মমার্ত পাহাড়ের চূড়া থেকে নতরদাম গির্জার চাতালে ১
শেয়ার করুন
ফলো করুন

প্যারিসে থাকাকালে আপনাকে দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, দেশি ভাইদের সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হলে আবেগাপ্লুত হয়ে গপ্পো শুরু করবেন না। দ্বিতীয়ত, কেউ আগ বাড়িয়ে উপকার করতে চাইলে, বিশেষত সেই ব্যক্তি যদি আফ্রিকান অভিবাসী হয়ে থাকেন, তাহলে বিগলিত হবেন না। কারণ, সেই উপকার গ্রহণ করুন কিংবা না করুন, সময় দিলেই ফেঁসে যাবেন।

ফ্রান্সের বাংলাদেশ কমিউনিটির পরিচিত মুখ রবি ভাইয়ের বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে। বছর দশেক আগে প্যারিসে আস্তানা গেড়েছিলেন। এই ১০ বছরে বহু ঘাটের পানি পান করে পোক্ত হয়েছেন। ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। চাকরি করছেন। প্যারিসের উপকণ্ঠে স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে ভাইয়ের সুখের সংসার। তাঁর আরও একটা পরিচয় হচ্ছে তিনি আমাদের কান্ট্রি ম্যানেজারের আপন ছোট ভাই। ওনার বাসায় দুপুরের খাওয়ারর দাওয়াত দিতে হোটেলে চলে এসেছেন।

দুইখানা ফ্রি টিপস পেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই রবি ভাই বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন। প্রচুর বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী বর্তমানে ফ্রান্সে, বিশেষ করে প্যারিসে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। দেশি কাউকে পেলেই তাঁরা চেপে ধরেন— কোনোভাবে যদি মন গলিয়ে কিছু উপকার আদায় করে নেওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন

এর বাইরে প্রচুর আফ্রিকান বিশেষ করে ফ্রান্সের পূর্বতন উপনিবেশগুলোর অবৈধ অভিবাসী প্যারিসের আনাচকানাচে অবস্থান নিয়েছেন। দিন গুজরান করার জন্য বেশির ভাগই বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের আশপাশে সু৵ভেনির বিক্রি করে বেড়ান। তাঁদের মধ্যে অনেকেই পর্যটকদের বিভিন্ন বস্তু কেনার জন্য প্রলুব্ধ করেন। ভুলক্রমে কেউ যদি সেগুলো নাড়াচাড়া করেন, তাহলেই হয়েছে! কোনো না কোনোভাবে সেই বস্তু নেওয়ার জন্য তাঁকে ফাঁসানো হয়। এমন ঘটনা ঢাকার নিউমার্কেটেও ঘটে। পার্থক্য হচ্ছে, নিউমার্কেটে আপনি ঝাড়ি মেরে কাটিয়ে দিতে পারলেও এখানে সেই সাহস পাবেন না।

প্যারিসের জনপ্রিয় গণপরিবহন মেট্রো। মেট্রোতে চলাচলের জন্য দুই ধরনের টিকিটের ব্যবস্থা আছে। প্রতি যাত্রার জন্য নির্দিষ্ট টিকিট এবং এককালীন বিশেষ টিকিট বা নেভিগো পাস। নেভিগো পাস অনেকটা প্রিপেইড কার্ডের মতো। ২২ ইউরো মূল্যের এই পাস দিয়ে মেট্রোর পাশাপাশি বাস এবং আরইআর (মেট্রোর চেয়ে দ্রুতগতির দ্বিতল ট্রেন)-এও চলা যায়। তবে সে জন্য সপ্তাহে ১৯ ইউরো রিচার্জ করতে হয়।

আমাদের হোটেলের ঠিক বিপরীত পাশেই ‘লা মোতে পিকে গ্রেনেল’ নামক মেট্রো স্টেশন। রবি ভাই আমাদের নেভিগো পাস কিনতে সহায়তা করলেন। ভিজিটিং কার্ডের আকৃতির এই পাসে বাহকের ২ বাই ২ ইঞ্চির একটি ছবি সেঁটে দিতে হয়। আগামী ১০ বছরের যেকোনো সময় আবারও প্যারিসে এলে এই কার্ডখানা ব্যবহার করা যাবে। কেবল রিচার্জ করলেই চলবে।

বিজ্ঞাপন

রবি ভাই থাকেন মেরি দ্য সেন্তোয়া নামক জায়গায়। মূল শহরের শেষ প্রান্তের এ জায়গাকে শহরতলি বলাই উত্তম। যদিও আমরা সরাসরি মেরি দ্য সেন্তোয়াতে না নেমে আগের স্টেশন সেন্তোয়াতে নেমেছিলাম। উদ্দেশ্য মুঠোফোনের সিম কেনা। এমনিতে ফ্রান্সে মুঠোফোনের সিম কেনা বেশ ঝামেলার কাজ। বিমানবন্দরে টুরিস্টদের জন্য সিমকার্ড পাওয়া যায়; কিন্তু দাম ৫০ ইউরোর কম নয়। তার ওপর পাসপোর্টের কপিসহ বিভিন্ন কাগজপত্র জমা দিতে হয়। শর্টকাট ব্যবস্থার জন্য রবি ভাইয়ের মতো ‘কামেল’ বান্দার সাহায্য নিতে হবে। সেন্তোয়া স্টেশনের পাশেই উন্মুক্ত বাজার, বাজারে সবজি থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। যাঁদের মধ্যে আরবদেশীয় অভিবাসীদের আধিক্য স্পষ্ট। ছোট্ট একটি দোকানে সিমকার্ড বিক্রি হচ্ছে। মাত্র ৫ ইউরো দিয়ে ৫০০ মিনিট টকটাইমসহ একখানা ‘লাইকা মোবাইল’ সিমকার্ডের গর্বিত মালিক বনে গেলাম ১৫ দিনের জন্য। যদিও পাসপোর্টের একখানা ফটোকপি দোকানদার রেখেছেন; কিন্তু হাবভাব দেখেই বুঝলাম, এ নেহায়েতই আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা।
রবি ভাইয়ের বাসায় সময়টা চমৎকার কেটেছে। দুই কক্ষের ছোট্ট বাসার ব্যালকনিতে দাঁড়ালে সিন নদীর শোভা দেখা যায়। বাচ্চা দুটির বয়স পাঁচ বছরের বেশি নয়। ভাবি অত্যন্ত হাসিখুশি, রান্নার হাতও চমৎকার। বিশেষ করে গরুর মাংসের ভুনা আর ইলিশের দোপেঁয়াজার স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে। ভেবেছিলাম, বিদেশ–বিভূঁইতে না খেয়ে থাকতে হবে; কিন্তু প্রথম দিনই যে আল্লাহ এমন চমৎকার বন্দোবস্ত করে রেখেছেন, সেটি কে জানত?

হাতে যেহেতু পর্যাপ্ত সময় ছিল, তাই খাওয়ার পর রবি ভাই বের হলেন আমাদের চারপাশ ঘুরে দেখাতে। এই আবাসিক এলাকাটা অপেক্ষাকৃত নতুন। যেসব অভিবাসী ফ্রান্সের মূলধারায় মিশে গেছেন, তাঁদের সংখ্যাই বেশি। চমৎকার একটি পার্ক আছে। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে, খেলছে। কেউ কেউ আবার বাগান তৈরির প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সাদাকালো, তামাটে কারও মধ্যেই কোনো ভেদাভেদ নেই। এখানকার সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় বাচ্চাদের চিত্তবিনোদনের জন্য

পার্কের প্লে গ্রাউন্ডে খেলা করছে বাচ্চারা
পার্কের প্লে গ্রাউন্ডে খেলা করছে বাচ্চারা

পার্ক বা খোলা জায়গা থাকা বাধ্যতামূলক। শিশুর মনন বিকাশে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ঢাকা শহর তো বটেই নিজের শহর কিশোরগঞ্জের কথা মনে হতেই একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সব ফাঁকা জায়গা আমরা ঢেকে দিচ্ছি অট্টালিকায়। কিসের মনন, কিসের মানসিকতা? আমাদের দরকার শুধু টাকা আর টাকা। এ জন্য প্রকৃতি ধ্বংস করতে হবে? খেলার মাঠ দখল করতে হবে? জলাশয় ভরাট করতে হবে? কুচ পরোয়া নেই। প্রভাবশালীদের সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় মানুষের তো আর অভাব পড়ছে না। আমরাই ছোটবেলায় যেই পরিমাণ মাঠেঘাটে দৌড়িয়েছি, আমাদের বাচ্চারা তো সেটির এক–দশমাংশও সুযোগ পাবে না।

মমার্ত পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখা প্যারিস শহর
মমার্ত পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখা প্যারিস শহর

নেভিগো পাস কেনার সময় রবি ভাই প্যারিসের দুটি মানচিত্র আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। একটাতে শহরের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলো চিহ্নিত করা আছে, অন্যটায় মেট্রো লাইনগুলো স্পষ্টভাবে দেখানো আছে। পুরো প্যারিস ভ্রমণে এই দুই মানচিত্র আমাকে ভীষণ সাহায্য করেছে। সেদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, দুটি জায়গা ঘুরে দেখব। একটি মমার্ত পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত সেক্রেকার ব্যাসিলিকা, অন্যটা বিখ্যাত নতরদাম ক্যাথেড্রাল। মেরি ডি সেন্তোয়া থেকে মমার্ত যাওয়ার জন্য মেট্রোর প্রয়োজন নেই। পার্কের প্রবেশপথের উল্টোদিকেই বাসস্টপ। ৮৫ নম্বর বাসে চড়ে মুলার স্টেশনে নেমে ৫ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে মমার্ত পাহাড়ের অবস্থান।

মমার্ত এলাকার নাম রাখা হয়েছে মমার্ত পাহাড়ের নামে। একসময় এই এলাকা ছিল প্যারিসের মূল শহরের বাইরে। ১৮৬০ সালের পয়লা জানুয়ারি জায়গাটিকে মূল শহরের সঙ্গে একীভূত করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, মমার্ত পাহাড়ে আপনি কেন যাবেন? উত্তর দিতে চেষ্টা করি। আপনি যদি প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে সেখানে পাবেন দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শতাব্দীর রোমান সাম্রাজ্যের প্রত্ননিদর্শন। আপনি যদি ইতিহাস নিয়ে উৎসুক থাকেন, তাহলে মমার্ত পাহাড় হবে আপনার জন্য উৎকৃষ্ট ভ্রমণ গন্তব্য। ১৫৯০ সালের ধর্মযুদ্ধ, ১৭৯০ সালের ফরাসি বিপ্লব কিংবা ১৮১৪ সালের প্যারিস যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই পাহাড়। ১৫৯০ সালে প্যারিস অবরোধের সময় রাজা চতুর্থ হেনরি এই পাহাড়ের চূড়ায় তাঁর গোলন্দাজ বাহিনীকে নিয়োজিত রেখেছিলেন শহরে বোমাবর্ষণের জন্য। ১৮১৪ সালে রুশ সেনাবাহিনীও একই কাজ করেছিল। আপনি যদি অনেক উঁচু থেকে প্যারিস শহর কেমন দেখায়, সেটি দেখতে চান এবং টাকা খরচ করে আইফেল টাওয়ারে চড়তে না চান, তাহলে নির্দ্বিধায় এখানে চলে আসতে পারেন। মমার্ত পাহাড় প্যারিসের দ্বিতীয় উচ্চতম স্থান (সেক্রেকার গির্জাসহ এর উচ্চতা ২১৩ মিটার)।

দূর থেকে চোখে পড়ে মমার্ত পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত সেক্রেোর গির্জা
দূর থেকে চোখে পড়ে মমার্ত পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত সেক্রেোর গির্জা

স্থাপত্যকলা নিয়ে যদি আপনি আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে মমার্ত পাহাড়চূড়ায় আপনি পরিদর্শন করতে পারবেন অতি উৎকৃষ্ট ঐতিহাসিক স্থাপনা সেক্রেকার অ্যান্ড সেন্ট পিয়েরে দ্য মমার্ত ব্যাসিলিকা। আর যদি আপনি শিল্প এবং সাহিত্যের সমঝদার হয়ে থাকেন, তাহলে তো এটা হবে আপনার তীর্থস্থান। প্যারিসের শিল্প-সাহিত্যের বহু রথী মহারথী এখানে কেবল চরণস্পর্শ দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং তাঁদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় এখানেই কাটিয়েছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখখযোগ্য হচ্ছেন ক্লদ মোনে, পিয়ের অগুস্ত রেনোয়াঁ, এদগার দেগা, এমেদিও মদিগ্লিয়ানি, ক্যামিল পিসারো, পাবলো পিকাসো, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। প্রথমোক্ত জন তো ‘ইম্প্রেশানিজম’ নামে চিত্রকলার নতুন একটি ধারাই প্রবর্তন করেছেন। ১৯০৭ সালে পাবলো পিকাসো এখানে অবস্থানকালে এঁকেছিলেন তাঁর অন্যতম বিখ্যাত সৃষ্টি ‘লি ডোমোযেল দ্য অ্যাভিনন’ বা ‘অ্যাভিননের বারবনিতারা’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অবশ্য শিল্পীদের এই মিলনমেলা ভেঙে যায়।

সিঁড়ির অনেকগুলো ধাপ ভেঙে পাহাড়চূড়ায় উঠতে হয়। গ্যারান্টি দিচ্ছি, এখান থেকে প্যারিস শহরের শোভা দেখলে সেই কষ্ট উবে যেতে সময় নেবে না। ছুটির দিন বলেই হয়তো প্রচুর ভিড়। লাইন ধরে সবাই গির্জায় ঢুকছে। পা দুটিকে দুদণ্ড শান্তি দেওয়ার পাশাপাশি শহরটার ওপর চোখ বুলানো যাক। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্যারিস সুন্দর; কিন্তু সব সময়ই কি এমন সুন্দর ছিল? বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জা জ্যাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) তাঁর ‘কনফেশন’ গ্রন্থে প্যারিসের একটি বর্ণনা দিয়েছেন। যেটি পড়লে যে কেউই কিছুটা হলেও ধাক্কা খাবে। ‘কনফেশন’-এর বাংলা অনুবাদ করেছেন সরদার ফজলুল করিম ‘আমি রুশো বলছি’ নামে। সেখান থেকে উদ্ধৃতি দিলাম,
‘আহা আমার প্যারি বা প্যারিস! তার দুর্গ দিয়ে আমি রুশো অবশেষে প্রবেশ করলাম।

গির্জার সিঁড়িতে দর্শনার্থীদের ভিড়
গির্জার সিঁড়িতে দর্শনার্থীদের ভিড়

কিন্তু হা–হতোস্মি! কী আমার ভাগ্য! এই কি আমার স্বপ্নের প্যারিস! তুরিনের সেই বাহার আর প্যারিসের এই দুর্গন্ধ ভরা বস্তি! তুরিনের রাস্তার কী সৌন্দর্য, লম্বা লাইন বাঁধা সড়ক, সড়কের পাশে সৌন্দর্যময় গৃহসমূহ। তাই দেখে ভেবেছিলাম, প্যারিস হবে তুরিনের চাইতেও বাহারি, সুন্দর। আমাকে উদ্বুদ্ধ করে দেবে আমার স্বপ্নের প্যারি। কিন্তু এ আমি কী দেখলাম! কোথায় আমার কল্পনার প্যারিস, বৃহৎ আকাশছোঁয়া প্যারিস, সৌন্দর্যের রানি! সুন্দর বাদে যার কুৎসিত হওয়ার উপায় নেই। সুন্দর হবে যার সড়ক। মার্বেল পাথরে বাঁধাই করা। স্বর্ণের মন্দিরবৎ গৃহরাজি।

সেন্ট মার্সের শহরতলি দিয়ে এই প্যারিসে ঢুকে আমি যেন অদৃশ্য পাতালের এক নরকের মধ্যে আমার প্রবেশ দেখলাম। দুর্গন্ধে ভরা খুদে সব গলি। ক্লান্তদেহী বিত্রস্ত সব মানুষ। হাঁটছে না যেন ঝিমুচ্ছে। দারিদ্রে৵র শেষ নেই। ঠেলাগাড়িগুলো যত্রতত্র পড়ে আছে। পুরোনো কাপড়ের হকারগুলো হাঁক ছাড়ছে। ধেনো মদের সরাই। পুরোনো হ্যাট মাথায় সড়কভর্তি মানুষ। আহা! এই আমার প্যারি প্রবেশ। শুরুতেই এমন? এই শুরুটাই আমাকে শেষ করেছে। যা কিছু মহৎ আমি আবিষ্কার করেছি প্যারিসে, আমার পরবর্তী জীবনে তার কোনো কিছুই আমার প্যারিস প্রবেশের এই দৃশ্য থেকে আমাকে মুক্তি দিতে পারেনি। আমি বলব, এরপরে যতটা কাল আমি কাটিয়েছি প্যারিসে, তার সবটাই যেন আমি ব্যয় করেছি সেই প্রথম দিনের দুঃসহ দৃশ্যের স্মৃতি থেকে মুক্তির অন্বেষণে।’
ঠিক তার ১০০ বছর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবারের মতো প্যারিসে এসেছিলেন। দেশে ফিরে কবি লিখেছিলেন ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’ যেখানে আবার প্যারিসের সম্পূর্ণ অন্য রূপ দেখা যায়।

স্যেন নদীর তীরে বসে সুনীল আর মার্গারিটার কথাই ভেবেছেন লেখক
স্যেন নদীর তীরে বসে সুনীল আর মার্গারিটার কথাই ভেবেছেন লেখক

‘সকালবেলায় প্যারিসে গিয়ে পৌঁছলেম। কি জমকালো শহর! সেই অভ্রভেদী প্রাসাদের অরণ্যের মধ্যে গিয়ে পড়লে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। মনে হয়, প্যারিসে বুঝি গরীব লোক নেই। আমার মনে হল, এই সাড়ে তিন হাত মানুষের জন্যে এমন প্রকাণ্ড জমকালো বাড়িগুলোর কি আবশ্যক! একটা হোটেলে গেলেম, তার সমস্ত এমন প্রকাণ্ড কাণ্ড যে, ঢিলে কাপড় পরে যেমন সোয়াস্তি হয় না, সে হোটেলে থাকতে গেলে আমার বোধ হয় তেমনি অসোয়াস্তি হয়। একটা ঘরের মধ্যে কোথায় মিশিয়ে যাই, তার ঠিক নেই। স্মরণস্তম্ভ, উৎস, বাগান, প্রাসাদ, পাথরে বাঁধানো রাস্তা, গাড়ি, ঘোড়া, জলকোলাহল প্রভৃতি দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়।’

এই একশ বছরে কি এমন জাদুর কাঠির স্পর্শে প্যারিস এত বদলে গেল? এর উত্তর আমি নিজের মতো করে বের করেছি, ফ্রান্সের উপনিবেশবাদ। ঔপনিবেশিক আমলে আফ্রিকার অনেকগুলো দেশেই ফ্রান্স তার কলোনি স্থাপন করেছিল। সেগুলোর সম্পদ শুষে প্যারিস তথা ফ্রান্স নিজেকে সাজিয়েছিল। এই কাজই ব্রিটিশরা করেছিল ভারতীয় উপমহাদেশে। ব্রিটিশ আর ফরাসিদের মধ্যে একটি পার্থক্য কিন্তু আছে। ব্রিটিশরা তাদের কলোনিগুলোকে স্বাধীনতা প্রদানের সময় আর কোনো চুক্তি করেনি; কিন্তু ফ্রান্স আফ্রিকার সবগুলো দেশকে শর্তহীন স্বাধীনতা প্রদান করেনি। বরঞ্চ স্বাধীনতা প্রদানের সময় দুর্বল দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক কিছু চুক্তি করে। আর এই চুক্তির গ্যাঁড়াকলে পড়ে দেশগুলো প্রতিনিয়তই হারাচ্ছে তাদের স্বকীয়তা।
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন