যুগোস্লাভিয়ার স্মৃতি থেকে সার্বিয়ার নিস শহরে একদিন!
শেয়ার করুন
ফলো করুন

যুগোস্লাভিয়া, মার্শাল টিটো, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন—সবই আজ ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস মানেই তো ফুরিয়ে যাওয়া নয়; বরং এটি বেঁচে থাকে বইয়ের পাতায়, মানুষের স্মৃতিতে, আর কখনো কখনো ভ্রমণের পথেও।

উত্তর মেসিডোনিয়া থেকে স্থলসীমান্ত পেরিয়ে সার্বিয়ায় প্রবেশ
উত্তর মেসিডোনিয়া থেকে স্থলসীমান্ত পেরিয়ে সার্বিয়ায় প্রবেশ

বর্তমান সার্বিয়া একসময় ছিল সাবেক যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপে যুগোস্লাভিয়া ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। দেশটির নেতৃত্বে ছিলেন বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটো, যিনি পশ্চিমা ব্লক ও সোভিয়েত ব্লকের বাইরে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই ভারত, মিসর, ইন্দোনেশিয়াসহ একাধিক দেশ মিলে গড়ে ওঠে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা নন-অ্যালায়েন্স মুভমেন্ট। এর লক্ষ্য ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বাধীন কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠা করা।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই এই আন্দোলনের অংশ হয়। শুরুতে আমাদের দেশের কূটনৈতিক দর্শনও নিরপেক্ষতার ওপর দাঁড়ানো ছিল, আর সেই সূত্রেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুগোস্লাভিয়ার সম্পর্ক দ্রুত ঘনিষ্ঠ হয়। ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ অর্জনের পেছনেও যুগোস্লাভিয়ার সমর্থন ছিল উল্লেখযোগ্য। এই ইতিহাস মনে রেখেই আমি পাড়ি জমালাম সার্বিয়ার নিস নামের এক প্রাচীন শহরে।
আমার যাত্রা শুরু হয় উত্তর মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কপিয়ে থেকে। ভোরবেলা শহরের বাসটার্মিনালে গিয়ে দেখি, চারপাশে ব্যস্ততার চিত্র—কেউ লাগেজ হাতে দৌড়াচ্ছে, কেউ অপেক্ষার আসনে বসে আছে, আবার কেউ ধীরে ধীরে সকালের কফি চুমুক দিচ্ছে। আগে থেকেই আমার টিকিট কাটা ছিল, তাই নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখান থেকে বলকান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাস ছাড়ে।

নিস দুর্গের ভেতরে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় লেখক
নিস দুর্গের ভেতরে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় লেখক

সময়মতো বাস এল। আমি উঠে বসলাম সার্বিয়ার নিস শহরের উদ্দেশে। বাসে ফ্রি সিটিং ব্যবস্থা, তাই আগে থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে সামনের সিটটা জুটিয়ে নিলাম। সামনের বড় কাচের জানালা দিয়ে পথ দেখা—সড়ক ভ্রমণের অর্ধেক আনন্দই যেন সেখানে! চার ঘণ্টার যাত্রায় পাহাড়, সবুজ মাঠ আর ছোট ছোট গ্রাম ও শহর পেছনে ফেলে এলাম। সীমান্ত পেরোতেই দৃশ্যপটও যেন কিছুটা বদলে গেল।

বিজ্ঞাপন

সার্বিয়ায় ঢুকেই প্রথম অভিজ্ঞতা হলো ধমক খাওয়া! সামনের সিটে বসার কারণে ড্রাইভারের নির্দেশমতো আমিই প্রথম ইমিগ্রেশন বুথে যাই। পাসপোর্ট স্ক্যান করা হলেও কোনো সিল মারা হলো না। ভাবলাম, হয়তো ওদের নিয়ম আলাদা। পরে অবশ্য সার্বিয়া থেকে বের হওয়ার সময় সেই সিল না থাকার কারণে খানিকটা জেরায় পড়তে হয়েছিল। কারণ, এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন বুঝতেই পারছিল না আমি কবে, কোন পথে এই দেশে ঢুকেছি।

দুপুরের খাবার চিকেন র‍্যাপ
দুপুরের খাবার চিকেন র‍্যাপ

বুথ থেকে বেরিয়ে অফিসারের নির্দেশমতো অপেক্ষার জায়গায় দাঁড়াতেই চোখে পড়ল বড় এক সাইনবোর্ড—এক্সপেরিয়েন্স সার্বিয়া (Experience Serbia)। ভাবলাম, সেলফি দিয়েই অভিজ্ঞতা নেওয়ার শুরু করি। কিন্তু ছবি তুলতেই দূর থেকে এক অফিসারের গর্জন, ‘নো ফটো (No photo)!’ মনে মনে হেসে বললাম, ওয়েলকাম টু সার্বিয়া—নো ফটো, শুধু অভিজ্ঞতা নাও!

বর্ডারের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাস আবার পথে নামল। মনে পড়ল, বাসায় আগেই শুনেছিলাম, সার্বিয়ার মানুষ নাকি অন্যদের তুলনায় একটু রূঢ় স্বভাবের। ঘণ্টা দুয়েক পর বাস নিস শহরে ঢুকল। নামতেই মনে হলো, এ শহরের আলাদা এক গন্ধ আছে। পিঠে ও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালাম শহরের কেন্দ্রে। ওখানে এক ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন অফিসে ঢুকে মানচিত্র নিলাম। ভদ্রমহিলা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন, কোথায় কী আছে।

নিস শহরের এক সামরিক অফিসের বাইরের বিলবোর্ড
নিস শহরের এক সামরিক অফিসের বাইরের বিলবোর্ড

হাতে ম্যাপ নিয়ে হাঁটতে বের হলাম। এটি এক প্রাচীন ও ঐতিহাসিক শহর—রোমান যুগ থেকে শুরু করে বাইজেন্টাইন, অটোমান ও আধুনিক ইউরোপীয় সংস্কৃতির নানা ছাপ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। সম্রাট কনস্টানটাইন দ্য গ্রেটের জন্মস্থান হিসেবেও এর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। শহরের সরু রাস্তায় মানুষের হাঁটাহাঁটি, পাশের ক্যাফে ও দোকানপাট—সব মিলিয়ে শহরটিকে প্রাণবন্ত মনে হলো। এক শপিং মলেও ঢুঁ মারলাম; আধুনিক আলোকসজ্জা আর দোকানের ভিড় যেন অতীতের শহরে বর্তমানের স্পন্দন যোগ করেছে। দুপুরে ক্ষুধা পেলে স্থানীয় এক জনপ্রিয় ক্যাফেতে বড়সড় চিকেন র‍্যাপ খেলাম। ক্লান্ত শরীরেও দাঁড়িয়ে খাওয়া সেই সাধারণ খাবারটাই লাগল অসাধারণ।
এরপর রওনা দিলাম শহরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ—নিস দুর্গে। এর প্রবেশপথে দাঁড়িয়েই মনে হলো, শত শত বছরের ইতিহাস যেন নিঃশব্দে কথা বলছে। নিসাভা নদীর তীরে অবস্থিত এই দুর্গের শিকড় রোমান যুগে, আর বর্তমান স্থাপনার বেশির ভাগই অটোমান আমলের। পাথরের দেয়াল, প্রশস্ত পথ আর ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন নিদর্শন ভ্রমণকারীদের সময়ের গভীরে নিয়ে যায়।

আজ এটি শুধু ইতিহাসের স্মারক নয়; বরং এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। গ্রীষ্মকালে এখানে উৎসব, প্রদর্শনী ও খোলা আকাশের নিচে নাটক হয়। স্থানীয় মানুষেরা যেমন সন্ধ্যার হাঁটার জন্য আসেন, তেমনি পর্যটকেরাও ইতিহাসের ঘ্রাণ নিতে এখানে ভিড় জমান। দুর্গ ভ্রমণ মানে শুধু প্রাচীন দেয়াল দেখা নয়, এটি হলো ইতিহাস, প্রকৃতি ও আধুনিক জীবনের এক অনন্য সংমিশ্রণ।

নিস শহরের কনস্টান্টাইন দ্য গ্রেট এয়ারপোর্টে লেখক
নিস শহরের কনস্টান্টাইন দ্য গ্রেট এয়ারপোর্টে লেখক

ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে ঢুঁ মারলাম একটি স্যুভেনির দোকানে। অনেক খুঁজে পছন্দ করলাম একটি ঐতিহ্যবাহী সার্বিয়ান বাঁশি। দোকানের ভদ্রমহিলা নিজেই শিখিয়ে দিলেন কীভাবে এটি বাজাতে হয়। দোকান থেকে বেরোতেই নেমে এল বৃষ্টি। কোনো উপায় না দেখে বাইরের সিঁড়িতে বসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু বৃষ্টি থামার নাম নেই। কী আর করা, বাঁশিটা বের করে বাজানোর চেষ্টা করলাম। আমার সুরের ‘মূর্ছনায় মূর্ছা যাওয়ার’ আগেই দোকানের ভেতর থেকে কয়েকজন উঁকি দিতে শুরু করল। মনে পড়ল, হ্যাপী আখান্দের সেই গান, ‘কে বাঁশি বাজায় রে...।’ হয়তো তারা দেখতে চাইছিল, কে এমন বেসুরো সুর তুলছে! এমনকি দোকানের সেই ভদ্রমহিলাও উঁকি দিয়ে দেখে গেলেন।

মনে পড়ল, শচীন দেববর্মনের গানের সেই লাইনগুলো, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি…’। না, এরপর আর চেষ্টা চালানো ঠিক হবে না! ভাগ্যিস, এরা গানটি জানে না। জানলে হয়তো দল বেঁধে এসে আক্ষরিক অর্থেই পরের লাইগুলো আমাকে শুনিয়ে দিত—
‘শ্রবণে বিষ ঢালে শুধু বাঁশি, পোড়ায় ও প্রাণ গড়লে।
ঘোচাব তার নষ্টামি আজ আমি, সঁপিব তায় অনলে।’

নিসাভা নদীর তীরে, এই শহরেই জন্ম নেয়া সম্রাট কনস্টান্টাইন দ্য গ্রেটের স্মরণে স্মৃতিচিহ্ন
নিসাভা নদীর তীরে, এই শহরেই জন্ম নেয়া সম্রাট কনস্টান্টাইন দ্য গ্রেটের স্মরণে স্মৃতিচিহ্ন

এদিকে সন্ধ্যা নেমে এল, আমারও এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় হলো। অবশেষে বৃষ্টি কিছুটা কমতেই ছাতা মাথায় ট্যাক্সি খুঁজতে বের হলাম। বহু চেষ্টা শেষে এক ট্যাক্সি পেলাম। ইশারায় জানালার গ্লাস নামাতে বললাম, ‘এয়ারপোর্ট, প্লিজ!’
ড্রাইভার সার্বিয়ান ভাষায় কিছু বলল, কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারলাম না সে বুঝেছে কি না। আবারও চেষ্টা করলাম বিভিন্ন ভাষায় Airport, Flughafen, Havaliman, Flygplats, Aeroporto…কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ট্যুরিস্ট অফিসে শুনেছিলাম, এয়ারপোর্ট এখান থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে। মনে হলো, না হয় হেঁটেই চলে যাই!

এর মধ্যেই ড্রাইভারের মাথায় বুদ্ধি এল। সে ফোন করে কাউকে ডেকে আমাকে কথা বলতে দিল। আমি বললাম, ‘এয়ারপোর্টে যেতে চাই।’ অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন এল, ‘কোন এয়ারপোর্ট!’ মনে মনে বললাম, কী মুশকিল! এখানে আবার কয়টা এয়ারপোর্ট আছে? বললাম, ‘নিস এয়ারপোর্ট।’

এয়ারপোর্ট হলের একমাত্র চা–কফির দোকান (বা গাড়ি!)
এয়ারপোর্ট হলের একমাত্র চা–কফির দোকান (বা গাড়ি!)

শেষে তিনি ড্রাইভারকে ফোনে বুঝিয়ে দিলেন আমি কোথায় যাব। সব শুনে সেই বিশালদেহী ড্রাইভার একগাল হেসে বার দুবার বলল, ‘এরোড্রোম!’ আমি সামনের সিটে বসে মনে মনে ভাবছিলাম, কোথায় যে নিয়ে যায়! যাব এয়ারপোর্ট, সে না আবার সি-পোর্টে নামিয়ে দেয়!

এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখি, বৃষ্টির কারণে ফ্লাইট দেরি হবে। খুবই ছোট এয়ারপোর্ট, দিনে মাত্র কয়েকটি ফ্লাইট ওঠানামা করে। তবে এর নাম বেশ বড়—নিস কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট এয়ারপোর্ট। কী আর করা, ভেতরে বসে ভেজা জামাকাপড় শুকাতে শুকাতে এক কাপ কফি নিয়ে ভাবছিলাম, ভ্রমণ আসলে এ রকমই, কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি।

নিস শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নিসাভা নদী
নিস শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নিসাভা নদী

অবশেষে ঘণ্টা দুয়েক পর আকাশ শান্ত হলো। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘নয়টার গাড়ি কয়টায় ছাড়ে?’ আমারও রাত সাড়ে ৯টার প্লেন ছাড়ল সাড়ে ১২টায়। সারা দিনের ক্লান্তি শরীরে থাকলেও মনে ছিল একটাই অনুভূতি—ভ্রমণ কেবল গন্তব্য নয়; পথের প্রতিটি মুহূর্তই অভিজ্ঞতা।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন