মাইকেল মধুসূদন দত্তের পদচিহ্নের খোঁজে ভার্সাই নগরীতে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

মানুষমাত্রই স্মৃতিকাতর হতে পছন্দ করেন। বিশেষ করে প্রবাসজীবনে সেটা প্রকট হয়ে ধরা দেয়। সাধারণ মানুষের স্মৃতিকাতরতা কিছু আবেগ আর অযৌক্তিক উচ্ছ্বাসে শেষ হয়। আর কবি–সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে সেটা হয় অসাধারণ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতে ওঠা। বাংলার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ফরাসি দেশের জীবন আমাদের উপহার দিয়েছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম চতুর্দশপদী কবিতাগুচ্ছ, যার প্রতিটি ছত্রে কবির দেশাত্মবোধ আর নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা বিমূর্ত হয়ে উঠেছে। ইতালীয় কবি পেত্রার্ক কবিতার যেই ধারার সূচনা করেছিলেন, মধুসূদন সেটিকে করেছেন আরও ঋদ্ধ।

সন্ধ্যার আগমুহূর্তে প্রাসাদে ফাঁকা আঙিনা
সন্ধ্যার আগমুহূর্তে প্রাসাদে ফাঁকা আঙিনা

যাহোক, প্যারিস থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের শহর ভার্সাই। এই শহরেই আছে বিখ্যাত ভার্সাই প্রাসাদ যেটি কি না প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে ছিল ফরাসি রাজাদের বাসস্থান এবং বর্তমানে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ল্যুভ জাদুঘরের পর এটিই ফ্রান্সের সর্বাধিক দর্শনীয় স্থান। লাইন ধরে টিকিট কেটে লোকজন এই প্রাসাদ দেখতে আসেন। সহকর্মীরা আমাকে পইপই করে বলে দিয়েছিল ভার্সাই প্রাসাদ দর্শন ব্যতীত যেন প্যারিস না ছাড়ি। সত্যি বলতে কী ভার্সাই আসার ব্যাপারে আমার যতটা না উদ্দেশ্য ছিল প্রাসাদ দেখা, তার চেয়েও বেশি ইচ্ছা ছিল মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের পদচিহ্ন অনুসরণ করা। ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫ সালের ভেতর ভার্সাইয়ের দুটি জায়গায় তিনি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থেকেছিলেন। আমার প্রবল ইচ্ছা ছিল সেই দুটি জায়গা ছুঁয়ে আসা, কবির সময়কাল এবং উপস্থিতিকে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও অনুভব করা।

বিজ্ঞাপন

মধুসূদনের প্রবাসজীবন সুখের ছিল না। ধর্ম পরিবর্তনের দরুন পিতার কাছ থেকে পরিত্যাজ্য হওয়ায় তিনি ছিলেন কপর্দকশূন্য। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে এসে যখন দেখলেন খরচে কুলাচ্ছে না, তখন ফ্রান্সের ভার্সাইতে চলে এলেন কম খরচে জীবন অতিবাহিত করার জন্য। এখানেও বিপদ পিছু ছাড়েনি। এককালের জমিদারপুত্র যিনি ছিলেন বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত, যিনি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গাড়োয়ানকে কখনো গুনে টাকা দেননি, যিনি কিনা বেশভূষায় ছিলেন ভীষণ পরিপাটি; সেই মধুসূদন স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে নিয়ে দুই কক্ষের এমন এক ছোট্ট বাসায় থাকতেন যেখানে আলাদা টয়লেট কিংবা গোসলখানাও ছিল না। মধুসূদনের স্ত্রী হেনরিয়েটার প্রশংসা করতে হয়। এই নিদারুণ কষ্টের মধ্যেও তিনি স্বামীকে সঙ্গ দিয়েছেন, মানসিকভাবে শক্ত রেখেছেন।

ভার্সাই এর মেট্রো স্টেশন
ভার্সাই এর মেট্রো স্টেশন

এই সময়কালের মধ্যেই কবি ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, ইতালি ও পর্তুগিজ ভাষা আয়ত্তে এনেছিলেন এবং চতুর্দশপদী কবিতার বেশির ভাগই রচনা করেছিলেন। তীব্র অর্থকষ্ট কবির প্রতিভার স্ফূরণ আটকাতে পারেনি। অভাব এতটাই তীব্র ছিল যে মধুসূদনকে মানুষের কাছ থেকে ধার নিয়ে চলতে হতো। ধার শোধ করতে অপারগ হওয়ায় একবার তো জেলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলেন। প্রতিবেশী এক ফরাসি নারী আর্থিক সাহায্য করায় রক্ষে হয়েছিল। এছাড়াও স্থানীয় চার্চ এবং আশপাশের লোকদের থেকেও সাহায্য পেয়েছিলেন। তাই তো বিভিন্ন চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ জায়গা এই ফ্রান্স ও এদেশের মানুষ, আমি শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে এত উচ্চমানের দেশ ও মানবদরদী মানুষ কোথাও দেখিনি।’ মধুসূদনের ভার্সাই জীবনের কষ্টের বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর জীবনীকার গোলাম মুরশিদের ‘আশার ছলনে ভুলি’ গ্রন্থে।

বিজ্ঞাপন

‘ভার্সাইতে তাঁর জীবনের পরবর্তী আড়াই বছরের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, তিনি সেখানে কোনো কাজ পাননি। সামান্য যে টাকা-পয়সা তখনো হাতে ছিল, তা দিয়ে যাতে সবচেয়ে বেশি সময় টিকে থাকা যায়, তার জন্য তিনি অথবা হেনরিয়েটা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। জানুয়ারি মাস নাগাদ তাঁর যে সঞ্চয় ছিল, সেটি ফুরিয়ে যায়। তারপর থেকে জমতে থাকে দেনা। তিনি বাসা ভাড়া করেছিলেন রু দ্য শঁতিয়ের নামে একটি রাস্তার ১২ নম্বর বাড়িতে। তিনতলা এই বাড়ি ছিল নিতান্তই ছোট্ট এবং ওই বাড়িতে থাকত ১৮টি পরিবার। ভার্সাইয়ের সরকারি আর্কাইভসে রক্ষিত নথি থেকে দেখা যায়, ১৮৬৪-৬৭ সালে এই বাড়ির মোট ১৮টি পরিবারের মধ্যে ১২টি পরিবার দাতব্য তহবিল থেকে অর্থ সাহায্য নিয়েছিল। এর থেকে বোঝা যায়, তিনি কত নিচু মানের এবং সস্তা একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন এবং পড়শি হিসেবে তিনি কোন ধরনের লোকদের পেয়েছিলেন।’

শহর জুড়ে আছে চমৎকার সব স্থাপনা
শহর জুড়ে আছে চমৎকার সব স্থাপনা

পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দেশ থেকে টাকা পাঠানোয় মধুসূদনের অর্থাভাব লাঘব হয় এবং তিনি বাড়ি বদল করে ভার্সাই প্রাসাদের কাছাকাছি রু দ্য মোপাসা নামক জায়গায় চলে আসেন। ১৮৬৭ সালে কবি দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে যোগদান করলেও তাঁর পরিবার ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত ভার্সাইতেই ছিল।

ভার্সাইতে আমার যাওয়া হয়েছিল দুই বার। প্রথম দিন অফিস শেষ করে, পরেরবার ছুটির দিনে। হোটেলের নিচ থেকে ৬ নম্বর মেট্রোতে করে প্রথমে মঁপারনাস, সেখান থেকে শঁতিয়ের স্টেশন। এখান থেকে হাঁটা শুরু করলাম রু দ্য শতিয়েরের যে জায়গায় মধুসূদন থাকতেন সেটির খোঁজে। প্রথম আলোয় প্রবাসী শিল্পী পার্থপ্রতিম মজুমদারের এক লেখায় এই দিকনির্দেশনাটুকু পেয়েছিলাম। এখানে এসে মার্গারিটকে নিয়ে ঘুরে গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমিককে নিয়ে ঘুরে গেছেন তসলিমা নাসরিন, এমনকি কবি নির্মলেন্দু গুণও মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন।

এই পথ দিয়েই হয়ত হেঁটেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত
এই পথ দিয়েই হয়ত হেঁটেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত

যদ্দুর জানি, ত্রিতল ভবনটির নিচতলায় ভারতীয় দূতাবাসের উদ্যোগে ১৯৬৭ সালে মধুসূদনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি ব্রোঞ্জের ফলক স্থাপন করা হয়েছিল। আদতে সেটিরই খোঁজ করছিলাম। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে প্রায় ঘণ্টাখানেক খুঁজেও ১২ নম্বর রু দ্যা শঁতিয়েরের খোঁজ পাইনি। অবশ্য সন্ধ্যার পুরো সময়টা ব্যর্থ হয়েছে বলা যাবে না। ভার্সাই শহরের সৌন্দর্য তো আস্বাদন করা গেল। শহরটা এমনিতেই সুন্দর। রাস্তার দুই ধারের উঁচু উঁচু বৃক্ষরাজি আর ছবির মতন সাজানো বাড়িঘর সেই সৌন্দর্য বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম এই পথ দিয়েই  দেড় শ বছর আগে হেনরিয়েটাকে পাশে নিয়ে হেঁটেছেন মধুসূদন দত্ত।

পরে অবশ্য জেনেছিলাম কেন আমি রু দ্য শঁতিয়ের খুঁজে পাইনি। এই নামে বর্তমানে কোনো রাস্তা ভার্সাইতে নেই। যেটি ছিল সেটির নাম বদলে হয়েছে ১২ নম্বর রু দ্য লা এতা জেনেরো। আশপাশে জিজ্ঞাসা করার মতো কাউকে পাইনি। অবশ্য পেলেও খুব একটা লাভ হতো বলে মনে হয় না। দেড় শ বছর আগের এই বঙ্গসন্তানকে দেশের মানুষই ঠিকমতো মনে রাখেনি আর আমি কিনা আশা করছি ফরাসি জনগণ তাঁকে মাথায় তুলে রাখবে।

টিকেট কাউন্টারে পর্যটকদের লম্বা সারি
টিকেট কাউন্টারে পর্যটকদের লম্বা সারি

এখান থেকে মিনিট বিশেক হাঁটলেই ভার্সাই প্রাসাদ। সোনালি রঙের প্রাসাদটি পশ্চিমাকাশে ডুবুডুবু সূর্যকিরণে ঝলসে যাচ্ছিল। প্রাসাদের বাইরে বিশাল ফাঁকা জায়গা। কিছু গাড়ি পার্ক করে রাখলেও মানুষ চোখে পড়ল না। দর্শনার্থী প্রবেশের সময় পেরিয়েছে আগেই। চারপাশটা ঘুরে দেখতেই ভালো লাগছিল। বাইরে থেকেই এত সুন্দর, ভেতরের সৌন্দর্যের যেই বর্ণনা শুনেছি, বাস্তবে নিশ্চয়ই তার কম হবে না। রাজা ষোড়শ লুইয়ের ঘোড়ায় আরোহণ করা ভাস্কর্য ফাঁকা চত্বরের সৌন্দর্য বর্ধন করছে। এই প্রাসাদের কাছেই কোথাও বাসা বদলে এসেছিলেন মধুসূদন। তিনি প্রায়ই প্রাসাদের ভেতরের বাগানে ঘুরতেন। সম্ভবত এখানকার সৌন্দর্যই কবিকে যশোরের সাগরদাঁড়ির কথা মনে করিয়ে দিত। সেই সঙ্গে স্যেন নদীর প্রবাহ মনে জাগ্রত করত কপোতাক্ষ নদের কলতান, যা কিনা প্রকাশ পেত কবিতায়।

দ্বিতীয়বার অন্যভাবে ভার্সাইয়ের উদ্দেশে যাত্রা করি। ১০ নম্বর মেট্রোতে করে প্রথমে জাভেল আদ্রে সিত্রে, সেখান থেকে আরইআর-সি ধরে ভার্সাই শাতো রিভ গোশ স্টেশন। এই স্টেশনটা একদম ভার্সাই প্রাসাদ লাগোয়া। পথে এক জায়গায় থেমেছিলাম। আগেরবার ফিরবার পথে মেট্রোর জানালা দিয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি চোখে পড়েছিল। একটু অবাক হওয়ারই কথা। আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি ফ্রান্সে এলো কোত্থেকে?

আমেরিকা থেকে ফ্রান্স সরকারকে উপহার দেওয়া স্ট্যাচু অফ লিবার্টির প্রতিরূপ
আমেরিকা থেকে ফ্রান্স সরকারকে উপহার দেওয়া স্ট্যাচু অফ লিবার্টির প্রতিরূপ

নিউইয়র্কে যেই স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখা যায়, সেটি ফ্রান্স সরকারই ১৮৮৬ সালে উপহার দিয়েছিল আমেরিকাকে। বিনিময়ে ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীর উপহার হিসেবে আমেরিকা সরকার ফ্রান্সকে এই স্ট্যাচু অব লিবার্টির একটা ছোট প্রতিরূপ পাঠায়, যেটি কি না প্য দি গ্রেনেল নামক জায়গায় স্যেন নদীর ঠিক মাঝামাঝি ৮৫০ মিটার দৈর্ঘে৵র এক কৃত্রিম দ্বীপের প্রান্তসীমায় স্থাপন করা হয়। কিছুটা হতাশ হয়েছি এখানে এসে। লোকজন মনে হয় ঘুরতে আসে না। প্যারিসের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান যেমন ঝকঝকে তকতকে, সেই তুলনায় এখানটা বেশ বিবর্ণ। অনেকটা গরিবের স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতন আরকি। সম্ভবত এটার অরিজিনাল ভার্সন আমেরিকায় আছে বলেই ফরাসি সরকার কিংবা জনগণ এর প্রতি ততটা আগ্রহী নয়। আমার তাতে বয়েই গেছে। আমেরিকায় কখনো যেতে পারব কিনা জানি না, তাই ফ্রান্সের স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখেই না হয় শখ মেটাই।

বসন্তের পর শীতের প্রকোপ কমেনি। রিভ গোশ স্টেশন থেকে প্রাসাদ অভিমুখে যাওয়ার পথে ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি পায়ের নিচে এক অদ্ভুত দ্যোতনার সৃষ্টি করে। গাছে গাছে নতুন পাতার রাজত্ব, সেই রাজত্বে অনাহুত আগন্তুকের মতো ভাগ বসিয়েছে নাম না জানা পাখির দল। দূর থেকেই বোঝা যায় ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের বান ডেকেছে। প্রতিবছর প্রায় দেড় কোটি দর্শনার্থী এখানে ঘুরতে আসেন। মৌসুমি স্মারক বিক্রেতাদের হাঁকডাকে চারপাশ সরগরম। বেশির ভাগই আফ্রিকান। চাবির রিং, রেফ্রিজারেটরে লাগানোর চুম্বকীয় স্টিকার কিংবা আইফেল টাওয়ারের রেপ্লিকা নিয়ে ঘুরছেন। এক ফুট লম্বা ব্রোঞ্জ রঙা একটা আইফেল টাওয়ার মনে ধরল। সুইচ টিপলেই টাওয়ারের এমাথা–ওমাথা বাতি জ্বলে। দাম কত জানতে চাইলেই বলল, ‘অনলি তেন ইউরো, ভেরি চিপ।’ এই জিনিস ১০ ইউরো খরচ করে নেওয়ার মানেই হয় না। চলে যেতে চাইতেই জিজ্ঞাসা করল,
‘হাউ মাচ?’
‘ওয়ান ইউরো’
‘নো নো, ফাইভ ইউরো’
‘টু ইউরো’
‘ওকে ডান’
মনের ভেতর খচখচ শুরু করল ঠকলাম কি না। পরে অবশ্য দেখেছি, এই জিনিস ৪ ইউরোর কমে কোনো দোকানে পাওয়া যায় না। ১ ইউরো দিয়ে ১০টা চাবির রিংও নিলাম, সবগুলোই এক ইঞ্চি উচ্চতার বিভিন্ন রঙের আইফেল টাওয়ার। পরিচিত মানুষজনের অভাব নেই। উপহার পেলে খুশিই হবে।

আগের দিন এসে যেই দরজা বন্ধ দেখেছিলাম, সেটি আজ খোলা। বিশাল চত্বরে মানুষ গিজগিজ করছে। দুটি লাইন—একটি টিকিটের, আরেকটা প্রাসাদে প্রবেশের। টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, মানুষ এত খরচ করে প্রাসাদ বানায় কেন? কত দিনই বা সে ভোগ করতে পারে। এই যেমন ভার্সাই প্রাসাদের কথাই ধরা যাক। রাজা ত্রয়োদশ লুই শিকারের উদ্দেশ্যে এই ভবন প্রথমে নির্মাণ করেন। সেটি ১৬২৩ সালের কথা। পরে সাধারণ ভবনটিকে তিনি শাতোতে রূপ দেন ১৬৩৫ সালে। রাজা চতুর্দশ লুই চিন্তা করলেন এটিকে নিজ বাসভবন বানাবেন। রাজা নিশ্চয়ই সাধারণ কোনো ভবনে থাকবেন না। অতএব আনো আর্কিটেক্ট, সাজাও মনের মতো করে। আনা হয় ১ হাজার ৪০০ ঝরনা এবং ৪০০ নতুন ভাস্কর্য।

প্রাসাদের আঙিনায় পর্যটকদের পদচারনা
প্রাসাদের আঙিনায় পর্যটকদের পদচারনা

ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট দিয়ে পুরো বাগানটির ডিজাইন করা হয়। ১৬৮২ সালে রাজা শাসনকেন্দ্র ভার্সাইতে সরিয়ে আনেন। দ্বিতীয় তলার কাজ শুরু হয় এবং সুদৃশ্য আয়নাঘরটিও নির্মাণ করা হয়। লেওনার্দো দা ভিঞ্চিসহ বিভিন্ন বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম দিয়ে প্রাসাদের দেয়াল সজ্জিত করা হয়। কিন্তু চতুর্দশ লুইয়ের সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগের আগেই ১৭১৫ সালে পরপারে পাড়ি জমান। ক্ষমতায় আসেন রাজা পঞ্চদশ লুই। ৩৬ হাজার শ্রমিক নিয়ে ভার্সাইয়ের সৌন্দর্যবর্ধন চলতেই থাকে। ১৭৭৪ সালে পঞ্চদশ লুই মারা গেলে তাঁর নাতি ষোড়শ লুই ক্ষমতায় আসেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল এই প্রাসাদেই। সে জন্যই কি না, বিভিন্ন যুদ্ধে পর্যদুস্ত ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গিন হওয়া সত্ত্বেও ভার্সাই প্রাসাদের সৌন্দর্যবর্ধন থেমে থাকেনি। ওদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজপরিবারের বিরুদ্ধে জমতে থাকে ক্ষোভ, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে।

খাদ্যের দাবিতে বিক্ষুব্ধ প্রজাদের একটি দল রাজপ্রাসাদে হামলা করে। জনতা রাজা এবং রানীকে বাধ্য করে রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ করে তাঁদের সঙ্গে প্যারিস ফিরে যেতে। সেই সঙ্গে প্রাসাদে চলে লুটপাট। এরপর দীর্ঘদিন এই প্রাসাদ পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মাঝখানে কিছুদিন এটিকে তাঁর গ্রীষ্মকালীন আবাস হিসেবে ব্যবহার করলেও সংস্কার করেননি। ১৮৩০ সালে ফ্রান্সে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলে এর সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এটি ফ্রান্সের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত হচ্ছে।  

লাইন এগোচ্ছে শ্লথগতিতে। ওদিকে বাড়ছে রোদের উত্তাপ। যদিও এই তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ফ্রান্সের লোকজন স্বাগত জানাতে কসুর করে না। হাজার হলেও শীতের দেশ বলে কথা। সময় যাচ্ছে দর্শনার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। সাধারণভাবে আগত দর্শনার্থীদের শতকরা ৮০ ভাগই ফ্রান্সের বাইরে থেকে আসেন এবং এই প্রাসাদ না দেখে কেউ ফ্রান্স ছাড়তে চান না। কেমন অদ্ভূত একটা ব্যাপার। রাজতন্ত্রের সমর্থক খুঁজে পাওয়া আজকালকার দিনে দুষ্কর অথচ রাজাদের ঐতিহ্য কিংবা স্মৃতিচিহ্ন দেখার জন্য সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল হঠাৎ। আমার স্ত্রীর খুব শখ ভার্সাই প্রাসাদ দেখার। আগের রাতেও বলছিল, ‘তুমি যেহেতু যাচ্ছ, ভালো করে দেখে এসে আমার কাছে গল্প করবে। আমার কোনোদিন যাওয়া হবে কি না, তা জানি না। তোমার চোখেই না হয় দেখে নিলাম।’ টিকিট কাউন্টারে আর ছয় কি সাতজনের পরেই আমার ডাক আসবে। চারপাশের মানুষজনকে অবাক করে দিয়ে লাইন ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, সেদিনই ভার্সাই দেখব যেদিন আমার পাশে থাকবে মৌ। কিছু আনন্দ জীবনসঙ্গীকে পাশে নিয়েই উপভোগ করতে হয়। না হয় সেই দিন পর্যন্ত অপেক্ষাই করলাম।
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ১১: ০০
বিজ্ঞাপন