টপকাপি প্রাসাদ: পবিত্র নিদর্শনের ঘর, সুলতানি রাজকীয়তার ছায়া
শেয়ার করুন
ফলো করুন

পর্ব ২
ইস্তাম্বুলের টোপকাপি প্রাসাদ যেন এক জীবন্ত মহাকাব্য। বাইরের চত্বরে ঘুরে দেখা শেষ হলে সামনে আসে আরেকটি বিস্ময়—পবিত্র সংগ্রহশালা ‘হিরকাই সা’দেত দারি’। অটোমান সুলতানদের হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের অংশ এটি। এখানে সংরক্ষিত আছে নবী–রাসুলদের ব্যবহৃত সব জিনিস। এ যেন এক অমূল্য নিদর্শনের ভান্ডার। প্রাসাদের এই অংশে প্রবেশ করা মানেই সময়কে যেন ছুঁয়ে ফেলা।

পবিত্র সংগ্রহশালা ‘হিরকাই সা’দেত দারি’
পবিত্র সংগ্রহশালা ‘হিরকাই সা’দেত দারি’

প্রাসাদের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশগুলোর একটি হলো এই প্রাঙ্গণ। এখানে আছে—
দিওয়ান–ই– হুমাইয়ুন বা ইম্পেরিয়াল কাউন্সিল চেম্বার: সুলতান ও তাঁর মন্ত্রীরা এখানে বসে সাম্রাজ্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। দেয়ালের সূক্ষ্ম কাজ, সোনালি অলংকরণ আর নিচু জানালা—সব মিলিয়ে এক রাজকীয় পরিবেশ।

বিজ্ঞাপন

প্রাসাদের বিশাল রান্নাঘর: অটোমান সুলতানদের খাবার তৈরির জন্য যে বিশাল রান্নাঘর ব্যবহৃত হতো তা আজও অটুট। এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে রাজকীয় চীনা বাসন, মিং রাজবংশের মূল্যবান পোরসেলিন, তামার হাঁড়ি আর রান্নার বিশাল পাত্র।

অটোমান সুলতানদের খাবার তৈরির জন্য ব্যবহৃত পাত্র
অটোমান সুলতানদের খাবার তৈরির জন্য ব্যবহৃত পাত্র
অটোমান সুলতানদের রান্নাঘর
অটোমান সুলতানদের রান্নাঘর

এখানকার সবুজ মাঠ, ছায়াময় পথ আর দৃষ্টিনন্দন বাগানগুলোতে হাঁটতে হাঁটতে বুঝবেন অটোমানরা সৌন্দর্য ও মানসিক শান্তিকে কতটা গুরুত্ব দিতেন।

বিজ্ঞাপন

ইস্তাম্বুলের টোপকাপি প্রাসাদ ঘুরতে গেলে কয়েকটি অনন্য ও পবিত্র নিদর্শন মনের ভেতর গভীর আলোড়ন তোলে। প্রাসাদের বিশেষ সংরক্ষণাগারে ঢুকলেই দেখা যায় ইসলামের প্রারম্ভিক যুগের অমূল্য সংগ্রহ—যার মধ্যে রয়েছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর পবিত্র জুতার নিদর্শন ও পদচিহ্ন। নিস্তব্ধ আলোকস্নাত ঘরে দাঁড়িয়ে এসব নিদর্শন দেখলে মনে হয়, সময় যেন পিছিয়ে যায়। হাজার বছরের ঐতিহাসিক যাত্রা যেন একমুহূর্তে স্পর্শ করা যায়। ভেতরের পরিবেশ এতটাই শান্ত, এতটাই গম্ভীর যে মানুষ না চাইতেই নিজের ভেতরে একধরনের অদ্ভুত ভাবগাম্ভীর্য অনুভব করে।

নবীর (সা.) জুতা
নবীর (সা.) জুতা

সেখানেই আরেক কোণে সংরক্ষিত আছে হযরত ফাতিমার (রা.) পোশাকের নিদর্শন। সূক্ষ্ম কাপড়ে তৈরি সেই পোশাকটির দিকে তাকালে মনে হয় স্নিগ্ধতা আর পবিত্রতার এক অনির্বচনীয় ছায়া চারদিকে ছড়িয়ে আছে। কাঠ ও কাচ দিয়ে তৈরি বাক্সে অত্যন্ত যত্নে রাখা পোশাকটি যেন নিঃশব্দে বলে যায় ত্যাগ, মমতা আর সরলতার চিরন্তন গল্প। প্রাসাদের ভেতরের প্রতিটি নিদর্শন শুধু ইতিহাসই নয়, বিশ্বাস আর অনুভূতিরও এক মহামিলন ঘটায়—যা দর্শনার্থীদের মনে দীর্ঘদিন রয়ে যায়।

একটু সামনে এগিয়ে গেলেই আছে বিখ্যাত দরজা, যেখান দিয়ে প্রবেশ করলেই অপেক্ষা করছে সহস্রাধিক বছরের ইসলামি ইতিহাস। ছোট্ট কাঠের দরজা পেরিয়ে মুহূর্তেই মনে হলো, চারপাশের বাতাস যেন আরও নীরব, আরও পবিত্র। এখানেই সংরক্ষিত আছে নবীজির (সা.) দাড়ির অংশ, দাঁতের অংশ, পায়ের ছাপ, নবী মুসার (আ.)–এর লাঠি, দাউদের (আ.)–এর তরবারি, বিভিন্ন খলিফার ব্যবহার করা বস্ত্র ও সামগ্রী।

খালিফা ওমরের (রা.) তরবারি
খালিফা ওমরের (রা.) তরবারি

ঘরে খুব কম আলো। কারণ, এগুলো অমূল্য নিদর্শন, অতি সংবেদনশীল। দর্শনার্থীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যান, অনেকে আবেগে আর্দ্র হয়ে ওঠেন। কারণ, সামনে দাঁড়ানো প্রতিটি বস্তুই ইতিহাসের আরেক দরজা খুলে দেয়।

মুসার (আ.)–এর লাঠি থেকে দাউদ (আ.)–এর তরবারি

হযরত ফাতিমার (রা.) পোশাক
হযরত ফাতিমার (রা.) পোশাক
মুসা (আ.)–এর লাঠি
মুসা (আ.)–এর লাঠি

প্রথম ঘরেই চোখে পড়ে কাবাঘরের পুরোনো চাবি, পাথর আর প্রথম যুগের কোরআন শরিফ। তার পাশেই কাবার দরজার প্রাচীন অংশ। আর ঠিক সামনে রাখা আছে সেই বিখ্যাত লাঠি—যে লাঠির আঘাতে বিভক্ত হয়েছিল লোহিত সাগর। কত যুগ আগে ব্যবহৃত হয়েছিল! তবু অটোমানরা বিশ্বাস করতেন, এটিই মুসা (আ.)–এর প্রকৃত লাঠি।
একই পাশে রাখা দাউদের (আ.)–এর তরবারি। ধাতব বর্মে খোদাই করা আছে নবী মুসা (আ.), হারুন (আ.) এবং নবীজির (সা.)–এর নাম। এই অংশে দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই অন্য রকম অনুভূতি—একদিকে বিস্ময়, অন্যদিকে অদ্ভুত প্রশান্তি।

মূল আর্কষণ নবীজি (সা.)–এর পায়ের ছাপ

দর্শনার্থীরা সবচেয়ে বেশি থেমে যান যেখানে, সেখানে নবীজি (সা.)–এর পায়ের ছাপ রয়েছে। পাথরের ওপর স্পষ্ট সেই ছাপ আজও সযত্নে রক্ষিত। পাশে রাখা আছে ধাতব পাত্রে তৈরি তার প্রতিরূপ। আগে এখানে ছবি তোলা নিষিদ্ধ ছিল; এখন সেই সুযোগ পাওয়াটাই বড় সৌভাগ্য।

সুলতানি রাজত্বের হৃদয়—হিরকাই সা’দত কক্ষ

অটোমান সুলতানদের থাকার জন্য ছয়টি খাসকামরা ছিল। এর প্রথমটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—হিরকাই সা’দত কক্ষ, যেখানে সংরক্ষিত আছে নবীজির (সা.) কার্ডিগান। বছরের নির্দিষ্ট দিনে বিশেষ আয়োজনে এটি বের করা হতো। কক্ষের এক কোণে আছে সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদের সিংহাসন, যা ফরাসি রাজপরিবারের উপহার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি। দেয়ালে ঝুলছে ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের পাঠানো কোট।

রেভান কিয়স্ক—৪০ দিনের ইবাদতের ঘর

সাড়ে পাচশো বছর ধরে টপকাপিতে হচ্ছে কোরআন তিলাওয়াত
সাড়ে পাচশো বছর ধরে টপকাপিতে হচ্ছে কোরআন তিলাওয়াত

টোপকাপি প্রাসাদের ইতিহাসের আরেকটি মহিমান্বিত দিক হলো এখানে সংরক্ষিত কোরআন শরিফ ও কোরআন তিলাওয়াতের ঐতিহ্য। প্রাসাদের পাঠাগারে এবং হিরকাই সা’দত সংগ্রহশালায় রাখা আছে বিশ্বের প্রাচীনতম কোরআন শরিফ। কিছু কোরআন শত শত বছরের পুরোনো, যেখানে সূক্ষ্ম খোদাই এবং প্রাচীন কাগজে লেখাগুলো আজও অক্ষত। প্রতিদিন নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াত চলত, যা সুলতান ও রাজপরিবারকে আধ্যাত্মিক শান্তি দিত। এটি প্রমাণ করে যে টোপকাপি শুধু রাজকীয় বিলাসিতা নয়; বরং ওসমানি সাম্রাজ্যের হৃদয়ে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতারও স্থান ছিল।
এরপর আমরা পৌঁছাই রেভান কিয়স্কে। একসময় সুলতানরা এখানে ৪০ দিনের বিশেষ দোয়া ও রোজা পালন করতেন। এখন এখানে রাখা আছে সুলতান প্রথম আহমেদের ঈদের সিংহাসন—চুনি, সোনা, কোয়ার্টজ ও মুক্তায় সাজানো দৃষ্টিনন্দন এক শিল্পকর্ম। কিয়স্কের বারান্দা থেকে দেখা যায় প্রাসাদের বাইরের সৌন্দর্য—নীল আকাশ, সবুজ বাগান আর প্রাচীন দেয়াল।

তৃতীয় আঙিনায় আছে সুলতান তৃতীয় আহমেদের পাঠাগার। সামনের আঙিনা পেরিয়েই আমরা পৌঁছাই সুলতান তৃতীয় আহমেদের পাঠাগারে। ১৭ শতকের শেষে নির্মিত এই ছোট অথচ দৃষ্টিনন্দন পাঠাগার ছিল তাঁর ব্যক্তিগত অধ্যয়নকক্ষ। একসময় এখানে সংরক্ষিত ছিল হাজার হাজার পাণ্ডুলিপি—ইতিহাস, আইন, ধর্ম, জ্যোতির্বিদ্যা—সবকিছু নিয়ে গবেষণার জন্য।

টোপকাপি প্রাসাদে বাবা ও মায়ের সঙ্গে লেখকের
টোপকাপি প্রাসাদে বাবা ও মায়ের সঙ্গে লেখকের

পাঠাগারের নিচে আছে সুপেয় পানির ব্যবস্থা, যা এখনো আসল রূপেই আছে। আর ঠিক তার পাশেই সেই ঘর, যেখানে কোনো সুলতানের মৃত্যু হলে প্রথমে তাঁর মরদেহ আনা হতো। এরপর জানাজা হতো গেট অব ফেলিসিটির সামনে—প্রাসাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচনাস্থলে।

হারেম: রাজপরিবারের রহস্যময় অন্দরমহল

বিকেল গড়িয়ে আমরা পৌঁছাই হারেমের মূল ফটকে। এই দরজা দিয়েই প্রবেশ করা যায় সুলতানদের ব্যক্তিগত আবাসে। হারেম সম্পূর্ণ আলাদা এক জগৎ—শত শত কক্ষ, দাসী, রানি, উপপত্নী, রাজকীয় অনুষ্ঠান আর কঠোর নিয়মে গড়া এক অদৃশ্য শহর।
হারেমের প্রথম অংশেই দেখা যায় খাবার রাখার জায়গা। টপকাপির কর্মকর্তা পেতেন দিনে দুই বেলা খাবার আর প্রাসাদের অভ্যন্তরের বাসিন্দারা তিন বেলা। রান্নাঘর থেকে খাবার এখানে এনে রাখা হতো। দাসীরা দরজা খুললেই এসে সারিবদ্ধভাবে সংগ্রহ করত। সরু সেই পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়—এখানকার প্রতিটি দরজার পেছনে লুকিয়ে আছে আরেকটি গল্প।

হারেম: রাজপরিবারের রহস্যময় অন্দরমহল
হারেম: রাজপরিবারের রহস্যময় অন্দরমহল
ডিভান চেম্বার
ডিভান চেম্বার

অটোমান যুগে বহুবার প্রাসাদে আগুন লেগেছে। মার্বেল, মোজাইক, দেয়ালের অলংকরণ—অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। আজ যা দেখা যায়, তার অনেকটাই উন্মুক্ত ও পুনর্গঠিত। তবু নিশ্চিত, সুলতানদের সময় তা ছিল অসাধারণ জাঁকজমকপূর্ণ।
হারেমের সবচেয়ে বড় কক্ষ ইম্পেরিয়াল হল। এখানেই হতো রাজপরিবারের বড় বড় ঘোষণা ও অনুষ্ঠান। সামনে এগোতেই সুলতানের শয়নকক্ষ—একটি বিছানার জন্য বিশাল এক ঘর। দেয়ালজুড়ে শিল্পকর্ম, মসৃণ কাঠের কাজ, নিখুঁত কারুকাজ…যেন এক অন্য সময়ের সাক্ষ্য।

টপকাপি প্রাসাদের দুটি অংশ—ট্রেজারি ও হারেম, দুটিই বিশাল ও সমৃদ্ধ, তাই এক দিনে পুরোটা দেখা প্রায় অসম্ভব। প্রতিটি কোণেই আছে নতুন গল্প, নতুন বিস্ময়। তাই ইস্তাম্বুলে গেলে অন্তত দুই দিন ধরে টপকাপি দেখার পরিকল্পনা করাই ভালো।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ০৫
বিজ্ঞাপন