দ্বীপরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়ার চারদিকেই সমুদ্র। আর দ্বীপজুড়ে রয়েছে এক বিশাল প্রাকৃতিক এবং ভৌগোলিক বৈচিত্র্য। দেখে মনে হয় একটা দেশের মধ্যেই যেন একটা মহাদেশ বিদ্যমান। অস্ট্রেলিয়ার বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীর বসবাস উপকূলীয় অঞ্চলে। উপকূলীয় অঞ্চলে বিশাল বিশাল উঁচু উঁচু পাহাড়। আর তার পাদদেশেই আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ। সমুদ্র এসে যেন অবিরাম পাহাড়ের পা ধুয়ে দিচ্ছে। চারদিকে সমুদ্র থাকায় ছুটির দিনগুলোতে অস্ট্রেলিয়ানরা চলে যায় সৈকতে। অথবা বেরিয়ে পড়ে পাহাড়ে হাঁটাহাঁটি করতে। পাহাড়ে হাঁটাহাঁটি করাকে অস্ট্রেলিয়ানরা বলে ‘বুশ ওয়াক’। আমরা বাস করি নিউ সাউথওয়েলস প্রদেশে। জায়গাটা সিডনি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে, নাম মিন্টো। বুশ ওয়াক করার জন্য এখানে সরকারিভাবে একটা এপ আছে তার নাম ‘এনএসডব্লিউ পার্কস’। আমরা এই এপ ধরে বুশ করি।
বুশ ওয়াক কাঠিন্যের দিক দিয়ে মোট পাঁচটি গ্রেডে বিভক্ত। গ্রেড যত বেশি সেটা তত কঠিন এবং সেটা শেষ করতে তত বেশি অভিজ্ঞতা এবং শারীরিক সুস্থতা প্রয়োজন। গ্রেড এক-এর জন্য কোনো ধরনের পূর্ব অভিজ্ঞতার দরকার নেই এবং এগুলোর দৈর্ঘ্য পাঁচ কিলোমিটারের কম। পথে কোনো উঁচু-নিচু বা খাড়া ঢাল নেই এতে। গ্রেড দুই-এর জন্যও কোনো অভিজ্ঞতা দরকার নেই। পথ সামান্য উঁচু-নিচু হতে পারে এবং দৈর্ঘ্য অনূর্ধ্ব ১০ কিলোমিটার। গ্রেড তিন-এর জন্য কিছু অভিজ্ঞতার দরকার আছে, কারণ পাহাড়ি পথে ঢাল থাকতে পারে। এগুলোর দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের মধ্যে। গ্রেড চার-এর জন্য অভিজ্ঞতা দরকার, কারণ পথ অনেক দীর্ঘ হতে পারে এবং পথে অবশ্যই খাড়া ঢাল থাকবে। গ্রেড পাঁচ-এর জন্য অবশ্যই পূর্ব অভিজ্ঞতা জরুরি, কারণ এখানে দিকনির্দেশনা এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবার দরকার হতে পারে। পথ হতে পারে খুবই উঁচু-নিচু এবং অনির্দেশিত। ফিগার এইট পুলস-এর বুশ ওয়াক গ্রেডিং চার।
অনেক দিন ধরেই পরিকল্পনা করছিলাম ‘ফিগার এইট পুলস’-এ যেতে, কিন্তু ব্যাটে-বলে হয়ে উঠছিল না। কারণ ফিগার এইট পুলে যেতে গেলে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়। অনুকূল শুকনা আবহাওয়ার পাশাপাশি নজর রাখতে হয় সমুদ্রের ঢেউয়ের আকারের ওপরও। কখন ঢেউ উঁচু থাকবে, কখন নিচু থাকবে—এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উঁচু ঢেউয়ের সময় গেলে ফিগার এইট পুল দেখা যাবে না। আমরা অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে এইবারের স্কুল হলিডেতে সেই অবসর মিলে গেল। আর আমারও সেদিন ছুটি ছিল এনজেক ডে উপলক্ষে।
এপে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম ওই দিন কম টাইড থাকবে। আমরা সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ফিগার এইট পুলস সিডনির রয়াল ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত। আমাদের বাসা থেকে ওখানে যেতে ঘণ্টা খানেকের ড্রাইভ আর সিডনি শহর থেকেও একই সময় লাগবে। গারাওয়ারা ফার্ম কার পার্কে আপনি গাড়ি পার্ক করতে পারবেন। ২৪ ডলার দিয়ে একটা এক দিনের পাস কিনে নেওয়া ভালো।
গাড়ি পার্ক করে ব্যাকপ্যাক পিঠে নিয়ে আমরা বনের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাসা থেকেই কয়েকটা পানির বোতল আর শুকনা খাবার দিয়ে ব্যাগটা গুছিয়ে এনেছিলাম। আমরা সবাই হাঁটার জুতা পরে এসেছিলাম। কারণ পুলে যেতে এবং আসতে সব মিলিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা হাঁটা লাগবে। শুরুতেই সাইনবোর্ডে ওখানকার নিরাপত্তা-সংবলিত বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। সামান্য কিছুদূর যাওয়ার পরই রাস্তা ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করল। এর মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় কাঠের সিঁড়ি আছে। যেতে যেতে ফিরে আসা মানুষদের সঙ্গে আমরা শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলাম আর জানতে চাচ্ছিলাম তাদের কেমন লাগলে। সবাই একটা কথায় বলছিল, কষ্টকর কিন্তু খুবই আনন্দদায়ক। অস্ট্রেলিয়ার ভাষায় ‘ওর্থ ইট’।
এরপর একসময় রাস্তা-বন পেরিয়ে সবুজ ঘাসের মধ্যে এসে পড়ল। এখানে সিমেন্টের এক ধরনের জালির উঁচু পাটাতন বসানো। এর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। সবুজ ঘাস পেরিয়ে দূরের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। আর পাহাড়ের পাদদেশেই দেখা যাচ্ছিল গাঢ় নীল পানির সমুদ্র। মনে হচ্ছিল যেন পাহাড়ের গায়ে মাথা রেখে সমুদ্র ঘুমিয়ে আছে। সাগরের নীল আর পাহাড়ের সবুজের এক সুন্দর মিতালি এখানে। চাইলেই আপনি এখানে বসে মনপ্রাণ ভরে এই দৃশ্যগুলো দেখতে পারেন। নিচে নামার ঢালু রাস্তাটা ধরে আমরা যেন পাখির মতো উড়ে নিচে নামছিলাম। ছেলেমেয়েকে বললাম, ফিরতে হবে কিন্তু এই পথেই, তাই শক্তি বাঁচিয়ে রাখো।
এরপর রাস্তাটা বেঁকে ফিগার এইট পুলের দিকে যায়। এই রাস্তার পাশেও বসতি আছে। কিছু মানুষ এখানে বসবাস করেন। কিছুদূর যাওয়ার পরই সৈকত। যাওয়ার সময় দেখলাম লাইফগার্ড নেই, কিন্তু ফেরার সময় দেখলাম ওরা আছে। আপনি শুরু থেকে এ পর্যন্ত এলেও হাঁটাটা খুবই উপভোগ করবেন। সৈকত পেরিয়ে শুরু হয় পাথুরে পথ। সমুদ্রের উঁচু পাড়ের নিচের পাথরের মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে আপনাকে যেতে হবে। এখানে পা ফেলতে হবে সাবধানে। কারণ অনেক সময় পাথরের গায়ে বালু থাকে, ফলে পা পিছলে যেতে পারে। এ ছাড়া কিছু জায়গায় একেবারে পাড়ের ঢাল বেয়ে যেতে হবে।
সৈকতের পর পুরোটা রাস্তাই পাথুরে। দুটি বাঁক পার হওয়ার পর দেখা মিলবে কাঙ্ক্ষিত ফিগার এইট পুলের। ফিগার পুলের বিশেষত্ব হচ্ছে এটি দেখতে হুবহু ইংরেজি সংখ্যা এইটের মতো। দুটি পুল পাশাপাশি। একটা হুবহু এইটের মতো অন্যটা একটু লম্বাটে। আকৃতিতে খুবই ছোট। তবুও মানুষ এখানে এসে পানিতে নেমে পড়ে স্মৃতি সঞ্চয় করে নিচ্ছেন। আমরাও পানিতে নামার প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাচ্চারা নামতে চাইল না। অবশেষে পুলের পাড়ে হেঁটে পানিতে পা ভেজানো হলো। ওখানে পাথরের ওপর বসে বিশ্রাম করার চমৎকার জায়গা আছে। সূর্যটা উঁচু পাড়ের ওপর আটকা পড়ে জায়গাটাকে সুশীতল ছায়া দিচ্ছে।
আমরা পাড়ের ছায়ায় পাথরের ওপর বসে বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। আর সঙ্গে আনা খাবার খেয়ে ফেরার শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম। যদিও বলা ছিল তখন ঢেউ ছোট থাকবে কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ একটা–দুইটা বড় ঢেউ এসে পড়ছিল আর পুলের পাড়ে দাঁড়ানো মানুষদের ধাক্কা দিয়ে পুলে ফেলে দিচ্ছিল। যদিও অনাকাঙ্ক্ষিত, তবুও সবাই ব্যাপারটা উপভোগ করছিল। আমাদের সামনে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা এবং তরুণী জিজ্ঞেস করলেন, পুলটা কোথায়। আমি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম। ওনারা ধন্যবাদ দিয়ে পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। এরপর হঠাৎ একটা বড় ঢেউ এসে ওনাদের পুলে ফেলে দিল। আমি দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে ওনাদের পানি থেকে টেনে তুললাম আর বললাম ভালোই হলো, আপনারা ফিরে গিয়ে সবাইকে এই পড়ে যাওয়ার গল্প করতে পারবেন। তাঁরা আমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, ভালোই বলেছ তুমি।
আমরা আরও কিছুক্ষণ বসে ফেরার পথ ধরলাম। সৈকত পেরিয়ে পাহাড় বেয়ে ওঠার সময়টা খুবই ক্লান্তিকর। দম ধরে রাখা খুবই কঠিন। একটু পরপরই ছেলেমেয়ে দুজন বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। আমাদের পাশ দিয়ে দেখলাম দুজন ভদ্রলোক বিশাল আকারের ব্যাকপ্যাক নিয়ে ধীরলয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আলাপ করে জানতে পারলাম তাঁরা তাসমানিয়াতে সাত দিনের একটা বুশ ওয়াকে যাবেন। তারই প্রস্তুতি হিসেবে তাঁরা প্রতি সপ্তাহান্তে একটা করে বুশ ওয়াক করছেন এই বিশাল ব্যাগ নিয়ে। কারণ তাঁরা যেখানে যাবেন, সেখানে একবারে সাত দিনের খাবার নিয়ে বের হতে হবে। আর সেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্কও থাকবে না। উল্লেখ্য, ফিগার এইট পুলের এখানে বেশির ভাগ সময়ই আপনি নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবেন।
এভাবে পানি খেতে খেতে আমাদের বোতলের পানি প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল। এটা দেখে তাঁরা বললেন তোমাদের কি পানি লাগবে, তাহলে আমার কাছ থেকে নিতে পারো। বলেই একজন ব্যাকপ্যাক নামিয়ে সেখান থেকে এক বোতল পানি বের করে দিলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন এতে হবে নাকি আরও এক বোতল নেবে। আমি বললাম, আশা করি হয়ে যাবে। তখন তিনি বললেন, যদি কার পার্কে গিয়ে দেখা হয়, তাহলে আমি তোমাদের আমার গাড়ির ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি দিতে পারব। আমরা তাঁদের ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেলাম। অনেকেই তখনো পুলে যাচ্ছিলেন, আমরা তাঁদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে কার পার্কের দিকে এগোচ্ছিলাম।
সিডনিতে এ পর্যন্ত আমরা যতগুলো বুশ ওয়াক করেছি, তার মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে সুন্দর বুশ ওয়াক। গাড়িতে চড়ে বসার পর ছেলে–মেয়ে দুজনই স্বীকার করল, ভ্রমণটা কষ্টকর হলেও অনেক উপভোগ্য ছিল। আর আমার জন্য প্রতিটি ভ্রমণই এক নতুন অভিজ্ঞতা। নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং তাদের গল্প জানাটা আমি খুবই উপভোগ করি। আর প্রতিবারই মানুষের মানবিকতায় মুগ্ধ হই। কারণ দিন শেষে আমরা সবাই একই পৃথিবীতে বসবাস করি এবং একই প্রকৃতির কোলে একই আলো–বাতাসে বেড়ে উঠি।
ছবি: লেখক