একটি লাল–সবুজ টুপির গল্প
শেয়ার করুন
ফলো করুন

বাংলাদেশি হিসেবে লাল-সবুজ রঙের প্রতি আমাদের আলাদা একটা ভালোবাসা আছে। কেননা এই দুই রং আমাদের দেশের জাতীয় পতাকায় ব্যবহার করা হয়েছে, যা ছোটবেলা থেকেই আমাদের মাথায় গেঁথে আছে। স্কুলে সকালের অ্যাসেম্বলি, জাতীয় সংগীত গাওয়া এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলনের স্মৃতি হয়তো এখনো অনেকের মনে আছে। তার ওপর আছে জাতীয় দিবসগুলোয় পতাকার ছড়াছড়ি অথবা ক্রিকেট ম্যাচে লাল-সবুজের বাড়বাড়ন্ত।

এবার ক্রিস্টমাসের ছুটিতে গিয়েছিলাম উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কোর মারাক্কেশ শহরে। হোটেল নিয়েছিলাম এই শহরের ঐতিহাসিক মদিনা ডিস্ট্রিক্টে, যা দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের পুরান ঢাকার মতো। তবে এটা আরও বেশি পুরোনো, কেননা এই শহরের উৎপত্তি ১০৭০ খ্রিষ্টাব্দে। আর এর অলিগলিও অনেক বেশি জটিল। এটাই শহরের মূল পর্যটন এলাকা এবং এর বড় অংশজুড়েই চলে পর্যটনকেন্দ্রিক কাজ–কারবার ও ব্যবসা–বাণিজ্য।

২০ কিলোমিটারের মতো প্রাচীন শহর প্রতিরক্ষা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই মদিনা ডিস্ট্রিক্ট। প্রাচীন এই প্রতিরক্ষা প্রাচীর বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই বলে শত শত বছর ধরে চারদেয়ালের ভেতরটা হয়ে উঠেছে গোলকধাঁধার মতো জটিল। ১৯৮৫ সালে মদিনা ডিস্ট্রিক্টেকে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, অর্থাৎ বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে এটাকে এখন আর পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, যেমন আছে তেমন করেই রক্ষা করতে হবে। প্রাচীরের বাইরের নতুন শহর আর প্রাচীরের ভেতরের পুরোনো শহরের মধ্যে তাই আসমান ও জমিন পার্থক্য।

বিজ্ঞাপন

মারাক্কেশে গিয়ে আমি মদিনার মার্কেটগুলোতেই ঘোরাঘুরি করে বেশি সময় কাটিয়েছি। ঢাকার গাউছিয়া মার্কেট এবং নিউমার্কেটের এক্সটেনশনের মতো কয়েক শ মার্কেট পাশাপাশি যোগ করলে যা দাঁড়াবে, সেটাই হলো মদিনার অলিগলিতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা সুক বা মার্কেট। এখানে ঢুকলে পথ হারানোটা খুবই স্বাভাবিক। আমি অবশ্য অভিজ্ঞ একজনের কাছ থেকে পাওয়া টিপস ফলো করেছি। তার কথায়, ইংরেজি প্রবাদে যেমন বলে সব রাস্তাই রোমের দিকে যায়, এখানেও তেমনি সব গলিই জামা এল-ফিনার বিশাল চত্বরে গিয়ে মিশেছে, অর্থাৎ রাস্তা হারালেও চিন্তার কিছু নেই, নাক বরাবর একদিকে হাঁটলেই মূল চত্বরে পৌঁছে যাওয়া যাবে। সেখান থেকেই আবার বড় রাস্তায় যাওয়া যায়।

মদিনার হাজার হাজার দোকানের লাখ লাখ জিনিসপত্র দেখাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। কিছু কেনার পরিকল্পনা যদিও ছিল না, তবু দু–একটা জিনিস হঠাৎ করে ভালো লাগলে সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখেছি। এই যেমন ছবির এই লাল-সবুজ টুপি। হাতে বোনা উলের এ রকম টুপি আগে কখনো দেখিনি। রঙের কারণেই কি না জানি না, তবে দূর থেকে দেখেই ভালো লেগে যায়। মরক্কোর জাতীয় পতাকার রংও অবশ্য লাল-সবুজ। তবে আমাদের সঙ্গে পার্থক্য হলো, আমাদের দেশের পতাকার জমিন বাংলার দিগন্তজোড়া সবুজ ফসলের মাঠ এবং মধ্যখানের লাল বৃত্ত রক্ত দিয়ে অর্জন করা স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে। আর মরক্কোর পতাকার লাল জমিন তাদের পূর্বপুরুষদের রক্ত এবং ঐক্যের প্রতীক এবং মধ্যখানের সবুজ তারা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের প্রতিনিধিত্ব করে।

যাহোক, আমি দোকানের ভেতরে ঢুকে কোনায় পড়ে থাকা টুপিটা নেড়েচেড়ে দেখছি, এমন সময় দোকানের বাইরে থেকে এক যুবক এসে পাশে দাঁড়িয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ভালো টুপি, ভালো দাম, হাতে বোনা, স্থানীয় লোকজনের তৈরি ইত্যাদি বলতে থাকে। আমি টুপিটা মাথায় পরলাম, একটু ছোট মনে হলো। হাত দিয়ে টেনেটুনে লম্বা করে আবার পরে দেখলাম। মাথার তুলনায় টুপিটা ছোট অথবা টুপির তুলনায় মাথাটা বড়। কথা একই, সুতরাং এটা চলবে না। সে টুপির জন্য ৭০ দিহরাম বা বাংলাদেশি ৭৫০ টাকার সমপরিমাণ দাম চাইলে আমি বললাম, টুপিটা মাথার তুলনায় ছোট, এর চেয়ে বড় সাইজের টুপি তার কাছে আছে কি না। সে বলল যে এটা তাদের দোকান না, তবে পাশের গলিতে তাদের দোকানে গেলে বড় মাপের টুপি পাওয়া যাবে। এরপর সে পথ দেখিয়ে আমাকে তাদের দোকানের দিকে নিয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

মিনিটখানেক হেঁটে এ গলি–ও গলি পেরিয়ে তাদের দোকানে গিয়ে দেখি সেটা চুল কাটার সেলুন। সেলুনের বাইরে কাঠের টেবিলের ওপর কিছু টুপি সাজিয়ে রাখা আছে। সেখান থেকে আমি একটা বড় সাইজের লাল-সবুজ টুপি নিয়ে সেলুনের বড় আয়নার সামনে গিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ট্রায়াল দিলাম। এ সময় মধ্যবয়স্ক একজন এগিয়ে এসে আরবি এবং ফরাসি ভাষায় কিছু একটা বলতে লাগল। আমি তার কথা বুঝতে পারিনি বুঝে সে তার হাতে থাকা পুরোনো বাটন মুঠোফোন টিপে ডিসপ্লেতে ১৫০ লিখে দেখাল। অর্থাৎ টুপির দাম সে ১৫০ দিহরাম চাচ্ছে। আমি বুঝলাম যে টুপির এই নতুন দাম আমাকে ‘টুপি’ পরানো, অর্থাৎ বোকা বানানোর পাঁয়তারা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এবার আমি পাশে দাঁড়ানো আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা যুবককে দেখিয়ে ইংরেজিতে বললাম যে সে আমার কাছে এর দাম ৭০ দিহরাম চেয়েছে। মধ্যবয়স্ক লোকটা কী বুঝল জানি না, তবে সে মুঠোফোনে ১২০ লিখে আমাকে দেখাল। আমি হাত নাড়িয়ে না না করলে, সে আমি কত দাম দিতে রাজি সেটা জানতে চেয়ে ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি আবারও না না করি, কেননা বিষয়টা আমার কাছে দিনদুপুরে ডাকাতির মতো মনে হচ্ছিল। এরপরও সে যখন আমার দাম জানতে নাছোড়বান্দার ভাব করে, তখন আমি কিছুটা সাহস নিয়ে ইয়ার্কির ছলেই ফোনটা হাতে নিয়ে ২০ লিখে তাকে দেখালাম।

আমার দাম ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ১০০ লিখে সে আমাকে দেখাল। আমিও যথারীতি না না করলে সে ৮০, ৬০ এবং সবশেষে ৫০ টাইপ করে দেখাল। এবার আমি মজাই পেলাম। মনে মনে বললাম, এই তো ভাতিজা, লাইনে এসেছ। আমিও ২৫ লিখে চলে যাওয়ার ভাব করলাম, কেননা ততক্ষণে আমার টুপি কেনার ইচ্ছাই চলে গেছে। লোকটাও হয়তো ততক্ষণে বুঝে থাকবে যে আমি তার দামের ধারেকাছেও যাব না, শুধু শুধু টাইম লস করে লাভ নেই। তাই সে বিরক্ত হয়ে অথবা হাল ছেড়ে দিয়ে টুপিটা আমার হাতে দিয়ে টাকা দিতে বলল। আবারও বুঝলাম যে নেগোসিয়েশন হলো মূলত কৌশল ও নার্ভের খেলা!

আমি আর কিছু না বলে ৫০ দিহরামের একটা নোট লোকটার হাতে দিলাম। তারা সব সময় যে প্রশ্নটা করে, সেটাই তখন পাশে দাঁড়ানো যুবকটা আমাকে ইংরেজিতে করল, তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ? মধ্যবয়স্ক লোকটা ততক্ষণে খুচরা টাকা নিয়ে এসেছে। আমি টাকাটা হাতে নিয়ে লাল-সবুজের গর্বে বাংলাদেশ বলে হাঁটা দিলাম। যাওয়ার আগে অবশ্য দুজনকেই শোকরান, অর্থাৎ ধন্যবাদ দিতে ভুল হয়নি। বলে রাখা ভালো যে এরপরও আমি আরও দু–একটা স্যুভেনিয়র কিনেছি, তবে এ রকম ফাজলামির অভিজ্ঞতা আর কখনো হয়নি!

স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় শিক্ষকেরা যেমন বলে থাকেন, হারা–জেতা বড় কথা নয়, অংশগ্রহণ করাটাই বড়। আমিও তেমনই মনে মনে বললাম, হারা–জেতা বড় কথা নয়, ফাজলামির জবাব দেওয়াটাই বড়। এই হলো আমার লাল–সবুজ টুপি কেনার গল্প।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন