সাজেদের সঙ্গে পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমবিএতে সে ছিল আমার সহপাঠী। খুব একটা ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও দুটি কোর্সে একসঙ্গে ক্লাস করায় পরিচয় ছিল। বর্তমানে প্যারিসনিবাসী সাজেদ তাই বারবার তাগাদা দিচ্ছিল যেন দেখা করি। দেখা করার জন্য লা’দিফস চমৎকার জায়গা। এখানকার দর্শনীয় স্থান হচ্ছে গ্র্যান্ড আর্ক। ৩৬০ ফুট উঁচু চতুর্ভুজাকৃতির এ বিশাল স্থাপনা আর্ক ডি ট্রায়াম্ফের আদলে তৈরি করা হয়েছে ১৯৮৯ সালে। প্যারিসের সর্ব পশ্চিমে এর অবস্থান। গ্র্যান্ড আর্কের সিঁড়িতে বসে ছিল সাজেদ।
অনেক দিন পর পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে আমেরিকানরা হ্যান্ডশেক করে, ফরাসিরা গালে গাল লাগিয়ে চুমু খায়, আর বাঙালিরা করে কোলাকুলি। ঝাড়া ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার বিশালবপু সাজেদের শরীরের চাপে যখন দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম, তখন বেচারা একটু সরে গিয়ে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিল।
গ্র্যান্ড আর্কের সামনে বিশাল চত্বর। দেখে বোঝারই উপায় নেই যে চত্বরের একদম নিচেই মহাব্যস্ত লা’দিফস মেট্রোস্টেশন। চত্বরের চারপাশে উঁচু উঁচু অট্টালিকা আর বাহারি সব শপিং মল। গ্র্যান্ড আর্কের সিঁড়িতে বসে কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণার পর বুঝলাম, ক্ষুধায় পেট মোচড় দিচ্ছে। ক্ষুধার ব্যাপারটা আগেই টের পেয়েছি, সম্ভবত খাবারের দোকান চোখে না পড়ার কারণে এতক্ষণ মনে আসেনি। ঢাকার নিউমার্কেটের মতো লাইন ধরে অনেক রেস্টুরেন্ট দৃষ্টিগোচর হওয়ায় নিজেকে সংবরণ করা সম্ভব হলো না। ম্যাকডোনাল্ডসে ঢুকতে গিয়ে দেখি লম্বা লাইন, এই লাইন পার হয়ে কাউন্টারে যেতে যেতে ক্ষুধায় অক্কা পাওয়ার আশঙ্কা আছে। অতএব স্থানীয় দোকানপাটই ভরসা। ছোট্ট একটি দোকান থেকে দুখানা ব্যাগেট (একধরনের বনরুটি, যার ভেতরে মাংস কিংবা সবজি দেওয়া থাকে) ও ম্যাকারন (একধরনের মিষ্টান্ন, যা বাইরে থেকে দেখতে শক্ত কিন্তু ভেতরে খুবই নরম) নিয়ে সিঁড়িতেই বসে গেলাম পেট ঠান্ডা করার অভিপ্রায়ে।
‘এই যে বাগেট খাচ্ছ, এটাকে প্যারিসের জাতীয় খাবার বলতে পার।’
‘কেন (জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে)?’
‘সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বেশির ভাগ প্যারিসবাসীই নাশতার সময় পায় না। রাস্তায় চলতে–ফিরতে কোনো এক দোকান থেকে এক হাত লম্বা বাগেট কিনে মেট্রোতে চড়ে বসে। জার্নিও হলো, খাওয়াও হলো।’
‘তাই নাকি, কিন্তু তেমন কিছু তো দেখলাম না মেট্রোতে?’
‘আরে ভাই, তুমি তো আছই কয়েক দিন ধরে। মাসখানেক থেকে যাও, সব দেখতে পাবে।’
‘ফ্রান্স সরকার তো আমাকে দুহপ্তার বেশি ভিসা দেয়নি। থাকব কীভাবে?’
‘সেটাও ঠিক (মাথা চুলকে)। খাবার কেমন লাগল?’
‘অসাধারণ (মন থেকেই বলছি)। আর কী কী আছে, যেটা তোমার পছন্দের?’
‘হা হা! যে দুটি পছন্দ, সেটার একটা বঙ্গদেশে যেকোনো রেস্টুরেন্টেই পাওয়া যায়। আরেকটা ফ্রান্সেও সহজলভ্য নয়, বাংলাদেশে তো নয়ই।’
‘কী জিনিস?’
‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর ফ্রেঞ্চ কিস।’
চারপাশ কাঁপিয়ে যেই হাসিটা সাজেদ দিল, তাতে বেশ কিছু লোকের যে পিলে চমকে গেছে, সে নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কয়েকজন তো আমাদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠেই গেল। সাজেদের হাসিতে যোগ দিতে আমারও আপত্তি নেই। এমনিতে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আমার বেশ পছন্দের। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্যারিসের রেস্টুরেন্টগুলোয় ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সহজলভ্য নয়।
কারণ, এটি ফরাসি হেঁশেলের কোনো অপরিহার্য অংশ নয়। তেলেভাজা এই আলুর টুকরাগুলোকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নামে ব্র্যান্ডিং করে আমাদের মাথায় ঢুকিয়েছে আমেরিকানরা। মূলত এটির উৎপত্তি ফ্রান্সের প্রতিবেশী বেলজিয়ামে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে দক্ষিণ বেলজিয়ামে। সেখানকার নদীতীরের অধিবাসীরা ভাজা মাছ খেয়ে অভ্যস্ত। শীতকালে নদীর পানি জমে বরফ হয়ে যাওয়ায় মাছ পাওয়া যেত না। সেই দুঃখ ভুলতে গ্রামবাসীরা আলু ফালি ফালি করে তেলে ভেজে খেয়ে নিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যরা এই বস্তুর নামকরণ করেন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। কারণ, দক্ষিণ বেলজিয়ামের লোকজন ফরাসি ভাষায় কথা বলে।
‘বউয়ের জন্য শপিং করবে না?’
এইবারে মোক্ষম প্রশ্নটা বেরিয়ে এল সাজেদের মুখ থেকে। আলবৎ করব, না করলে ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে যে দেশে ফিরলে অক্ষত থাকবে? এমনিতেই বউকে আশা দিয়ে রেখেছিলাম প্যারিস ট্রেনিংয়ে সঙ্গে নিয়ে যাব। সেই আশায় তো পানি ঢেলেছি আগেই। এখন যদি টুকটাক কিছু কিনেও না নিয়ে যাই, তাহলে কি আর শান্তিতে সংসার করা যাবে? গত রাতে এমনিতেই এক দফা ঝগড়া হয়েছে, যেটার সুরাহা এখনো হয়নি। সকালে সানডে মার্কেট থেকে একটা ব্যাগ পছন্দ করে ছবি পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিনে ফেলব নাকি?’ রাগের চোটে উত্তর দেয়নি। ক্ষতি অবশ্য তারই হয়েছে। এত চমৎকার একটি ব্যাগের মালিকানা হাতছাড়া করল।
সানডে মার্কেটের ব্যাপারটা একটু খোলাসা করা যাক। ধনীদের পকেট থেকে পয়সা খসানোর জন্য যেমন প্যারিসে আছে পৃথিবী বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের আউটলেট, তেমনি নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য আছে সানডে মার্কেট। প্রতি রোববার সকালে শহরের বিভিন্ন স্থানে রাস্তার ধারে এই বাজার বসে। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই মার্কেটে কী পাওয়া যায় জিজ্ঞেস না করে বরং কী পাওয়া যায় না, সেটা জিজ্ঞেস করাই ভালো।
কাঁচা সবজি থেকে শুরু করে পাকা ফল, ফুলগাছ থেকে শুরু করে পাথরের অলংকার, শুকনা মিষ্টি থেকে শুরু করে গ্রিলড চিকেন, ব্র্যান্ডের ঘড়ি থেকে শুরু করে চায়নিজ স্যুভেনির, কী নেই সেখানে। পকেটে ইউরো নিয়ে ঢুকলে বের হওয়ার সময় দেখা যাবে সেটা একদম গড়ের মাঠে রূপান্তরিত হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, জিনিসপত্রের দাম হাতের নাগালেই থাকে। এই যেমন আমাদের হোটেলের নিচতলায় ম্যাকডোনাল্ডস পেরিয়ে একটু এগিয়ে হাতের বাঁ পাশে সুপারশপ মনোপ্রি। মনোপ্রির ঠিক উল্টো পাশেই মেট্রোলাইনের নিচে সানডে মার্কেটে পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানদারেরা। যে জিনিসের দাম মনোপ্রিতে ৫ ইউরো, সেটি আপনি সানডে মার্কেটে ২ থেকে আড়াই ইউরোতেই পাবেন। মানের পার্থক্য কিন্তু খুব একটা বেশি নয়। বিকেলের মধ্যেই বাজার বন্ধ হয়ে যায় বলেই কিনা সারাক্ষণই ভিড় লেগেই থাকে।
আর যদি আপনি ফুটপাতে শপিং করা পছন্দ না করেন আবার খুব বেশি খরচ করতেও অনিচ্ছুক, তাহলে লা’দিফস একদম আপনার অপেক্ষায়ই সেজেগুজে বসে আছে। ব্র্যান্ড কিংবা নন-ব্র্যান্ড কোনো দোকানেরই অভাব নেই। অশো এমনই এক দোকান, যেখানে এক ছাদের নিচে সবই পাওয়া যায়। অনেকটা আমাদের দেশের আগোরা, প্রিন্স বাজার কিংবা স্বপ্নের মতো আরকি। চকলেট কিংবা সাবান-শ্যাম্পু কেনার জন্য জায়গাটা চমৎকার। চায়নিজ জিনিসপত্রে চারপাশের দোকানপাট ভরপুর।
আদি এবং আসল ফরাসি জিনিসপত্র দুর্লভ নয়, তবে দামটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নাগালের বাইরে থাকে। এখানে এক ইউরোতেও সুগন্ধি মেলে, তবে সেটার কোয়ালিটি মেড ইন জিঞ্জিরাকে ছাড়াতে পারবে না। কাপড়চোপড়ের দোকানে ঢুকে অবশ্য গর্বে বুকের ছাতি কয়েক ইঞ্চি ফুলে গেল। এইচঅ্যান্ডএম কিংবা মার্ক অ্যান্ড স্পেনসারের সব আউটলেটেই দেখি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ লাগানো শার্ট আর জিনসের প্যান্ট। আহা, বিদেশবিভুঁইতে এসব দেখে যে কী শান্তি পাওয়া যায়, সেটা কীভাবে বোঝাই? (চলবে)
ছবি: লেখক