সুবিধা কক্সবাজারে পাওয়া যায় বলে। বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও হোটেলে আন্তর্জাতিক, প্যান–এশিয়ান, ইউরোপিয়ান, ল্যাটিন, মধ্যপ্রাচ্যের কুজিন ছাড়াও নানা ধরনের সামুদ্রিক খাবার আর বাংলাদেশের সব অঞ্চলের কোনো না কোনো খাবার এখানে মিলবে। যেকোনো অঞ্চলের পর্যটন বিকাশে যোগাযোগ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সুস্বাদু খাবার বিশাল ভূমিকা রাখে।
এবারের কক্সবাজার ভ্রমণে বেশ কিছু খাবার নিজে চেখে দেখলাম। ভ্রমণমৌসুমে যাঁরা সমুদ্রদর্শনে যাচ্ছেন, তাঁরা নিতে পারেন এসব খাবারের স্বাদ। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, দুর্দান্ত না হলেও খুব একটা মন্দ লাগবে না।
রাখাইন কুইজিনের অথেনটিক স্বাদ যাঁরা কখনো নেননি কিন্তু নিতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য একটা দারুণ এক রেস্তোরাঁ আছে। নাম ‘ফালং জি’। রাখাইন খাবারের সঙ্গে স্থানীয় সব পদের সমন্বয় ভোজনরসিকদের দেবে অন্যতর স্বাদ। কায়াং পাড়া বৌদ্ধমন্দিরের পাশে, বার্মিজ মার্কেটে ফালং জি রেস্টুরেন্ট। ডলফিন পয়েন্ট, সুগন্ধা বা লাবণী পয়েন্ট—যেকোনো জায়গা থেকে অটোরিকশাকে বললেই আপনাকে নিয়ে যাবে বার্মিজ মার্কেট। তবে রাত ৯টার পর যাবেন না, আটটা নাগাদ মূল পদগুলো শেষ হয়ে যায়। ‘চা পাতার ভর্তা’, পাহাড়ি মোরগ ভুনা, পাহাড়ি হাঁস খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শেষ হয়ে যাওয়ায় আমি নিয়েছিলাম কোরাল ভাপা, মাশরুম ভাজি, বাঁশকোড়লের ভুনা আর ডাল। খাবার আসতে আসতে ঘুরে দেখলাম রেস্টুরেন্টটি। মিয়ানমারের ঐতিহ্যবাহী সজ্জা ও পণ্যে সাজানো পুরো রেস্তোরাঁ।
স্থানীয় পর্যটকদের পাশাপাশি অনেক বিদেশি পর্যটকও এসেছেন রাখাইন খাবারের স্বাদ নিতে। মন ভালো করে দেওয়া একটা আবহে কিছু সময় পার করলাম। এরই মধ্যে চলে আসে বেতের ঝুড়িতে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, হালকা ঝোল আর কাঁচা পেঁয়াজসহযোগে কোরাল ভাপা। চিংড়ি আর মাশরুম ভাজির মন কাড়া সুবাসে, ঝাঁজাল কিন্তু জিবে জল আনা বাঁশকোড়ল ভুনা আর ডালও বেশ ভালো। পরিবেশনটাও আকর্ষণীয়, যা আপনার ক্ষুধাকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
প্রথমেই শুরু করি মাশরুম–চিংড়ি ভাজি দিয়ে। ফালি করে কাটা নরম মাশরুম আর চিংড়ির মচমচে স্বাদের সমন্বয় খাবারের শুরুতে একটা ভালো লাগার অনুভূতি দেবে স্বাদগ্রন্থিকে। বাঁশকোড়লের ভুনায় ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ ধরনের সস আর তেল যা ঝালপ্রেমীদের আলবত পছন্দ হবে। ঝাল আমার পছন্দ নয়, তবে ঝাল স্বাদের একটা মজার ব্যাপার খুব ভালো লাগে—প্রথমেই তীব্র ঝালটা জিবের গোড়া ছুঁয়ে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে; এরপর নাকের জলে চোখের জলে হলেও ভালো লাগতে থাকে। এবার অতি প্রতীক্ষিত পদ কোরাল ভাপার পালা। এর স্বাদ এককথায় দুর্দান্ত, মুখে দিতেই নরম মাখনের মতো গলে যায় মাছ, কাঁটার বালাই নেই, মাছের কড়া গন্ধ তো একেবারেই নেই, পাতলা সাদা ঝোলে কাঁচা পেঁয়াজ, ধনেপাতা আর রসুনের স্বাদ বেশ লাগছিল, খালি ঝোল খেতেও দারুণ ছিল।
এবার ডালের পালা রসুন বাগারের ডাল কিন্তু সয়া চাংকের মতো কী যেন একটা মুখে লাগছিল আর খুব মজার ছিল। শেফকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম এটাতে বিশেষ কিছু একটা দিয়েছেন কি না; বললেনও আমাদের সব রান্না রাখাইন পদ্ধতিতে করা। রসুনসদৃশ এই সবজি মিয়ানমার থেকে এসেছে।
মেইন কোর্স শেষে মিষ্টি না হলে তো অপূর্ণতা থেকেই যায়। টিকটক আর রিলসের কল্যাণে ড্রাগন ফ্রুট উইথ আইসক্রিম অনেকেই দেখেছেন। ড্রাগন ফলের আকর্ষণীয় রঙের জন্য দেখতে দারুণ, ভ্যানিলার সঙ্গে ড্রাগন ফলের জুড়ি মুখে দেবে ভিন্নতার স্বাদ। কলাপাতায় মোড়ানো বার্মিজ পুলি পিঠা, পাটিসাপটা, ভাপা পিঠা প্রতিটিই দারুণ ছিল। বিন্নি চালের গুঁড়া, নারকেল গুড়ের স্বাদ মনে থাকার মতো ছিল। খেতে আমার লেগছিল এক হাজার টাকা। তবে বলতেই হয়, যে পরিমাণ খাবার দেওয়া হয়, তা অনায়াসে দুজন খেতে পারে।
এটা একটা ছোট্ট ক্যাফের নাম। সুগন্ধা বিচের কাছে হোটেল মিশুকের পাশেই এই ক্যাফে। উল্টো দিকে আছে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। ক্যাফের বাইরের সজ্জা বেশ রঙিন। সমুদ্রপারের আবহ আছে। ‘পেঁয়াজু’ গরম ফুঁ দিয়েরে হন। চট্টগ্রামের নিজস্ব ভাষায় রাখা হয়েছে এই রেস্তোরাঁর নাম। মচমচে পেঁয়াজু, সমুচা, শিঙাড়া, চা, লইট্টা ফ্রাই, স্কুইড ফ্রাই মুচমুচে খাবারের সাম্রাজ্য। বিশেষ করে পেঁয়াজুর কথা বলতেই হয়। চালের গুঁড়া ব্যবহারের কারণে এর মচমচে স্বাদ ভালোলাগা তৈরি করে, সঙ্গে থাকা ধনেপাতা আর পুদিনার চাটনি দারুণ লাগবে খেতে। এক বাটি ৫০ টাকা সঙ্গে মালাই চা। কক্সবাজার ভ্রমণে অবশ্যই চেখে দেখার মতো এটি। কেবল এই রেস্তোরাঁ নয়, কক্সবাজারের পথের ধারের দোকানের পেঁয়াজু খুবই মজার।
আনারকলি বা প্যাশন ফ্রুট কক্সবাজারের সুগন্ধা আর লাবণী পয়েন্টের সমুদ্রসৈকতে ভ্রাম্যমাণ দোকানিরা বিক্রি করে এই ফল। একেকটি বড় পাকা প্যাশন ফ্রুট বিক্রি হয় ৫০ টাকায়। পর্যটন মৌসুমে বেড়ে যায় এর চাহিদা। টক–ঝাল–মিষ্টি এ ফলকে এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকেরাই জনপ্রিয় করে তুলেছেন। আমি চেখে দেখলাম। ভেতরের হলদেটে বীজযুক্ত পাকা ফলের স্বাদ আমাদের দেশি ডেউয়া ফলের মতো। এর সঙ্গে বিটলবণ, মরিচগুঁড়া, জিরাগুঁড়া মিশিয়ে আর মুখরোচকভাবে পরিবেশন করা হয় পর্যটকদের কাছে। কক্সবাজার গেলে অবশ্যই খেতে ভুলবেন না।
ট্রেনে ভ্রমণ আমার কাছে সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক। একধরনের মৃদু ছন্দের সঙ্গে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে ভ্রমণ। শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রামে ঢুকলেই দেখা যায় সবুজের সমারোহ। শুধু তা–ই নয় অনেকেই ট্রেনে ভ্রমণ করেন এখানকার মুখোরোচক খাবারের জন্য। অবশ্য এই বিষয়ে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন। আগের সেই মান আর নেই, তবে সিলেট বা চট্টগ্রামের ট্রেনে চড়লে কিছুক্ষণ পরপর নাশতা বা খাবার নিয়ে হকারদের কিংবা ট্রেন ফুড ক্যানটিন স্টাফদের চলে আসা আমি খুব উপভোগ করি। অন্যান্য গন্তব্যের ট্রেনের খাবারের মান আসলেই আগের মতো নেই তবে কক্সবাজার ঢাকা রুটের ট্রেনের খাবারের মান বেশ ভালো। লাঞ্চ টাইমে চিকেন পোলাওয়ের স্বাদ আমার বিবেচনায় বেশ। অল্প তেলে করা পোলাওয়ে এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ আর তেজপাতার মৃদু স্বাদ সুগন্ধি চালের স্বাদ মুখে লেগে থাকবে নিঃসন্দেহে, পোলাওয়ের সুস্বাদু লাগার মূলমন্ত্র হলো ঠিকঠাক সেদ্ধ হওয়া, তবেই কেল্লা ফতে। এই পোলাওটা গরম–গরম খেতে পারলে আরও দুর্দান্ত লাগত; কিন্তু ক্যানটিন থেকে আসতে আসতেই একটু ঠান্ডা হয়ে যায়, সঙ্গে থাকে সেদ্ধ ডিম আর হালকা ঝোলের কষা চিকেন। একজনের জন্য পরিমাণ যথেষ্ট; দাম পড়বে ১৭০ টাকা।
ছোটবেলার নস্টালজিয়া জড়ানো আবেগী এক খাবার কাটলেট, অনেকের অভিযোগ আগের মতো নেই। অন্য রুটেরগুলোয় খেয়ে দেখেছি কথা অনেকটাই সত্য। শক্ত ম্যাড়ম্যাড়ে। আমি আমার বাবার কাজের সুবাদে ছোটবেলায় অনেকবার সিলেটে ট্রেনে ভ্রমণ করেছি। সে সময়ের কাটলেট আসলেই স্বাদে ছিল অনন্য। কক্সবাজার–ঢাকা ট্রেনের কাটলেট তুলনামূলকভাবে আমার বিবেচনায় বেশ ভালো। কাটলেটের মূল উপাদান হচ্ছে ব্রেড ক্র্যাম্প আর মুড়ির গুঁড়া যা মচমচে রাখে। মুখে দেওয়া মাত্র আদার একটা সূক্ষ্ম স্বাদ পাওয়া যাবে; সেই সঙ্গে গোলমরিচের স্বাদ কাটলেটকে করে অনন্য। বিকেলের নাশতায় ১৯০ টাকার প্যাকেজে বেশ বড় আকারের কাটলেটের সঙ্গে থাকে চিকেন ফ্রাই এবং জেলি দেওয়া দুই টুকরা পাউরুটি। পাউরুটি ও চিকেন কাটলেট ছিল বেশ গরম ও নরম।
তাহলে এই পর্যটন মৌসুমে কক্সবাজার ভ্রমণে গেলে এই খাবারগুলো খেয়ে দেখতে পারেন। কেমন লাগল জানাতে পারেন হাল ফ্যাশনের ফেসবুক পেজে।
ছবি: লেখক