মলদোভা পূর্ব ইউরোপের একটি ছোট, স্থলবেষ্টিত দেশ, যার পশ্চিমে রয়েছে রোমানিয়া আর পূর্বে ইউক্রেন। দেশটির রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর কিশিনউ (Chișinău)। মলদোভা মূলত পাহাড়-টিলা, কৃষিজমি ও আঙুরবাগানে ঘেরা, যা তার বিখ্যাত ওয়াইনশিল্পের জন্য পরিচিত। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল এই দেশ। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ধীরে ধীরে নিজের সাংস্কৃতিক ও জাতীয় পরিচয় গড়ে তুলছে। রোমানীয়, রুশ ও ইউক্রেনীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা মলদোভার স্বকীয়তাও আছে।
মলদোভা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও শেঙ্গেন এলাকার বাইরে থাকায় এখানে যাতায়াতে পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের নিয়মকানুন প্রযোজ্য।
কয়েক দিনের জন্য রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে দুই দিন কাটানোর পর মনে হলো, বুখারেস্ট থেকে মলদোভার কিশিনউ ফ্লাইটে মাত্র এক ঘণ্টা দূরে। ট্রেন, বাস বা গাড়িতে যাওয়া সম্ভব, তবে সেগুলোয় ১০ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। ভাবলাম, এদিকে আবার কবে আসব, তাই এক দিনের জন্য মলদোভায় ছোট্ট একটা ভ্রমণ করা যাক!
রোমানিয়ার ন্যাশনাল ক্যারিয়ার তারম (TAROM) থেকে সকালের ফ্লাইটের টিকিট কেটে ফেললাম। মাত্র ২০ ঘণ্টার মধ্যেই যাত্রা শুরু ও শেষ হবে। শহরের কেন্দ্রে কয়েক ঘণ্টার জন্য একটা হোটেলও বুক করলাম, রাতে কয়েক ঘণ্টা আরামদায়ক ঘুমের জন্য!
পরিকল্পনা ছিল বেশ সোজা। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হোটেলে, তারপর শহর ঘুরে কিছু দর্শনীয় স্থান দেখব, স্থানীয় রেস্টুরেন্টে খেয়ে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ভোরে এয়ারপোর্টে গিয়ে ফিরতি ফ্লাইট ধরব।
কিশিনউ এয়ারপোর্টে নেমে নিয়মকানুনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে সরাসরি হোটেলে গেলাম। আর্লি চেক-ইন করে হাতে একটা ম্যাপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বিশেষ কোনো গন্তব্য ঠিক না করেই একরকম মুক্ত হণ্টন; উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি।
শহরের কেন্দ্রে ঘুরতে ঘুরতে ঢাকার কারওয়ান বাজারের মতো একটা বড় বাজার চোখে পড়ল। ঘণ্টাখানেক সেখানেও ঘুরে বেড়ালাম।
আসলে নতুন কোনো জায়গায় গেলে আমি অন্তত একবারের জন্য হলেও স্থানীয় কোনো বাজারে ঢুঁ মারি। এটা আমার কাছে একধরনের সংস্কৃতি-অন্বেষণ, কারণ এখান থেকেই বোঝা যায় যে ওই জায়গার মানুষ কী খায়, তাদের রুচি ও পছন্দ কেমন, তাদের আর্থিক অবস্থা কেমন এবং বাজারে কোন কোন জিনিস সহজলভ্য। পাশাপাশি স্থানীয় কৃষি, উৎপাদন, আমদানি–নির্ভরতা, এমনকি দৈনন্দিন জীবনের একটা ছবিও পাওয়া যায়।
সারি সারি তাজা সবজি, ফল, তাজা, শুকনা ও স্মোকড মাছ, নানা ধরনের সালাদ, চিজ আর মিষ্টির বাহার দেখে মনে হলো, খাদ্যের এক জীবন্ত জাদুঘরে এসে পড়েছি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।’ আমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়। আমার এই বাজার দেখাতেই আনন্দ!
অনেক সময় মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি নামে, আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি হলো। বাজার থেকে বের হয়ে কিছুক্ষণ হাঁটতেই কাছেই কোথাও গানবাজনার শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে এক জায়গায় পৌঁছে দেখি বিশাল আয়োজন! রাস্তাঘাট বন্ধ করে উৎসব চলছে।
চত্বরের মাঝখানে বিশাল মঞ্চ, একপাশে ছোট ছোট অনেক স্টলে ঐতিহ্যবাহী ও স্থানীয় হস্তশিল্প ও কুটিরশিল্পের পণ্য বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে খাবারের দোকান। অনেকটা আমাদের দেশের নববর্ষের মেলার মতো চেহারা। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এটা এখানকার রোমানিয়ান ঐতিহ্য উদ্যাপনকারী বাৎসরিক উৎসব, যা রোমানিয়া ও মলদোভার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
এদিকে একটু ক্ষুধাও লেগেছে। তাই প্রথমেই খাবারের দোকানগুলোয় গেলাম। চারপাশে নানা ধরনের খাবারের দোকান। একটার পর একটা ঘুরে দেখলাম, তবু মন ভরছিল না। অদ্ভুত এক ‘ফুড ব্লক’ অনুভব করছিলাম। নিজেকে মনে হচ্ছিল গানের মতো—‘লালন মরল জল পিপাসায়, থাকতে নদী মেঘনা, হাতের কাছে ভরা কলস, তৃষ্ণা মেটে না’।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেলাম একটা স্টলের সামনে। এক মধ্যবয়সী মহিলা কড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মোটা একটা রুটি বানাচ্ছেন, যার ভেতরে পুরছেন পনির, স্প্রিং অনিয়ন আর একধরনের সুগন্ধি পাতা। তারপর ধীরে ধীরে সেটি কম তেলে সোনালি করে ভাজছেন। ঘ্রাণটা এমন যে স্মৃতির একটা ছোঁয়া দিল। বেশ বছর আগে দেশে খাওয়া সেই ‘চাপড়ি রুটি’র কথা মনে পড়ে গেল। চোখ বন্ধ করতেই যেন পুরোনো স্বাদ ফিরে এল।
স্টলের মেয়েটাকে বললাম, ‘একটা রুটি দাও।’ সে আগে থেকে ভাজা রুটি কাগজের বাক্সে দিতে চাইল। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘না না, চুলা থেকে যেটা নামবে, একেবারে গরম-গরম ওটাই চাই।’ মেয়েটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এত গরম খেতে পারবে?’
আমি হাসি দিয়ে বললাম, আমি গরম দেশের মানুষ। যখন অন্যরা আইস-টি খায়, তখন আমরা খাই হট-টি। গরমে গরমে কাটাকাটি! সদ্য ভাজা রুটি নিয়ে বসে মনে হলো, হট খাবার খাই বলেই কি জাতি হিসেবে আমরা একটু ‘হট টেম্পার্ড’?
এরপর শহরের আইকনিক গির্জা ঘুরে দেখলাম। পাশের বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটু সময় কাটিয়ে স্থানীয় হস্তশিল্পের দোকানগুলো ঘুরে দেখলাম।
শেষে স্টেজ পারফরম্যান্স দেখলাম—নাচ, গান ও আবৃত্তি। ভাষা না বুঝলেও উপস্থিত জনতার সঙ্গে হাত নাড়া, হাততালি ও কিছু নাচেও মেতে উঠলাম। দেখলাম, নাচ-গান বুঝতে ভাষার দরকার হয় না, সুর ও ছন্দ তো ইউনিভার্সাল।
ভ্রমণ মাত্র ২০ ঘণ্টার হলেও, এই অল্প সময়ে মলদোভা হৃদয়ে একটা ছাপ ফেলল। সত্যিই, পরিমাণ নয়, মানই আসল। ভ্রমণের সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলো অল্প হলেও যদি ভালো হয়, তাতেই প্রকৃত আনন্দ।
ছবি: লেখক