প্যারিসের অলিতে গলিতে ৪
শেয়ার করুন
ফলো করুন

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা কোনটা? এ নিয়ে মতভেদ প্রচুর। তবে আপনি যদি কোনো ফরাসিকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে চোখ বন্ধ করে সে উত্তর দেবে, ‘সঁজে লিজে’। এই যেমন আমার কাছে জানতে চাইলে আমি বলব কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ রোড। প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এই সঁজে লিজে প্যারিসের বিখ্যাত এক্স ইস্টোরিকের অংশ। এক্স ইস্টোরিক কী, সেটা বললে ব্যাপারটা বোঝা সহজ হবে। প্যারিস শহরের কেন্দ্র ধরা হয়ে থাকে ল্যুভ জাদুঘরকে। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটা সরলরেখা টানা হলে সেটা শেষ হয় লা’দিফসের গ্র্যান্ড আর্কে। রেখার মাঝামাঝি আর্ক ডি ট্রায়াম্ফের অবস্থান। সতেরো শতকে এই সরলরেখা বরাবর একটা রাস্তা নির্মাণ করা হয়, যেটিকে এক্স ইস্টোরিক (ইংরেজিতে হিস্টোরিক্যাল অ্যাক্সিস) বলা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আপনি যদি গ্র্যান্ড আর্কের সুবিন্যস্ত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে তাকান, তাহলে কনকর্ড অবেলিস্ক, আর্ক ডি ট্রায়াম্ফের চূড়া এবং ল্যুভ জাদুঘরের পিরামিড—সবই একসঙ্গে দেখতে পাবেন।

প্যারিসে সবথেকে সুন্দর রাস্তা সঁজে লিজে
প্যারিসে সবথেকে সুন্দর রাস্তা সঁজে লিজে

এই রাস্তার কনকর্ড থেকে আর্ক ডি ট্রায়াম্ফ পর্যন্ত অংশটুকুই সঁজে লিজে। বাস্তিল দিবসের প্যারেড এখানেই হয়। ২০১৮ তে বিশ্বকাপ জয়ের পর এই রাস্তাতেই ট্রফি নিয়ে উৎসব করেছিল পগবা, এমবাপ্পে ও গ্রিজম্যানরা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বাসভবন এলিসি প্রাসাদের অবস্থান এখান থেকে কাছেই। রাস্তার দুই পাশে আছে অসংখ্য থিয়েটার, রেস্টুরেন্ট ও বিলাসী পণ্যসামগ্রীর দোকান। এমনই এক দোকান গ্যালারি লাফায়েত। কেনার জন্য নয়, ঘোরার জন্য ঢুকলাম সেটায়।

বিজ্ঞাপন

দোদি আল ফায়েদের কথা কি আপনাদের মনে আছে? মিসরীয় এই ভদ্রলোক ছিলেন ইংল্যান্ডের রাজবধূ প্রিন্সেস ডায়ানার প্রেমিক। দুজনে একসঙ্গে মারা গিয়েছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায়। ঘটনাটা ঘটেছিল প্যারিসেই, ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট। তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। স্পষ্ট মনে আছে ব্যাপারটা; সারা বিশ্বেই আলোড়ন তুলেছিল। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। পত্রিকার পাতাগুলো ভর্তি ছিল দোদি আল ফায়েদের সঙ্গে প্রিন্সেস ডায়ানার প্রেম এবং ব্রিটিশ রাজপরিবারের সব মুখরোচক খবরাখবরে।
দোদি আল ফায়েদের বাবা মিসরীয় বিলিয়নিয়ার মোহামেদ আল ফায়েদের মালিকানায় অনেক কিছুই আছে, গ্যালারি লাফাইয়েত সেগুলোর একটি। এখানে কেনাকাটা করতে আসেন হলিউড তারকাসহ ধনাঢ্যরা। চারতলা বিল্ডিংয়ের প্রতিটি ফ্লোরেই কালো পোশাক এবং সানগ্লাস পরা নিরাপত্তারক্ষী। এই রাতের বেলা চোখে সানগ্লাস দিয়ে তাঁরা কী উদ্ধার করছেন কে জানে?

গ্যালারি লাফাইয়েতের ভিতরে
গ্যালারি লাফাইয়েতের ভিতরে

জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া না বলে চন্দ্রছোঁয়া বলা যায়। একটা সানগ্লাস পছন্দ হয়েছিল, দাম মাত্র ৭৯০ ইউরো (প্রায় ১ লাখ বাংলাদেশি টাকা) দেখে মানে মানে কেটে পড়েছি। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড শ্যানেলের পারফিউমের দোকানেও একটা চক্কর দিলাম। সুগন্ধির সুবাসে চারপাশ ম–ম করছে। সবচেয়ে কম দামি পারফিউমের দামও ১০০ ইউরো। হায়, বাংলাদেশে তাহলে আমরা যেসব সুগন্ধি মেখে ঘুরে বেড়াই, যেগুলোর গায়ে লেখা থাকে ‘মেড ইন প্যারিস’, সেগুলো আদতে যে কোত্থেকে তৈরি হয়ে আসে আল্লাহ মালুম। শুধু যে সস্তাগুলো জিঞ্জিরা কিংবা পুরান ঢাকা থেকে বের হয় তা নয়, ব্র্যান্ডেরগুলোও ছাড় পায় না। এই শ্যানেলের একটা পারফিউম একবার দাম করেছিলাম ধানমন্ডির আলমাস সুপার শপে। বলেছিল, ‘ভাই, আসল জিনিস নিয়ে যান মাত্র আড়াই হাজার টাকায়।’ ভাগ্যিস তখন পকেটের টাকাগুলো জলে ফেলিনি।

বিজ্ঞাপন

 আর্ক ডি ট্রায়াম্ফ চত্বরে এসে মুগ্ধ হতে হয়। বিশাল এই চত্বর থেকে দশ দিকে দশটা রাস্তা চলে গেছে। ফরাসিদের বিভিন্ন বিজয়কে উদ্‌যাপনের জন্য এবং বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে রাখার জন্য একটি স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে এটি তৈরি করা হয়েছিল ১৮৩৬ সালে। বিভিন্ন যুদ্ধের খণ্ডচিত্র চিত্রায়ণ করা হয়েছে এর বাহুগুলোতে। দিনের বেলা একরকম সুন্দর, রাতে অন্যরকম।

আর্ক ডি ট্রায়াম্পের সামনে লেখক
আর্ক ডি ট্রায়াম্পের সামনে লেখক

এর ডিজাইন করেছিলেন ফরাসি স্থপতি জঁ শালগ্রিন, যদিও ডিজাইনটি মৌলিক নয়। ইতালির আর্ক অব তিতুসের ডিজাইন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এটির ডিজাইন করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর ডিজাইন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উত্তর কোরিয়ায় আর্ক অব ট্রায়াম্ফ নির্মাণ করা হয়েছে যেটার উচ্চতা আরও ১০ মিটার বেশি। একটা মহৎ সৃষ্টির সাফল্য মনে হয় এখানেই যে সেটির অনেক প্রতিরূপ পাওয়া যায় পৃথিবীজুড়ে। যদিও সেগুলো কতটা সার্থক সৃষ্টি, তা নিয়ে আমার দ্বিমত আছে। কোনো সৃষ্টি যদি মানবকল্যাণে না–ই লাগে, তাহলে কি সেটিকে সার্থক বলা যায়?

 ফেরার পথে রাতের বেলা খুব কাছ থেকে আইফেল টাওয়ার দেখার সাধ জাগল মনে। এক ঘণ্টা পর পর টাওয়ার থেকে আলোর রোশনাই ছড়িয়ে যায় চারদিকে। স্যেন নদীর জলে সেই আলোর প্রতিফলন দেখার জন্য লোকেরা ভিড় করে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। বাস্তবিকই চমৎকার দেখায় সে দৃশ্য। মেট্রোয় করে বীর হেকিম স্টেশনে নামলাম। স্টেশন থেকে বের হওয়ার মুখেই এক দীর্ঘদেহী ইউরোপিয়ান রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ছিন্ন পোশাক, মাথায় তোবড়ানো হ্যাট। একটাই প্রশ্ন, ‘ডু ইউ হ্যাভ সিগারেট?’ না-বোধক উত্তর পেয়ে সামনে থেকে সরে গিয়ে আরেক যাত্রীর কাছে চাইল। এখানেই শেষ নয়, আইফেল টাওয়ারের আকৃতির অনেকগুলো রংচঙে চাবির রিং হাতে এক ব্যক্তি জানতে চাইলেন, আমি কিছু কিনতে পারব কি না। তাহলে তিনি বাচ্চার জন্য খাবার কিনতে পারবেন।

স্যেন নদীর জলে পড়ে কার ছায়া
স্যেন নদীর জলে পড়ে কার ছায়া

আফ্রিকান এই অধিবাসীর নাম ওমর, আলজেরিয়া থেকে এসেছেন। পর্যটকদের কাছে বিভিন্ন স্মারক বিক্রি করেই তাঁকে চলতে হয়। মুহূর্তেই আমার সামনে মুদ্রার অন্য পাশটা ফুটে উঠল। এই ঝলমলে প্যারিসেও লোকজন অনাহারে-অর্ধাহারে থাকে, মাথা গোঁজার জায়গার অভাবে হিম ঠান্ডার মধ্যেও রাস্তায় ঘুমায়। সংসারের সদস্যদের ভরণপোষণের জন্য পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পর্যটকদের পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায়। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বেই ধনী-গরিবের বৈষম্য এক নিদারুণ বাস্তবতা। পুঁজিবাদের খুব সাধারণ নীতি, সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য থাকবেই। এই বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করেই এই মতবাদের উত্থান। তা না হলে পুঁজিবাদ টিকবে কী করে?  (চলবে)

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন