নর্থ মেসিডোনিয়ার স্কপিয়ে: অতীত ও আধুনিকতার মোহনীয় সংমিশ্রণ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ইউরোপ মহাদেশের মেসিডোনিয়া অঞ্চলটির ইতিহাস খুলে দেখলে বোঝা যায়, এটি এক বহমান নদীর মতো, যার অসংখ্য ধারা, উপধারা আর বিস্তৃতি আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এর সীমানা বহুবার বদলেছে। এখানে ঘটেছে রাজ্য ও সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, যুদ্ধ, সংস্কৃতির মিলন আর সংঘাত। বর্তমানে এই বিস্তৃত ভূখণ্ড বিভক্ত হয়ে রয়েছে গ্রিস, নর্থ মেসিডোনিয়া, বুলগেরিয়া ও আলবেনিয়ার বিভিন্ন অংশে। ইতিহাসের এই জটিল বুনটই এখানে ভ্রমণকারীদের জন্য এক অনন্য আবহ তৈরি করে।

ভারদার নদীর অপর পাথরের পুরনো ব্রিজ, এবং স্থাপনা
ভারদার নদীর অপর পাথরের পুরনো ব্রিজ, এবং স্থাপনা

আজ মেসিডোনিয়া নামে কোনো স্বতন্ত্র দেশ নেই—না দক্ষিণ, না পূর্ব, না পশ্চিম। মার্শাল টিটোর যুগোস্লাভিয়া ভাঙনের পর নবগঠিত এক স্বাধীন দেশের নাম রাখা হয়েছিল মেসিডোনিয়া। কিন্তু গ্রিসের একটি প্রদেশের নামও একই হওয়ায় শুরু হয় দীর্ঘ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিরোধ। বছরের পর বছর দুই দেশের জাতীয় পরিচয় ও গৌরববোধ এই নাম নিয়ে টানাপোড়েনে জড়িয়ে থাকে। অবশেষে ২০১৮ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে সমঝোতা হয় এবং দেশটির নতুন নাম হয় ‘রিপাবলিক অব নর্থ মেসিডোনিয়া।’ দক্ষিণ এশিয়ার কাশ্মীর, পাঞ্জাব বা বাংলার বিভক্ত ইতিহাসের সঙ্গেও এ ঘটনার কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়—নামের মিল, তবে ভিন্ন ভূগোল।

বিজ্ঞাপন

বলকান উপদ্বীপের প্রান্তে অবস্থিত নর্থ মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কপিয়ে এমন এক শহর, যেখানে রোমান সাম্রাজ্যের ছায়া, অটোমান ঐতিহ্যের সৌরভ এবং আধুনিক ইউরোপীয় স্থাপত্য একই সঙ্গে বিরাজমান। আমার কাছে নর্থ মেসিডোনিয়ার নাম উচ্চারিত হলেই মনে পড়ে যায় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের কথা—পার্সি ভাষায় যিনি ‘সিকান্দার’ নামে পরিচিত, আর যাঁর অভিযান ইতিহাসের পাতা পেরিয়ে আজও মানুষের মুখে মুখে।

ভারদার নদীর দুপারের স্থাপনা
ভারদার নদীর দুপারের স্থাপনা

আমার এবারের বলকান ভ্রমণ শুরু হয়েছিল ইউরোপের নবীনতম রাষ্ট্র কসোভোর রাজধানী প্রিস্তিনা থেকে, যার প্রতিটি গলিই যেন বহু বছরের গল্প শোনায়। সেখানে মাত্র তিন দিন কাটিয়ে এক সকালে বাসে চেপে রওনা দিই স্কপিয়ের উদ্দেশে। মাত্র দুই ঘণ্টার পথ, পাহাড়ি দৃশ্যের ভেতর দিয়ে ছোট গ্রাম, খেতখামার পেরিয়ে বাস এগোতে থাকে। সীমান্তের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে প্রবেশ করলাম নর্থ মেসিডোনিয়ায়।

বিজ্ঞাপন

স্কপিয়ের বাসস্ট্যান্ডে নেমে গন্তব্য ছিল শহরের মেইন স্কোয়ার, আমি হোটেল নিয়েছি সেখানেই। কিন্তু সমস্যা হলো, হাতে তখনো স্থানীয় মুদ্রা নেই। ভাবলাম, ট্যাক্সি নিলেই হবে। কিন্তু প্রথম চালক ভাড়া চাইল ১০ ইউরো, যদিও যাত্রাপথ মাত্র আড়াই কিলোমিটার! আমি ৫ ইউরো প্রস্তাব দিলাম, সে রাজি হলো না। দ্বিতীয়জনও একই কথা বলল। মনে হলো, হয়তো কোনো সিন্ডিকেট, অথবা স্টেশনের চিরাচরিত ‘স্ট্যান্ডবাজি’।

স্কপিয়ে দুর্গে (জয়ের পর!) লেখক.
স্কপিয়ে দুর্গে (জয়ের পর!) লেখক.

আমার ভেতরের ‘বাঙালি জিদ’ জেগে উঠল। ভাবলাম, সময় তো হাতে আছে, বরং এখান থেকেই হাঁটতে হাঁটতে শহর দেখা শুরু করি। আগস্টের প্রখর রোদে হাঁটা সহজ ছিল না, কিন্তু ব্যাগে ছাতা আর পানি ছিল, তাই সমস্যা হলো না। আসলে এটা শুধু অর্থের ব্যাপার ছিল না; পাঁচ বা দশ ইউরো কোনো ভ্রমণেই তেমন কিছু নয়। বিষয়টা ছিল নীতির—যৌক্তিক দাম হলে আমি খুশি মনেই দিতাম, কিন্তু ইচ্ছাকৃত ঠকানো মেনে নেওয়া যায় না!

ডাল, রুটি, কাবাব তৈরি হচ্ছে
ডাল, রুটি, কাবাব তৈরি হচ্ছে
দুপুরে ডাল, রুটি, কাবাব খাচ্ছেন লেখক
দুপুরে ডাল, রুটি, কাবাব খাচ্ছেন লেখক

নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম চারজন তরুণ—দেখতে আমাদের মতোই। কাছে গিয়ে কথা বলতেই জানা গেল, তাঁরা বাংলাদেশি—ময়মনসিংহ জেলায় বাড়ি। এখানে কনস্ট্রাকশনের কাজ করেন, আজ ছুটি, তাই শহর ঘুরছে। বিদেশের মাটিতে দেশের মানুষ পেলে যে উষ্ণতা পাওয়া যায়, তা অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়। গল্প করতে করতে আমরা স্কোয়ারের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। বিদায়ের আগে জিজ্ঞাসা করে একটা ছবি তুলেও স্মৃতি ধরে রাখলাম।

হোটেলে চেক-ইন শেষে বেরিয়ে পড়লাম শহরের পুরোনো বাজারের পথে। পথে পড়ল পাথরের পুরোনো ব্রিজ, যা শুধু একটি স্থাপনা নয়, বরং শতাব্দীর ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। ব্রিজ পেরিয়েই মনে হলো, যেন অন্য এক জগতে ঢুকে পড়েছি। সরু গলি, পুরোনো পাথরের ঘরবাড়ি, ব্যসনবাসনের দোকান, কাঠের জানালা, রঙিন হস্তশিল্প, আর বাতাসে ভেসে আসা মসলার গন্ধ—সব মিলিয়ে মনে হলো, আমি যেন কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে গেছি। এক কাপ গাঢ় তুর্কি চা আর মধুভেজা বাকলাভা শরীর ও মন—দুই–ই চাঙা করে দিল।

মেসিডোনিয়া স্কোয়ারে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মূর্তির সঙ্গে লেখক
মেসিডোনিয়া স্কোয়ারে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মূর্তির সঙ্গে লেখক

আমার হোটেলের জানালা থেকেই দেখা যাচ্ছিল পাশের পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা স্কপিয়ে দুর্গ। পরদিন সকালে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। দুর্গে ওঠার পথ ছিল ঘুরপাক খাওয়া, আগস্টের তীব্র রোদে ওপরের দিকে হাঁটাও কষ্টকর। কিন্তু ওপরে পৌঁছে ওয়াচটাওয়ার থেকে শহরের ৩৬০ ডিগ্রির দৃশ্য দেখে সব ক্লান্তি মিলিয়ে গেল। শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ভারদার নদী, চারপাশে পর্বতমালা আর ঐতিহাসিক স্থাপনা—সব মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত পোস্টকার্ড। বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডারের দেশে এসে মনে হলো, ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছি আমিও।

দুর্গ থেকে নামার পথে চোখে পড়ল মুস্তাফা পাশা মসজিদ—অটোমান আমলে ১৪৯২ সালে নির্মিত। সাদা দেয়াল, উঁচু মিনার আর প্রশস্ত আঙিনা যেন বিগত শতাব্দীর গল্প বলছিল। কিছুক্ষণ এর ছায়ায় বসে ঠান্ডা হাওয়ায় বিশ্রাম নিলাম।

পুরনো বাজারের তুর্কি সুইটস শপ
পুরনো বাজারের তুর্কি সুইটস শপ
স্কপিয়ের মুস্তাফা পাশা মসজিদের ভিতরের কারুকার্য
স্কপিয়ের মুস্তাফা পাশা মসজিদের ভিতরের কারুকার্য

দুপুরের দিকে আবারও পুরোনো বাজারে ফিরে এক রেস্তোরাঁয় বসলাম। ডাল, রুটি, কাবাব আর ঠান্ডা আয়রান—এই খাবারের স্বাদে যেন ইতিহাসও মিশে ছিল। তুর্কি প্রভাব, বলকানীয় ছোঁয়া, আর স্থানীয় উপকরণের গন্ধ একসঙ্গে। বিকেলটা কাটালাম নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে, স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা উপভোগ করে।

আমি ভ্রমণে প্রতিটি বিখ্যাত স্থান ‘টিক মার্ক’ দিয়ে ঘুরে বেড়াই না। বরং শহরের রাস্তা, গলি, পার্ক, বাজারে হাঁটি, মানুষের সঙ্গে কথা বলি। কারণ, এতে শহরের আসল প্রাণটাকে অনুভব করা যায়। স্কপিয়েতেও তা–ই করলাম। তৃতীয় দিনের অর্ধেকটা নিরুদ্বেগেই এদিক–সেদিক ঘুরে কাটালাম। তারপর গন্তব্য ধরলাম সার্বিয়ার ঐতিহাসিক নিস শহরের দিকে।

পুরনো বাজারের সুভেনির শপ
পুরনো বাজারের সুভেনির শপ
পুরনো বাজারের সুভেনির শপ
পুরনো বাজারের সুভেনির শপ

প্রায় আড়াই দিনের স্কপিয়ে ভ্রমণ শেষে মনে হলো, এ শহরের ইতিহাস শুধু জাদুঘরে বন্দী নয়, বরং প্রতিটি অলিগলিতে, প্রতিটি পাথরে, আর স্থানীয়দের চোখেমুখে তা জীবন্ত। এখানে আসা মানে কেবল অতীত দেখা নয়, বরং আজকের দিনেও সেই অতীতকে অনুভব করা। ভ্রমণপিপাসু, ইতিহাসপ্রেমী কিংবা নতুন সংস্কৃতি জানার আগ্রহ—যেই উদ্দেশ্যেই আসুন না কেন, স্কপিয়ে আপনাকে উপহার দেবে এক অমলিন অভিজ্ঞতা।
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন