ইদানীং হই আনের নাম অনেক শুনেছি। শহরটি ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শহর হিসেবে এর পরিচিতি ছিল। শহরের পুরোনো অংশটি চমৎকারভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ অংশে এখনো বাজার বসে। দোকানগুলোয় যেসব পণ্যের পসরা সাজানো আছে, সেগুলোর দাম শুনলে অবশ্য হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা ৪০০ বছরের পুরোনো এক জাপানি সেতু। হোয়াই নদী থেকে বের হওয়া এক খালের ওপর সেতুটির অবস্থান। এটা পার হয়েই ওল্ড টাউনে যেতে হয়। সেতুটি দেখে খুবই হতাশ হয়েছি। ভিডিওতে দেখা এবং সামনাসামনি দেখার মধ্যে কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! সংস্কারের পর শহরের প্রাচীন ভাবটা অনেকখানিই চলে গেছে। কেমন যেন কৃত্রিম লাগে।
হই আনের সত্যিকারের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে সন্ধ্যার পর। এই শহরের ট্রেডমার্ক হচ্ছে লন্ঠন। সরু রাস্তার দুধারের দোকানগুলোয় হরেক বর্ণের লন্ঠন জ্বলে ওঠার পর দেখি, শহরের চেহারাই পাল্টে গেছে। দিনের আলোয় শহর দেখে যে হতাশা ঘিরে ধরেছিল, সন্ধ্যাবেলায় সেই জায়গা দখল করে নিল অপার মুগ্ধতা। বিশেষ করে হোয়াই নদীর ওপর শয়ে শয়ে নৌকা যখন লন্ঠন জ্বালিয়ে ঘুরছে, তখন ইচ্ছা করছিল, আমিও লন্ঠন হাতে সেই দলে শামিল হই। পরিবহনের ঝামেলা না থাকলে বেশ কিছু লন্ঠন নিশ্চিতভাবেই কিনে ফেলতাম। হই আন সুন্দর। তবে এর চেয়ে অধিক সুন্দর আমাদের পানামনগর। আফসোস, আমরা সেটার রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছি না ঠিকমতো।
হই আন থেকে ফেরার পথে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বাইকের গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের ওপরও তুলেছি। বাংলাদেশে কেন এত বাইক দুর্ঘটনা ঘটে, সেটা বুঝতে পারছি। গতি আসলে নেশার মতো। মজা পেয়ে গেলে কেবল বাড়াতেই ইচ্ছা করে। উচ্চগতির কারণেই কি না আধা ঘণ্টায় দানাং পৌঁছে গেলাম। তিন রাস্তার মোড়ে সৈকতের বেশ বড় একটা অংশ ঢালাই করা। দুনিয়ার কমন ট্রেন্ডে গা ভাসিয়ে এখানেও বড় করে লেখা আছে ‘আই লাভ দানাং’। ওদিকে নজর না দিয়ে ফাঁকা বেঞ্চিতে বসামাত্রই শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠল ঠান্ডায়। হো চি মিন সিটির গরমে সেদ্ধ হয়ে দানাংয়ের এমন ঠান্ডা আবহাওয়া বেশ ভালো লাগছিল। পরদিন আমাদের গন্তব্য গোল্ডেন ব্রিজ।
ভিয়েতনাম নিয়ে গুগলে সার্চ দিলে যে দুটি স্থানের ছবি সবার আগে ভেসে ওঠে, তার একটি হা লং বে, অন্যটি গোল্ডেন ব্রিজ। দৈত্যাকার দুই হাতের তালুর মধ্যে ছোট্ট এই ব্রিজের অবস্থান দানাং শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ৫ হাজার ফুট উঁচু ‘বা না’ পাহাড়ে। দানাং থেকে বা না পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তাটা অদ্ভুত সুন্দর। ছয় লেনের এক রাস্তা সরলরেখার মতো এগিয়ে পাহাড়ে উঠে গেছে। রাস্তার মাঝখানে সড়ক বিভাজক থাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম। পুরো রাস্তায় মানুষের দেখা পেয়েছি খুবই কম। তীব্রগতির কিছু গাড়ি কেবল হুস করে পাশ দিয়ে চলে যায়। বা না পাহাড়ের কাছাকাছি পৌঁছে একজন সাইকেল আরোহী আর একজন দৌড়বিদের দেখা মিলল। দুজনের কেউই ভিয়েতনামের নাগরিক নন।
গোল্ডেন ব্রিজে ওঠার জন্য চড়া মূল্যের টিকিট কাটতে হয়। এত দাম দিয়ে টিকিট কেটেও যে পুরো জায়গার সৌন্দর্য আস্বাদন করা যাবে, সেটির কিন্তু নিশ্চয়তা নেই। সমুদ্রসমতল থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় বছরের ৯ মাসই জায়গাটা মেঘ কিংবা কুয়াশায় ঢাকা থাকে। টিকিট কাউন্টারে একটা এলসিডি মনিটর আছে, যেটিতে ওপরের অবস্থা দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে দেখি, পুরো জায়গাই মেঘে ঢাকা। এরপরও টিকিট কাটব কি না জিজ্ঞাসা করল। আমাদের দুই সঙ্গী টিকিট না কেটেই ফিরে গেল। এত দূর এসে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। তার ওপর এই জায়গায় আবারও কোনো দিন যে আসব, সেটার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। বাকি সবাই তাই এগিয়ে চললাম।
যে কেব্ল কারে করে ওপরে পৌঁছাতে হয়, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী সেটি পৃথিবীর দীর্ঘতম কেব্ল কার। ওঠার সময় প্রথম দিকে চারপাশের দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যায়। বিশেষ করে একটা ঝরনার সৌন্দর্য নজর কাড়ে। অল্প সময় পরই মেঘের কারণে সব অদৃশ্য হয়ে যায়। পৌঁছানোর পর শীতের দাপটে শরীর কেঁপে উঠল। বুঝতে পারিনি এত ঠান্ডা লাগবে, তাহলে শীতের কাপড় আনতে ভুলতাম না। পুরো জায়গাই একটা রিসোর্টের আদলে সাজানো হয়েছে। গোল্ডেন ব্রিজে লোকজনের ভিড়ে হাঁটাই দায়। তার ওপর কুয়াশার আধিক্যে তিন হাত দূরের বস্তুও দেখা যাচ্ছে না। এখান থেকে চারপাশ দেখার ইচ্ছাটা অধরাই থেকে গেল।
এ জায়গা আবিষ্কার ও উন্নয়নের মূল কৃতিত্ব ফরাসিদের। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা যেমন গ্রীষ্মকালীন গরম থেকে বাঁচার জন্য দার্জিলিং ও শিমলার উন্নয়ন ঘটিয়েছিল, ফরাসিরা কাজ করেছিল এখানটায়। ফ্রান্সের গ্রাম ও বাগানের আদলে এখানে তারা ফ্রেঞ্চ গার্ডেন ও ফ্রেঞ্চ ভিলেজ নির্মাণ করে ১৯১৯ সালে। ফ্রেঞ্চ গার্ডেনে আছে হরেক রকমের ফুলের সমারোহ। ডিজনি কার্টুনের বিভিন্ন চরিত্রকে বাগানের আনাচকানাচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ফ্রেঞ্চ ভিলেজে ঢুকে মনে হয়েছে, সত্যিই ফ্রান্সের কোনো গ্রামে চলে এসেছি। ওয়াইনের দোকান, রেস্তোরাঁ, চার্চ, বাড়িঘর, মানুষ আর প্রাণীর ভাস্কর্য—কী নেই সেখানে! এমনকি বিয়ারের একটি ফ্যাক্টরিও আছে। আমাদের টিকিটের সঙ্গে বিয়ারের কুপন দিয়েছে, যেটা এখানে ভাঙিয়ে ফ্রি বিয়ার পাওয়া যাবে। নিজে খাই না বলে অন্যদের বিলিয়ে দিলাম। পুরোটা সময় আমাদের মেঘ আর বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে। আবহাওয়া সুন্দর থাকলে চারপাশের দৃশ্যাবলি আরও ভালোভাবে দেখা যেত। তারপরও যা দেখেছি, সেটাই অনেক। কেব্ল কারের ভ্রমণটাও দারুণ ছিল। এখানটা না ঘুরলে নিশ্চিতভাবেই আফসোস করতাম।
দানাং ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে। সাশ্রয়ী মূল্যে শপিংয়ের জন্য এখানে আছে সুপারশপ ‘গো দানাং’। বাচ্চাদের জন্য কিছু কিনে না নিয়ে গেলে মন খারাপ করবে। চকলেট কিনতে গিয়ে বিস্মিত হলাম। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন সুপারশপে এত দিন দেখে এসেছি বিভিন্ন ধরনের চকলেটের বাক্স থাকে, যার যেটা পছন্দ কিনে নেয়। এখানে ব্যাপারটা আলাদা। হরেক রকমের এবং বিভিন্ন দামের চকলেট বিশাল জায়গা নিয়ে স্তূপ করে রাখা। যেটা পছন্দ, সেটা কেজি দরে কিনতে হবে। এর সুবিধা হলো অল্প অল্প করে সব ধরনের চকলেটই কেনা যায়। অসুবিধা হলো সব ধরনের চকলেটই কিনতে মন চায় বলে শেষ পর্যন্ত পরিমাণে বেশিই কেনা হয়। দিন শেষে খরচ ঠিকই হয়, তবে মানসিক একটা শান্তি পাওয়া যায়।
দানাং ঘুরে আমি আনন্দ পেয়েছি। কেবল দানাং নয়, পুরো ভিয়েতনাম দেশটাই দারুণ পছন্দ হয়েছে। মানুষগুলো যেমন ভালো, দেশটাও তেমন সুন্দর। আমাদের রাজনীতিবিদেরা প্রায়ই বলেন, বাংলাদেশ নাকি সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড হয়ে গেছে। দেশের জনগণের সঙ্গে এগুলো একধরনের মশকরা বলেই আমি মনে করি। দেশ যদি এতই ভালো চলে, তাহলে উনারা নিজেদের ছেলেমেয়েকে ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় পাঠান কেন? দেশের সম্পদ বিদেশে কেন পাচার করেন? সিঙ্গাপুর তো দূরের কথা, বাংলাদেশ এখনো ভিয়েতনামের কাতারেই যেতে পারেনি। শুধু জিডিপি দিয়ে উন্নয়ন মাপলে তো চলবে না; নিরাপত্তার যে বোধ আমি এখানে অনুভব করেছি, সেটি আজ অবধি ঢাকায় অনুভূত হয়নি।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দৌড়াতে বের হলাম। আজই দানাংয়ে শেষ দিন। উন্মুক্ত সৈকতে ১০ কিলোমিটার দৌড়ানোর পাশাপাশি সমুদ্রের সৌন্দর্য দর্শনে গত ৩ দিনের ভ্রমণক্লান্তি উবে গেছে। দুপুরের ফ্লাইটে ঢাকা ফিরে যাব। শেষবারের মতো শহরটায় একটা চক্কর দেওয়ার অভিপ্রায়ে বাইক নিয়ে হান নদীর তীরে চলে এলাম। নদীর তীর ঘেঁষে সুন্দর পায়ে চলা পথ। পথের একটা অংশ নদীর ভেতরে বেশ খানিকটা এগিয়ে থেমেছে। এখান থেকে ড্রাগন সেতুর পুরোটা দৃশ্যমান হয়। সতর্কতার খাতিরে পথের দুধারে রেলিং দেওয়া আছে। সেই রেলিং ভরে আছে হাজার হাজার তালায়।
প্যারিসের আলেকজান্ডার থ্রি সেতুর রেলিংয়ের কথা মনে পড়ে গেল। একদম নতুন তালা যেমন আছে, তেমনি ১০ বছর আগের তালাও চোখে পড়েছে। কাছেই একটা দোকানে তালা বিক্রি হচ্ছে। আপনি চাইলে নামও লিখে দেবে। একটা লাল রঙের তালা খুব মনে ধরল। দোকানিকে বলামাত্রই সুন্দর করে তালায় আমাদের নাম লিখে দিল। তালাটা রেলিংয়ে আটকে চাবিটা নদীতে ছুঁড়ে ফেললাম। মেয়েদের বলে যাব, যদি কোনো দিন তারা দানাং ঘুরতে আসে, তাহলে যেন তালাটা খুঁজে বের করে মা–বাবাকে কথা স্মরণ করে।
ছবি: লেখক