২১ জানুয়ারি ১৭৯৩।
দিনটা শুরু হয়েছে অন্যান্য দিনের মতোই, কিন্তু প্যারিসের বাতাসে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত ফিসফাস। কিছু একটা আজ হতে চলেছে। এমন কিছু, যা কিনা কল্পনাতেই আসেনি ফরাসিদের। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিসফাস বাস্তবে রূপ নেয়। একটা মিছিল ধীরলয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কনকর্ড চত্বরের দিকে। মিছিলের সামনে বন্দী অবস্থায় ফ্রান্সের শেষ সম্রাট ষষ্ঠদশ লুই। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পেয়েছেন তিনি। রাজার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ, ভাবা যায়? কিছুদিন আগেই প্রুশিয়ার (বর্তমান জার্মানি) সঙ্গে ফ্রান্সের যুদ্ধ হয়েছে। রাজার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, তিনি সেই যুদ্ধে প্রুশিয়ার স্বার্থ দেখেছেন। শুধু তা–ই নয়, দেশের স্বার্থবিরোধী বেশ কিছু কাগজপত্র উদ্ধার হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষের গোপন কেবিনেট থেকে। রাজার কী শাস্তি হতে পারে, তা নিয়ে ভোট হয়েছে এবং মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায় পাস হয়েছে।
গিলোটিনে ওঠানোর পর রাজাকে তাঁর প্রজাদের উদ্দেশে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হলো। তিনি বলতে শুরু করলেন, কিন্তু শেষ করতে পারলেন না। জনমত যদি আবার তাঁর দিকে ঘুরে যায়, সেই ভয়ে তাঁকে চুপ করিয়ে দেওয়া হলো। এগিয়ে এল জল্লাদ, গিলোটিনের পাটাতনে হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য হলেন রাজা। ওপর থেকে নেমে এল তীক্ষ্ণ ধারালো ব্লেড; নিমেষেই ধড় থেকে আলাদা হলো মাথা। ক্ষমতা বড়ই অদ্ভুত, চিরদিন থাকে না। একজন রাজা, কতজনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। কোনো দিন কি ভেবেছিলেন, তাঁর জীবনের গল্প থেমে যাবে গিলোটিনের পাটাতনে?
৮ নম্বর মেট্রোতে করে কনকর্ড চত্বরে আসা যায়। ফরাসি বিপ্লবের সময় এর নাম হয়েছিল রেভল্যুশন বা বিপ্লব চত্বর। ফরাসি বিপ্লবের সময় এটি ছিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রধান স্থান। বহু অভিজাত ব্যক্তিকে গিলোটিনে চড়ানো হয়েছিল এখানে। রাজা ষোড়শ লুইয়ের কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি, তাঁর স্ত্রী ম্যারি আতোয়াঁনেতও এখানে গিলোটিনের নিচে মাথা পেতেছিলেন একই বছরের অক্টোবর মাসে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা এক আইনজীবী, যিনি কিনা রাজা–রানিসহ অমাত্যবর্গের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করেছিলেন, সেই ম্যাক্সমিলিয়েন রোবেসপিয়েরেকেও এখানেই গিলোটিনে হত্যা করা হয়েছিল আরও ৯০ জন সঙ্গীর সঙ্গে। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস মনে হয় একেই বলে।
১৯ একর আয়তনের এই চত্বরের একদিকে ফ্রান্সের জাতীয় পরিষদের কার্যালয় অবস্থিত। চত্বরের ঠিক মাঝামাঝি আছে ৩ হাজার ২০০ বছরের প্রাচীন অনন্য স্থাপনা, ৭৫ ফুট উঁচু এক স্মারকস্তম্ভ, যেটি মিসরের প্রাচীন থিবস শহরের লুক্সর মন্দির থেকে নিয়ে এসে এখানে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে ১৮৩৬ সালে। ঔপনিবেশিকতার এই এক সমস্যা। পৃথিবীর যেখান থেকে যে যেভাবে পারে জাতীয় সম্পদ চুরি করে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেনিয়ামিন যেমন বলেছিলেন, ‘সভ্যতার প্রতিটি স্মারকস্তম্ভই আসলে বর্বরতার একেকটি নিদর্শন।’
যদিও বলা হয়ে থাকে, তৎকালীন মিসরের শাসক মোহাম্মদ আলী পাশা দুটি স্মারকস্তম্ভ ফরাসি রাজাকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু এর পেছনে আফ্রিকায় ফ্রান্সের ঔপনিবেশিকতার অবদান কি অস্বীকার করা যায়? ১৯৮১ সালে একটি স্মারকস্তম্ভ ফ্রান্স সরকার মিসরকে ফেরত দেয়। স্মারকস্তম্ভটির গায়ে হায়ারোগ্লিফিক্সের মাধ্যমে রাজা দ্বিতীয় ফারাও রামেসিসের রাজত্বকালের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ আছে। একদম শীর্ষে যেই ত্রিকোণাকৃতির সোনালি টুপি লাগানো সেটি আদতেই স্বর্ণের তৈরি, তবে রাজা রামেসিস সেটি বসাননি, বসিয়েছে ফ্রান্স সরকার ১৯৯৮ সালে।
নিচের দিকে সোনালি পাতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কী কী যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সুদূর মিসর থেকে আড়াই শ টনের এ স্তম্ভটি পরিবহনের কর্মযজ্ঞ সাধিত হয়েছিল।
রাজা ষোড়শ লুইকে যে জায়গায় হত্যা করা হয়েছিল সেখানে বর্তমানে আছে এক চমৎকার ঝরনা। ৯ মিটার উঁচু এক ভাস্কর্যের মাঝামাঝি সমুদ্র দেবতারা বসে আছেন।
চারপাশ ঘিরে আছে একদল মৎস্যকুমার। মৎস্যকুমারেরা হাতে মাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর সেই মাছের মুখ থেকে ঝরনার পানি বের হচ্ছে। সেই ছোটবেলা থেকে তো কেবল মৎস্যকুমারীর গল্পই শুনে এসেছি। মৎস্যকুমার বলেও যে কিছু আছে, জানা ছিল না। কল্পনার রাজ্যে যেখানে সবই সম্ভব, মৎস্যকুমারই বা সেখানে কী দোষ করল? চত্বরের একমাত্র স্ট্রিটফুডের দোকানি ছোট্ট একটা ভ্যানে করে খাবার নিয়ে ঘুরছে। মসিয়েদের তুলনায় মাদামদের দিকেই তার মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ এই বঙ্গসন্তানের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি।
আজ উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরির দিন। পথহারা পথিকের মতো ঘুরে বেড়াব প্যারিসের রাস্তায়। একের পর এক মেট্রোতে উঠব, যেখানে নামতে মন চাইবে নেমে ঘোরাঘুরি শেষে আবার অন্য মেট্রো ধরব। দেড় শ বছর আগে মেট্রোর লাইনগুলো তৈরি হয়েছিল। নগরবিদ হিসেবে যাঁরা এর দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা কতটা দূরদর্শী ছিলেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। প্যারিসবাসীদের গর্বের অন্যতম অনুষঙ্গ এই মেট্রো। কথিত আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্স দখলের পূর্বে জার্মানি হুমকি দিয়েছিল, ফ্রান্স যদি আত্মসমর্পণ না করে তাহলে বোমা মেরে পুরো প্যারিস গুঁড়ো করে দেবে। বিশেষ করে মেট্রোর লাইনগুলোর একটাও বাদ যাবে না। ফ্রান্স সেই দাবি মেনে নেওয়ায় জার্মান বাহিনী শহরটাকে আর ধ্বংস করেনি। আরেক জায়গায় পড়েছিলাম, জার্মান জেনারেলরা নাকি প্যারিসের সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁদেরও ইচ্ছা হয়নি শহরটাকে ধ্বংস করার।
মেট্রোস্টেশনগুলোর আরেকটা ব্যাপার দারুণ লেগেছে। দু–একটা বাদে বেশির ভাগ স্টেশনই মাটির নিচে; কিন্তু বাতাস চলাচলের চমৎকার ব্যবস্থা প্রতিটি স্টেশনেই বিদ্যমান। মেট্রোতে উঠলে বহু কিসিমের লোকজন চোখে পড়ে। সাধারণ যাত্রীরা তো রয়েছেনই, এর বাইরে ভ্রাম্যমাণ গায়ক, পিয়ানো কিংবা বংশীবাদকের দেখা মেলে। মনের আনন্দে তাঁরা বাজিয়ে চলেন, খুশি হয়ে যদি কিছু দিতে চান, তাঁরা না করবেন না।
বলা যায়, এটাই তাঁদের আপৎকালীন পেশা। কেবল যে অভিবাসীরাই এগুলো করেন তা নয়, ইউরোপিয়ানদের আধিক্যই বেশি। লাতিন আমেরিকার লোকজনও হরহামেশাই চোখে পড়ে। সকালে আসার পথেই যেমন এক ব্যক্তি মেট্রোতে যন্ত্রসংগীতের মাধ্যমে বহুল আলোচিত ‘দেসপাসিতো’ গানটি বাজাচ্ছিলেন। সেই গানের তালে দুই আফ্রিকানকে হাত–পা দুলিয়ে নাচতে দেখা গেল আর সেই আনন্দের ভাগীদার হলাম আমরা সবাই। গান শেষ হলে মাথার টুপি খুলে দাঁড়িয়ে গেলেন শিল্পী। কোনো জোরাজুরি নেই, নেই চাপাচাপি কিংবা হাঁকডাক। যাঁর ইচ্ছা তিনি টুপিতে কিছু পয়সা রেখে নেমে যাচ্ছেন। কেবল মেট্রোর ভেতরেই নয়, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেও এমন শিল্পীদের দেখা হরহামেশাই মেলে।
কনকর্ড চত্বরের ঠিক পাশেই স্যেন নদীর ওপর নির্মিত সেতু পার হয়ে হাঁটা দিলাম লা ইনভ্যালিদেসের উদ্দেশে। এটি সেই জায়গা, যেখানে বিপ্লবীরা কামান ও গোলাবারুদের দখল নিয়েছিলেন, যা কিনা তাঁদের জয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। অবশ্য আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই কমপ্লেক্সের ভেতরকার সামরিক জাদুঘর, বিশেষ করে চার্চের প্রতি। এই চার্চেই যে রাখা আছে নেপোলিয়ন বেনাপোর্টের দেহাস্থি। ১৮৪০ সালে রাজা লুই ফিলিপের সময়ে সেন্ট হেলেনা দ্বীপ থেকে নেপোলিয়নের দেহাস্থি এনে এখানেই সৎকার করা হয়। ১২ ইউরো দিয়ে টিকিট কেটে সেটা দেখাও যায়; কিন্তু সে জন্য সেটা খোলা থাকা জরুরি। আমার ভাগ্যটাই এমন, কেন যে আজকের দিনেই চার্চ বন্ধ থাকতে হবে?
স্যেন নদীর ওপর অনেকগুলো সেতু আছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অলংকৃত এবং সুন্দর নিঃসন্দেহে প্য আলেকজান্ডার থ্রি সেতু। এয়ার ফ্রান্সের সদর দপ্তরকে হাতের ডানে রেখে রাস্তা পার হলেই এই সেতুর দেখা মেলে। রাশিয়ান জার আলেকজান্ডারের নামানুসারে ১৮৯৬ সালে নির্মিত এ সেতুটিকে সেতু না বলে আর্ট গ্যালারি বললেও ভুল হবে না। পুরো সেতু জুড়েই দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যের সমারোহ।
সেতুতে প্রবেশের মুখেই অভ্যর্থনা জানান শিরস্ত্রাণ পরা দুই সৈন্য। দেবদূত, চপলা রমণী কিংবা পঙ্খিরাজের মেলবন্ধন দেখা যাবে এখানে, সেই সঙ্গে স্যেন নদীর সৌন্দর্য উপভোগ তো উপরি পাওনা। এখানেও সেক্রেকুর চার্চের মতো যুগলদের নামাঙ্কিত তালার অভাব নেই। একটা জাতির শিল্পবোধের পরিচয় পাওয়া যায় তাদের ভাস্কর্য, সাহিত্য, চিত্রকলা কিংবা সংগীতে। এদিক দিয়ে ফরাসিরা অনন্য।
সেতু পার হয়ে সজেঁ লিজের আশপাশে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাঁদের মধ্যে আছেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, ভেনেজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট সাইমন বলিভার এবং ফ্রান্সের স্বাধীনতার মহানায়ক শার্ল দ্য গল। শেষোক্তজনের ভাস্কর্যের পাশেই মেট্রোস্টেশন। পরবর্তী গন্তব্য লা’দিফস। আর সে জন্য চড়তে হবে ১ নম্বর মেট্রোয়। (চলবে)
ছবি: লেখক