মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন সড়কের নাম শুনলেই মোগলদের কথা মনে পড়ে। এই এলাকায় অনেক মোগল আমলের স্থাপত্য এখনো আছে। আবার অনেক মন্দিরও আছে। একই চিত্র দেখা গেল পুরান ঢাকার নর্থ ব্রুক রোড থেকে প্যারীদাস লেন ঘুরে। পাশাপাশি মন্দির–মসজিদের অবস্থান। ধর্মীয় সম্প্রীতির চিহ্ন, আবহমানকাল ধরে ঐতিহ্যগতভাবেই ঢাকার বাসিন্দারা ধরে রেখেছে।
ইতিহাসমতে, রায়েরবাজার গড়ে ওঠে ঔপনিবেশিক আমলে, ১৯ শতকে। কুমারেরাই প্রথম এখানে তুরাগ নদের পাশে বসবাস শুরু করে। মোগল আমলে এই এলাকা মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল এবং এই অঞ্চলের অধিকাংশ কুমারই রায়েরবাজারে বাস করত। এখানে বিখ্যাত লালমাটি প্রচুর পাওয়া যেত। মোগল ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে লাল কাদামাটি আশপাশে অঞ্চলে পাওয়া যেত না। ফলে রায়েরবাজারের মৃৎশিল্পীদের এই লাল মাটি দিয়ে কাজ করার ঐতিহ্য আছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার সিভিল সার্জন তথা ইতিহাস লেখক জেমস ফওনস নর্টন ওয়াইজের মতে, এই এলাকা মোগল আমলে ‘কুমারটুলী’ নামে পরিচিত ছিল। সাড়ে সাত শ পাল বা কুমার পরিবার প্রায় দুই শ বছর আগে এখানে বসবাস করত।
এই এলাকা পাল গোত্রের মানুষের অধ্যুষিত ছিল। তাঁরা সবাই একত্র হয়ে দেড় শ বছর আগে এই দুর্গামন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বংশানুক্রমে পাল বংশের লোকেরা প্রতিমাশিল্পী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। রায়েরবাজার হাইস্কুলের কাছে রয়েছে ‘রক্ষাকালী মন্দির’, নিমতলায় ‘শিবমন্দির’, মহাগুরু মন্দির, পুলপাড় মসজিদের পাশেই কালীমন্দির, আছে ইসকনের মন্দির।
রায়েরবাজারের জাফরাবাদের শ্রীশ্রী দুর্গামন্দিরের প্রধান পুরোহিত হরিশংকর মজুমদার জানান, ধর্মীয় সম্প্রীতির অপূর্ব নিদর্শন রয়েছে এই এলাকায়। এখানে পাশাপাশি মন্দির ও মসজিদ। মসজিদে আজান হলে পূজা বন্ধ থাকে; নামাজ শেষে মসজিদ থেকেই জানানো হয়, ঠাকুর নামাজ শেষ, এবার আপনারা পূজা শুরু করতে পারেন।
১৯৬৮ সালে জন্ম নেওয়া হরিশংকর জানালেন, তাঁর জন্মের পর কখনোই হিন্দু-মুসলিম বিভেদ এখানে দেখেননি। সব ধর্মের প্রতি সবার রয়েছে শ্রদ্ধাবোধ। চৌদ্দ পুরুষ ধরেই তাঁরা এখানে বসবাস করছেন, হরি ঠাকুরের প্রপিতামহ তিনটি পাথর মন্দির প্রাঙ্গণে স্থাপন করেন। শাস্ত্রমতে শীতলা দেবীরা সাত বোন, এর মধ্যে শীতলা, ঝলকা, অলকাকে প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে। এর আকৃতি আগে ছোট ছিল। দেড় শ বছর ধরে ধীরে ধীরে বেড়ে বেশ বড় হয়েছে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান—সব ধর্মের মানুষ এখানে আসেন, মানত করেন তাঁদের মনোবাসনা পূরণের জন্য। এই পাথর ও দেবী দুর্গার অলৌকিকতায় বিশ্বাস আছে অনেকের।
মন্দির প্রাঙ্গণে দেখা গেল এই মন্দিরের প্রতিমাসহ বাইরের মণ্ডপের জন্য প্রতিমা গড়া হচ্ছে। মণ্ডপ দুটি হলো লুকাস ফ্যাক্টরি ও শাহিনবাগ। প্রতিমাশিল্পী কানাইলাল পাল। তিনি আর তাঁর ছেলে শঙ্করপাল বিক্রমপুর শ্রীনগর থেকে এসেছেন প্রতিমা গড়ার জন্য। জানালেন মুন্সিগঞ্জের আড়িয়ল বিল থেকে ট্রলারে করে মাটি আনা হয় প্রতিমা তৈরির জন্য।
মন্দিরের পরিচালক মহাদেব মৃধা জানালেন, পুরোনো মাটির দেবী বিগ্রহকে ঘিরে এক শ বছর ধরে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। ২০০৪ সালে এসে পাল গোত্রের স্বপন কুমার পাল, জয়শঙ্কর পাল ও গোপালচন্দ্র পালের পৃষ্ঠপোষকতায় এই প্রতিমা পুনর্নির্মাণ করা হয়। এই দুর্গা প্রতিমা প্রতি ছয় মাস পরপর বিসর্জন দেওয়া হয়। একবার অকালবোধন শারদীয় দুর্গাপূজায় এবং আরেকবার দেবী যখন জাগ্রত থাকেন, সেটা বাসন্তী পূজায়।
মন্দির প্রাঙ্গণে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ আর মন্দিরে রয়েছে বাসন্তী পূজার সময় নির্মিত প্রতিমা। মহালয়ার দিন একে দর্পণ বিসর্জন দিয়ে প্রাঙ্গণেই রাখা হয়েছে। বিজয়া দশমীর দিন দেওয়া হবে বিসর্জন আর নতুন প্রতিমাটি থাকবে চৈত্র মাসের বাসন্তী পূজা পর্যন্ত। এখানে দেবীর সারা বছর পূজা হয়; ভক্তকুল আসে। প্রতিমার শাড়ি অলংকার শাঁখারীবাজার থেকে আনা এই মন্দিরে যেকোনো ধর্মের যে কেউ এলে তাকে ভোগ দেওয়া হয়। আলাদা করে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন না থাকলেও আরতি, চণ্ডীপাঠ, ধুনচি নৃত্যের আয়োজন করা হয়।
একাত্তরের সহিংস স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমি এই ঠাটারীবাজার। হিন্দু অধ্যুষিত এই এলাকায় মাছপট্টির পেছনে ছিল বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধ কোষের দ্বিতীয় খণ্ডে রোজিনা কাদের উল্লেখ করেন, ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নবাবপুর বিসিসি রোডের রাজাকার ক্যাম্প থেকে গ্রেপ্তার হওয়া দুজন রাজাকারের বয়ান ছিল: তারা এখানে অসংখ্য বাঙালিকে জবাই করে হত্যা করেছে। সেই দুঃসহ স্মৃতিকে আগলে রেখেই সময় পার হয়েছে এই এলাকার মানুষের।
ওয়ারীর দিকে ঠাটারীবাজারের ঢোকার মুখেই জয়কালী মন্দির, ভগবতী দুর্গামন্দির, ও শিবমন্দির রয়েছে। শ্রীশ্রী ভগবতী দুর্গামন্দিরটি ২৫০ বছর আগে নির্মিত হয় বলে জানান মন্দিরের পুরোহিত দীপক চক্রবর্তী। এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত দুর্গামন্দির, যেখানে নিত্য পূজা হয়। রোজ বেলা ১১টায় এখানে অন্নভোগের প্রসাদ পাওয়া যায়; যা সবার জন্য থাকে। বিভিন্ন ধর্মের প্রচুর মানুষ আসেন এই মন্দিরে। কথিত আছে এই মন্দিরের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। যেকোনো মানুষ কোনো মনোবাসনা নিয়ে এখানে মানত করলে তা পূরণ হয়। তাঁর বয়ানে দুর্গাপূজা রাজসিক পূজা। সব পূজার মধ্যে সবচেয়ে বড় করে উদ্যাপন করা হয়।
১০ বছর আগে জনৈক ভক্তের স্বপ্নে পাওয়া আদেশ এবং মনস্কামনা পূরণার্থে শ্বেতপাথরের তৈরি প্রতিমা মন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি শ্রীশ্রী দুর্গা মায়ের পূজা-অর্চনার একটি স্থায়ী মন্দির। এই মন্দিরে দুবেলা দুর্গা মায়ের পূজা, সন্ধ্যা আরতি, প্রতি মাসে পূর্ণিমা তিথিতে পূজা, বাৎসরিক শারদীয়া দুর্গাপূজা, কোজাগরি লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, সরস্বতীপূজা, বিপদনাশিনী পূজা, জন্মাষ্টমী ও অন্যান্য বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
এই মন্দিরে এক দিন আগে থেকে পূজা শুরু হবে, যাকে বলা হয় বোধন অর্থাৎ পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যা থেকে। দেবীর শাড়ি-গয়না অনেক ভক্তই দিয়ে যান। দুর্গাপূজা বিভিন্ন শাস্ত্র অনুযায়ী চার মতে হয়ে থাকে—দেবী পুরাণত্ব, কালিকা পুরাণত্ব, বৃহৎ পুরাণত্ব ও নন্দী কেশর পুরাণত্ব। সবচেয়ে বিশুদ্ধমতে এখানে পূজা করা হয় বলে জানান তিনি। এই মন্দিরে দেবীর বিসর্জন হয় না; সারা বছরই দেবী থাকেন। পূজার সময়ে শাস্ত্রমতে সব মাঙ্গলিক কার্যক্রম পালনই মূল উদ্দেশ্য।
পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জ সড়কের দুই পাশের সব পুরোনো স্থাপনাকে ঘোষণা করা হয়েছে সংরক্ষিত ঐতিহ্য হিসেবে। লালকুঠি, রূপলাল হাউস, বিউটি বোর্ডিং—ঐতিহ্যবাহী এই তিন স্থাপনাই পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত। আর বিউটি বোর্ডিংয়ের অবস্থান প্যারীদাস রোডে। এখান থেকে খানিকটা সামনে গেলেই ছোট্ট একটা ফটক পেরিয়ে শত বছরের পুরোনো ‘শ্রীশ্রী প্রাণবল্লভ জিউ মন্দির’। মূলত গোবিন্দ পূজা করা হয় এখানে, পাশেই রয়েছে মসজিদ। ধর্মীয় সম্প্রীতির দারুণ এক সমন্বয়, ভালো লাগল।
পাশেই টিনের চালার ঘরে নির্মাণ চলছে প্রতিমার। জয় পাল, স্বপন পাল, বলয় পাল, ভক্তি পাল ও সাধন পাল সেখানে প্রতিমা তৈরি করছেন। ৩৫ বছর ধরে এখানে প্রতিমা নির্মাণ হচ্ছে। কথা হয় প্রতিমাশিল্পী সাধন কুমার পালের সঙ্গে। তিনি, জানান এবার তাঁরা ছয়টি প্রতিমার কাজ করছেন। এগুলো যাবে শ্যামবাজার শিবমন্দির, জমিদার বাড়ি মন্দির, শাঁখারীবাজার মণ্ডপ, প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব, গেণ্ডারিয়া জেলেপাড়া ও তাঁতীবাজারে।
পূজার চার দিন আগে এই প্রতিমা মণ্ডপ নিয়ে যাওয়া হবে। একেকটি প্রতিমা বানাতে ১০-১২ দিন সময় লাগে বলে জানালেন তিনি। নকশা ও প্রতিমাভেদে এক থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত মজুরি রাখা হয়।
এবার ঢাকার বাইরে রংপুরের জন্য প্রতিমা বানিয়েছেন তাঁরা। সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, মা দুর্গার প্রতিমা তৈরি করতে চারটি জিনিস আবশ্যক—গঙ্গার পলিমাটি, গোমূত্র, গোবর ও পতিতালয়ের মাটি। যদিও সাধন পাল বললেন, এসব বহু আগের কথা, এখন কিছুই নেই। এঁটেল আর বেলেমাটি দিয়েই নির্মাণ করা হয় প্রতিমা। সাভারের শিমুলিয়া থেকে আনা হয় মাটি।
ছবি: শিশির চৌধুরী