রহস্যে মোড়া হিলাময়। যেকোনো পর্বতারোহী, ট্রেকার, নন-ট্রেকার, সাধারণ পর্যটকের জন্য ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে হিমালয় ভীষণ আকর্ষণীয়। পাহাড়প্রেমীরা বলেন, হিমালয়ে গেলে মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে। হিমালয়ের হাতছানি উপেক্ষা করা দুরূহ। হবে হয়তো! রহস্যের টানে, আগ্রহের বশবর্তী হয়ে আমিও হিমালয়ে গেছি। অবশ্যই ভালো লেগেছে; কিন্তু প্রেমে পড়িনি।
হিমালয়ে রসনাভ্রমণ শিরোনামটি কাউকে বিভ্রান্ত করতে পারে। শিরোনাম দেখে মনে হতে পারে, সেখানে রসনা উপভোগ করতেই গিয়েছিলাম; কিন্তু তেমনটি নয়। অন্য সব ভূখণ্ডের মতোই ভ্রমণই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পথিমধ্যে যা খেয়েছি, সেই স্মৃতিই তুলে ধরার প্রয়াস ব্যতীত অন্য কিছু নয়।
হিমালয়ের পথ ধরে গিয়েছিলাম এভারেস্ট বেজক্যাম্প ট্রেকিংয়ে। সহজ করে বলতে গেলে, হিমালয়ের পাহাড়ি পথে ১৪ দিনে হেঁটে চড়েছি ১৭ হাজার ৫০০ ফুট ওপরে।
আমার মতো হিমালয় সম্পর্কে যারা কম জানে, তাদের কাছে হিমালয় ও এভারেস্ট প্রায় সমার্থক। অর্থ হচ্ছে, হিমালয়ের পথ ধরে যাওয়া মানেই এভারেস্টের শিখরে পৌঁছানো বা সামিট করা। কিন্তু হিমালয়ে যাওয়া অর্থই এভারেস্ট অভিমুখে যাওয়া নয় কিংবা সামিট নয়। হিমালয়ের বিস্তৃতি পশ্চিম পাকিস্তানের নাঙ্গা পর্বত থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল, ভুটান হয়ে পুবে চীনের নামচা বারওয়া অবধি।
হিমালয়ে রয়েছে হাজার হাজার শৃঙ্গ। এর মাঝে পৃথিবীর সবথেকে উঁচু শৃঙ্গের নাম এভারেস্ট। এই সুবিশাল পর্বতমালার প্রায় প্রতিটিতে যেমন আরোহণের সুযোগ রয়েছে, তেমনি রয়েছে হেঁটে বেড়াবার সুযোগও। পাহাড়প্রেমীদের ভাষায় হিমালয়ের নানা পথে আছে ট্রেকিং ও হাইকিং। আরোহণ করতে অবশ্যই বিশেষ ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন। ট্রেকিং করবার জন্য বিশেষ কোনো ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন নেই, তবে শারীরিক সক্ষমতার সঙ্গে মানসিক শক্তি খুব জরুরি।
এভারেস্ট বেজক্যাম্প যাবার আগে আমার কোনো রকম ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল না। আমাদের দেশে কেওক্রাডং, আলীকদম কিংবা চন্দ্রনাথের চূড়ায় আরোহণ করার ট্রেকিং অভিজ্ঞতা আছে, এই বলে আমি সান্ত্বনা নিতে চাই না।
এভারেস্ট বেজক্যাম্পের পথে পথে সবকিছুই আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। শুধু তা–ই নয়, প্রস্তুতি পর্বও ছিল অন্য রকম। জুতা কেনা, ট্রেকিং সরঞ্জাম কেনা, নিয়মকানুন জানা, শুভাকাঙ্ক্ষীদের সতর্কবাণী—সব মিলে যাবার আগে থেকে হিমালয় উৎসব চলছিল। উপরন্তু নেপাল যাচ্ছি দীর্ঘ ২৩ বছর পর। আমার প্রথম বিশ্বভ্রমণ শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালে নেপাল ভ্রমণের মাধ্যমে।
ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু গিয়ে সাধারণ নেপালি খাবার খেয়েছি; যেমন নেপালি থালি, ডাল–ভাত, সবজি, মোমো। এক রাত্রি যাপনের পর রওনা করেছি লুকলার উদ্দেশে। সেখান থেকেই মূল ট্রেকিং শুরু হয়। লুকলা এয়ারপোর্টও একটি বিস্ময়। বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এয়ারপোর্ট লুকলা। নাম আসলে তেনজিং-হিলারি এয়ারপোর্ট। ১৪ জনের ছোট একটি এয়ারক্রাফটে করে পর্বতের মাঝ দিয়ে লুকলার তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দরে অবতরণও একটি বিস্ময়। লুকলা বিমানবন্দরের নাম তেনজিং-হিলারি হবার কারণ নিশ্চয়ই সবার জানা। ১৯৫৩ সালে এই দুজন ব্যক্তি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন এভারেস্ট জয় করে।
এয়ারপোর্টে চেকিং-ফেকিং নেই। যার যার ব্যাগ সংগ্রহ করে পা বাড়ালাম। ও বলা হয়নি, গাইড হিসেবে আছেন আমার সঙ্গে কৃষ্ণা আর পোর্টার খুদ। ট্রেকারদের বাক্সপেটরা বহনে সাহায্য করেন পোর্টাররা। কৃষ্ণ আমার সঙ্গে কাঠমান্ডু থেকে এসেছেন। আর পোর্টার হিসেবে খুদ যোগ দেন লুকলা থেকে। হিমালয়ের পথের সাথি আমরা তিনজন।
প্রথম কাজ সকালে নাশতা। নাশতায় এল দুধ, দুধের সঙ্গে যব, পাউরুটি ২ স্লাইস, আলুভাজা ও চা। সব একসঙ্গে পরিবেশন করা হলো। দুধ খেতে খেতে তো চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। বাইরে তো তীব্র শীত। চটজলদি নাশতা সেরে বের হলাম। আজকের গন্তব্য ফাকদিং নামক স্থান। মাঝে দুপুরের খাবার খেলাম। হাঁটতে হাটতে ভালোই খিদে পেয়েছে। ভাতের সঙ্গে ডাল, পাপড়, সামান্য মুগরির ঘন ঝোলের তরকারি আর ওমলেট। সঙ্গে এক বাটি স্যুপও ছিল। খাবার শুরুর আগে ও পরে চা পান করেছি। শীতের তীব্রতা তখনো শুরু হয়নি। যখন হাঁটতে থাকি ঠান্ডা অনুভূত হয় না। সন্ধ্যার আগ দিয়ে পৌঁছাই ফাকদিং শহরের হোটেল আযালিয়াতে। হাত–মুখ ধুতে গিয়ে দেখলাম পানি বরফ হয়ে আছে। ওয়েট টিস্যুই একমাত্র ভরসা সব কাজের জন্য।
রাতের খাবার খেলাম সন্ধ্যা ৭টায়। একেবারেই সাদামাটা ডাল-ভাত-পাপড়-আলু। পাহাড়ে এটাই অমৃত। এত উঁচুতে খাবার যে পাওয়া যাচ্ছে আমি তাতেই খুশি। অবশ্য ট্রেকিং প্যাকেজের ওপর নির্ভর করে খাবারের মান। আমার ট্রেকিং ছিল স্বল্প বাজেটের। তবে যত ওপরে উঠব খাওয়া, ঘুম কমতে থাকবে। শরীরকে সচল রাখার জন্য ভাত কম খেতে বলা হয়। স্যুপ, ডাল, আলু, সবজি খাওয়া উত্তম। সোলারে চলে সবকিছু এখানে। তাই রাতের খাবার ৭টার মাঝে চুকিয়ে ফেলতে বলা হয়। তারপর ডাইনিংয়ে একটি কয়লার হিটারের সামনে গেস্টহাউসের সব পর্যটক বসে শরীরকে একটু উষ্ণ করে নেন। কারণ আবার ভোর ৬টা থেকে শুরু হবে ট্রেকিং।
প্রথম দিন হেঁটেছি ৯ কিলোমটার। আজও সেরকমই দূরত্বে নামচে বাজার যাব। এরপরের গন্তব্য নামচে বাজার, বেজক্যাম্প ট্রেকের সবচেয়ে বড় আর জনপ্রিয় বাজার। কেউ কেউ বেজক্যাম্প অবধি যায় না, নামচে বাজার দেখতেই সংক্ষিপ্ত ট্রেক করে। নামচে বাজারের প্রবেশমুখের পথটা দারুণ। সন্ধ্যা হবার কিছু আগে সুন্দর গোছানো একটি শহরে এলাম। নামচে বাজারে এসে নতুন একটি বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি; অ্যাক্লিমেটাইজেশন। বেশি উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাওয়ানোর জন্য নির্দিষ্ট একটি উচ্চতায় যাবার পর আবার নেমে কিছুটা কম উচ্চতায় ঘুমানোর প্রক্রিয়াকে অ্যাক্লিমেটাইজেশন বলে। এভাবে পর্যায়ক্রমে উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাওয়াতে হয়। নামচে বাজারে পরদিন সকালে অ্যাক্লিমেটাইজ করতে হবে, অর্থাৎ এক দিন এখানে থাকব। আমি মনে মনে খুশি হলাম, কম হাঁটতে হবে, কিছুটা রেস্ট পাব।
বেজক্যাম্প পৌঁছানো পর্যন্ত দিনপঞ্জিটা নামচে বাজারের পর এ রকম ছিল—নামচে বাজার থেকে গন্তব্য ট্যাংবোচে; সেখান থেকে ডিংবুচে। এভাবে ট্রেক চলতে থাকল। ডিংবুচে গিয়ে আবার অ্যাক্লিমেটাইজেশন। ধীরে ধীরে উচ্চতায় উঠছি আর শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ করছি। শ্বাসজনিত কিছুটা অস্বস্তি, হালকা মাথাব্যথা, রাতের ঘুমের ব্যাঘাত, খাবারে অনীহা নিজের মাঝে লক্ষ করছিলাম। তীব্র মাত্রায় অনুভব করছিলাম না; কিন্তু টের পাচ্ছিলাম।
খাবারের মেনুর খুব বেশি পরিবর্তন নেই। তিন বেলাতেই মোটামুটি একই ধরন। সকালে দুধ, ডিম, চা ও পাউরুটি। দুপুরে ভাত, ডাল, সবজি, আলু ও শাকপাতা। রাতেও তা–ই। রাতে খাবারে মাঝে মাঝে আঙুর, কমলা খেতে দিত কৃষ্ণা।
ডিংবুচেয় অ্যাক্লিমেটাইজেশনের সময় বিকেলে বেড়াতে গিয়েছিলাম ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে একটি বেকারিতে; নাম ‘ফ্রেঞ্চ বেকারি’। এই প্রথম এত উঁচুতে কোনো বেকারিতে এলাম। এরপরের গন্তব্য লোবুচে। স্বপ্নের বেজক্যাম্প আর বেশি দূরে নয়, এই উত্তেজনায় রাতের ঘুম আরও কমতে লাগল। উচ্চতা বাড়ছে, তুষারপাত বাড়ছে, তাপমাত্রা কমছে, উত্তেজনা বাড়ছে; আরও শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ করছি। সব মিলিয়ে এখন চিন্তা করতে বসলে আসলেই একটি সুন্দর স্বপ্নের মতো মনে হয়।
লোবুচে থেকে গোরকশেপ যাত্রাটা বেশ কষ্টকর লেগেছে। কারণ, গোরকশেপ থেকে সেদিনই বেজক্যাম্প যেতে হবে, আবার গোরকশেপে ফিরতে হবে। কারণ, বেজক্যাম্পে থাকবার জায়গা নেই। সে জন্য একটু মানসিক চাপ অনুভব করছিলাম। সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করবার তাগিদ, অভীষ্টে পৌঁছানো আবার এদিকে পা যুগল জানান দিচ্ছিল যে, তারা খুব ভালো নেই।
এভারেস্ট বেজক্যাম্প থেকে ফেরার সময় তুষার ঝড় হচ্ছিল। বেশ ভয় পেয়েছিলাম, গন্তব্যে ফিরতে পারব কি না সেটা ভেবে।
বেজক্যাম্পের যাত্রাপথে কী কী দেখেছি, কোন কোন বিষয় মনকে আন্দোলিত করেছে, কোন বিষয়গুলো মনকে ভাবিয়েছে—সবকিছু সরিয়ে একটি কথা চিন্তা না করেই বলতে পারি, এভারেস্ট বেজক্যাম্পের যাত্রাপথ আমাকে বহুদিন পর আরও একবার জীবনকে ফিরে দেখবার সুযোগ করে দিয়েছে। আমি সব সময় বলতাম, প্রকৃতির মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই না। প্রকৃতি এত বিশাল। মানুষের তৈরি স্থাপনায় আমি নিজেকে খুঁজে পাই; হিমালয়ের পথে আমি দেখেছি মানুষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃতিকে জয় করেছে। বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ, বৈরী আবহাওয়ায় মানুষ দিনাতিপাত করছে। মানুষ আর বন্য প্রাণী যেখানে একে অপরের বন্ধু। মানুষ ও পশু যেখানে ভারবাহী প্রাণী। নিজের খাবার জোগান নিজেকেই করতে হয়। হাজার হাজার ফুট উঁচুতে ইয়াক, মিউল ও ঘোড়ার পাল দেখেছি নিজেদের খাবার নিজেরা বহন করে ওপরে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু খাবারই নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, জীবনধারণের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ হাজার হাজার ফুট উঁচুতে নিজকেই জোগান দিতে হয়।
পাহাড়ে গিয়ে শিখেছি, কত স্বল্প পরিমাণ পানি দিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটাতে হয় এবং এটি খুব অনায়াসেই করা যায়।
যাত্রাপথের তিনটি বিষয় অভিভূত করেছে—শেরপা জাতির দক্ষতা, পুরো পথ যেতে যেতে পাথরে খোদাই করা তিব্বতীয় ভাষায় লেখা ধর্মীয় বাণী, কথা-উপকথা আর টুকলা পাসের ওপরে পর্বতারোহীদের মেমোরিয়াল, যেখানে বাংলাদেশি সজল খালেদেরও স্মৃতিফলক রয়েছে।
তিব্বতিরা, নেপালের খুম্বু অঞ্চল ও ভারতের দার্জিলিং অঞ্চলে পরিভ্রমণ করা একটি জাতি। হিমালয় অভিযানের একদম শুরুর দিকে এ জাতি মালামাল পারাপারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেছিল। এখন এভারেস্ট এবং হিমালয় অভিযানে শেরপারা একটি অপরিহার্য অংশ। আমার মতো অনেকেই হয়তো পর্বতের গাইডদের শেরপা ভাবেন। কিন্তু শেরপা একটি জাতি, যারা পর্বতে অন্যান্য গাইডদের মতো কাজ করে। শেরপা অর্থ গাইড নয়।
যাত্রাপথে দেখা হয়েছিল দুজন শেরপার সঙ্গে। একজন ৭ বার এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন, অন্যজন ১৭ বার। দুজনের হোটেলেই আমি দুপুরের খেয়েছি। দুজনেই সাধারণ, দারুণ অমায়িক। রেস্টুরেন্ট চালিয়ে জীবন ধারণ করেন।
যখন ফিরতে আরম্ভ করেছি, তখন খাবার মেনু কিছুটা বদল হলো। দুপুরে ও রাতে মুরগি, গরু, পিৎজ্জা যোগ হলো। সঙ্গে চিজকেক, পুডিং। নামচে বাজারে এসে কৃষ্ণ সেলিব্রেশন ডিনারের আয়োজন করেন। লুকলা ফিরেও উৎসব চলমান ছিল।
কাঠমান্ডু ফিরে কৃষ্ণকে বিদায় জানালাম। যে কোম্পানি থেকে আমি এভারেস্ট বেজক্যাম্প প্যাকেজ নিয়েছিলাম, তারা একটি দারুণ ডিনারের আয়োজন করে। সঙ্গে এভারেস্ট বেজক্যাম্প ট্রেকিং সম্পন্ন করার জন্য একটি সার্টিফিকেটও দেয়।
ছবি: লেখক