লাল পাহাড়ের দেশে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

২০১২ সালে সম্ভবত প্রথম আমেরিকার ভিসা নেই। আমার মনে আছে আমার সাদা পাসপোর্ট দেখে ভিসা না দিয়ে ফেরত দিচ্ছিলো ঠিক সেই মুহুর্তে আমি পকেট থেকে পুরাতন পাসপোর্টগুলো বের করে এমনভাবে সামনে রাখি যেন ভিসা অফিসারের চোখে পড়ে। সে বলে আমি কি ওগুলো দেখতে পারি, আমি বললাম শিওর। প্রসঙ্গত ইউএস এম্ব্যাসিতে পুরানো পাসপোর্টগুলো খুলে রাখতে হত তখন। এখন কি হয় জানি না কারণ ওই একবার ভিসা হওয়ার পর থেকে ড্রপবক্সে ভিসা হয়। আমরা বি১/বি২ ক্যাটাগরিতে ভিসা পাই ৫ বছরের জন্য। সর্বোচ্চ ৬ মাস থাকা যায়। এর আগে যতবার গেছি ১০–১২ দিন করে থেকেছি। এই প্রথম ৩ সপ্তাহের মত ছিলাম কারণ ঈদের বন্ধ ছিল।

আমি যখন নিউজিল্যান্ডে ছিলাম আমার এক বন্ধু ছিল টিল। সে ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে। আমার মনে আছে ওই সময় আমরা যত স্টুডেন্ট ছিলাম সবাই ওকে বিদায় দিতে এয়ারপোর্ট গেছিলাম। সেসব ছবি আমার ফেসবুকে নিশ্চয়ই আছে। ওর সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ ছিল। ২০১৩ সালে প্রথম আমেরিকায় আসলে টিল আমাকে রিসিভ করে। আমরা একসাথে নিউ ইয়র্ক আর বাফেলো ঘুরি। নায়াগ্রা ফলস দেখি। এরপর আমার ছোটোবেলার বন্ধু বিজয়ের খালা চুমকি আন্টি আসেন দেখা করতে। আন্টির সঙ্গে ওয়াশিংটন ডিসি আর নিউ জার্সি যাই। আন্টির বাসায় দাওয়াত খাই। হাসানের সাথে দেখা হয়। এই পর্যন্ত প্রথম ট্রিপ ছিল। টিলের বিয়ের ঘটক ছিলাম আমি। সেই সূত্রে আমেরিকায় যতবার এসেছি ওর বাসায় আমার থাকা খাওয়া ফ্রি।

এরপর আসি গত বছর লস এঞ্জেলেসে। কাউকে চিনি না। হোটেলে চেক–ইন করার পর আমার স্কুলের ছোটো ভাই আদিত্য যোগাযোগ করে হোটেলে আসে। বাংলা খাবার খেতে নিয়ে যায়। ৪ দিন ছিলাম প্রতিদিন আমাদেরকে ঘুরতে নিয়ে গেছে। অনেক সময় দিয়েছে। লস এঞ্জেলেসে আরো অনেকের সঙ্গে দেখা হয়; কেউ বগুড়ার বা স্কুলের পরিচিত বা অন্য কোনোভাবে চেনা পরিচিত। কেউ কেউ খামারের জন্য চেনে আবার কেউবা ফটোগ্রাফির জন্য।

আমার বন্ধুভাগ্য ভালো বলতে পারেন, আমি পৃথিবীর যে জায়গায় গেছি সবার সাপোর্ট পেয়েছি। শুধু আমেরিকা না ইউরোপের যে যে দেশে গেছি সাপোর্ট পেয়েছি; যেমন পর্তুগালে নিউজিল্যান্ডের বন্ধু ফখরুল, স্পেনে টিলের ভাইবোন, এরপর সুইডেনে শ্বশুড়বাড়ীর আত্মীয়স্বজন আর অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডে তো কথাই নাই। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে কত পরিচিত মানুষ। কানাডায় ব্যাচমেট, ফটোগ্রাফার ফ্রেন্ড, শ্বশুড়বাড়ীর আত্মীয় কেউ না কেউ প্রতিদিন টাইম দিয়েছে।

এবার কোল্ড স্টোরেজে আলু নিয়ে অনেক চাপে ছিলাম। আলু ভরার পর ভাবলাম একটু ছুটি কাটাই কারণ আমাদের ফ্যাক্টরিগুলো ঈদে একটু লম্বা সময় ধরে বন্ধ থাকে আর তেমন কোনো কাজও থাকে না। টিকেট করে চলে আসি বন্ধু টিলের বাসায়। এবার তেমন বেড়ানোর প্ল্যান ছিলো না। ভাবছিলাম নিউইয়র্কে কটা দিন থাকবো, ঘুমাবো। আসার পর আমার স্কুলের খুব কাছের ছোটো ভাই শিহাবুল প্রায় প্রতিদিন আমার ফ্রেন্ডের বাসা থেকে আমাকে নিয়ে যেত ইফতার করাতে আর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেও আসতাম। সঙ্গে ওর কাজিনরাও সময় দিত। চাঁদরাতে দেখা হল ০১-০৩ ব্যাচের বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে। মূলত গ্রুপে পোস্ট দেওয়ার পর অনেকের সঙ্গে দেখা করি হিলসাইডে, যেটা পুরোপুরি বাঙালি এলাকা। চটপটি, ফুচকা থেকে শুরু করে সবকিছুই পাওয়া যায়। আমি তো অবাক শুনে, ফুচকা স্টলের মালিক মার্সিডিজ জি ওয়াগন চালায়।

সাদাত, মিনহাজ, শাওন, তানিয়া, নাজমুলসহ অনেকের সঙ্গে আড্ডা হয়। মিনহাজের কথা আলাদা করে বলতে হয়। আমরা একসঙ্গে স্কুল ও কলেজে পড়েছি; এরপর ও আমেরিকায় চলে আসে। ফেসবুকে যোগাযোগ ছিলো। ও নিউ ইয়র্কের বাইরে থাকে। গতবছর গেলে সময় স্বল্পতার জন্য দেখা করা সম্ভব হয়নি। গতবছর আমাকে সবথেকে বেশি টাইম দিয়েছে শিহাবুল। দিনরাত প্রতিদিনই নিয়ে ঘুরেছে। মিনহাজের সঙ্গে ২২–২৩ বছর দেখা নেই। এবার আসার পর ও নক দিলে আমিও জানাই কোনো প্ল্যান নাই ফ্রি আছি। ও থাকে মেরিল্যান্ডে, প্রায় ২-২.৩০ ঘন্টার ড্রাইভ নিউইয়র্ক থেকে। ও আসার পর ঘুরতে বের হই। স্কুল কলেজের গল্পে মেতে উঠি। প্রথমে ও আমাকে নিয়ে যায় নিউ জার্সির শুটিং ক্লাবে। এরপর টাইমস স্কয়ারে ঘুরে রাতে বাসায় ফেরার সময় ওর বাসায় যাওয়ার কথা বলে। পরের দিন ছিল ঈদ। তাই ঈদের দিন যাওয়ার কথা বলি। জীবনের প্রথম ঈদ না তবুও অনেক দিন পর দেশের বাইরে ঈদ করি। ছাত্রজীবনে নিউজিল্যান্ডে বেশ কয়েকবার ঈদ করেছি।

ঈদের দিন ফ্যামিলি আর বন্ধুর বাসায় টাইম দিয়েছি, বন্ধুকে মামা আর বন্ধুর বউকে মামী ডাকি। মামা–মামী আমাদের চেরী ব্লসম দেখাতে নিয়ে যায়। গোলাপী রংয়ের ফুলগুলো দারুণ সুন্দর দেখতে। এরপরের দিন সকালে যাই মেরিল্যান্ডে মিনহাজের সঙ্গে ওর বাসায়। বন্ধু আমার মারসিডিস এস ক্লাস চালায়। বিশাল বাসায় থাকে। একটা মটর সাইকেলও আছে হার্লি ডেভিডসন। আমার খুব শখ ওর বাইক চালাবো ১২৫১ সিসি বাইক মেইন রোডে না চালিয়ে ফাঁকা জায়গায় চালিয়ে দারুণ এক অনুভূতি হল। এর আগে আমি দেশের বাইরে কোথাও বাইক চালাইনি। মিনহাজকে মনে মনে ধন্যবাদ দিই শখটা পুরণের জন্য। এরপর জীবনে প্রথম লেফট হ্যান্ড গাড়িও চালাই। তারপর যাই চেরি ব্লসম দেখতে ওয়াশিংটন ডিসিতে।

ওয়াশিংটন ডিসিতে আগেও গেছি কিন্তু অন্য মৌসুমে। তখন হোয়াইট হাউজ দেখতে গিয়েছিলাম। সবসময় ফেসবুকে ওয়াশিংটন ডিসির চেরী ব্লসমের ছবি দেখতাম। এবার ভাবলাম নিজের চোখে দেখব। বিশ্বাস করেন ফেসবুকে আর বাস্তবে আকাশ পাতাল তফাৎ। ফেসবুকে দেখি ফুল আর ফুল আর বাস্তবে দেখি মানুষ আর মানুষ; তবে সুন্দর ছিল জায়গাটা।

চেরি ব্লসম দেখে আমরা যাই ভার্জিনিয়াতে বাংলা খাবারের খোঁজে। আলাদিন রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিই। ওর বাসায় এসে স্মৃতিচারণ করতে করতে ভোর ৫টায় প্ল্যান হয় মেক্সিকো যাবো। ঘুম থেকে উঠে প্ল্যান চেঞ্জ; মেক্সিকো বাদ, অ্যারিজোনা যাবো। প্লেনের টিকেট, এয়ার বিএনবি, গাড়ি সব মিনহাজ ঠিক করে ফেলে। ওইদিন আমরা নিউইয়র্ক চলে আসি।

বিজ্ঞাপন

পরদিন নিউইয়র্ক থেকে অ্যারিজোনায় রওনা হই। ফিনিক্স এয়ারপোর্টে যখন নামি রাত তখন প্রায় ১২টা। কোনো মতে গাড়িটা নিয়ে সোজা এয়ার বিএনবিতে যেয়ে ঘুম; কারণ পরদিন ভোরবেলা অ্যারিজোনার উদ্দেশ্যে রওনা।

চারিদিকে পাহাড় আর মাঝখানে রাস্তা কি যে সুন্দর দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। প্রথমে যাই সেডোনা, ঐতিহাসিক জায়গা। লাল পাহাড় দেখে মাথা নস্ট। খুশিতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করি। মনেই ছিল না যে পিঠে স্ক্রু লাগানো। এরপর গেলাম হর্স শু বেন্ড দেখতে, আমার ড্রিম প্লেস। ছবি তুলতে ও ভিডিও করতে কোনো জায়গা বাদ দেইনি। সব জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে প্রচুর হাঁটা হচ্ছিলো।

হর্স শু বেন্ড থেকে আমরা যাই লোয়ার এন্টেলোপে। দারুণ একটা জায়গা। ছবিতে যা দেখায় বাস্তবে তার থেকেও অনেক সুন্দর। মাটির নিচেও এত সুন্দর জায়গা থাকতে পারে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। কলোরাডো রিভার ড্যামও দেখি। প্রচন্ড খিদা লাগছিলো। কোনো ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট নাই, পরে এক থাই রেস্টুরেন্ট খুঁজে খেয়ে এয়ার বিএনবিতে ফিরি। পরদিন সকালে লেক পাওয়েলে একটা বোট ভাড়া করে নিজেরা চালিয়ে ঘুরি। প্রচন্ড ঠান্ডা ছিল। লেকের রং নীল। সঙ্গে লাল পাহাড় অসাধারণ লাগছিল।
লেক পাওয়েল থেকে বের হয়ে সোজা মনুমেন্ট ভ্যালি। মনুমেন্ট ভ্যালীতে ফরেস্ট গাম জায়গাটা ছিল বেশী সুন্দর। রাস্তায় বসে পাশের পাহাড়ের সাথে ছবি তুলে গেলাম ঘোড়ার খোঁজে। ঘোড়া নিয়ে যখন ছবি তুলতে যাব, তখন একটা মজার ব্যাপার হল; ঘোড়াওয়ালা আমাদেরকে জুতা, ওভারকোট, বন্দুক সবই দিল ছবি তোলার জন্য। ব্যাপারটা খুবই ভালো লাগছিলো।

পরদিন সকালে ফিনিক্সে বগুড়ার এক ছোটো ভাই সেজান এসে উপস্থিত আমাদেরকে ঘোরাবে বলে। ওর সঙ্গে বিভিন্ন পার্ক ঘুরে আফগান রেস্টুরেন্টে খেয়ে আমরা যাই ফিনিক্সের সবথেকে উঁচু এক পাহাড়ে যেখান থেকে পুরো সিটি দেখা যায়। পুরা পাহাড়ে ক্যাকটাস গাছ দিয়ে ভরা। তারপর যাই লেক প্লিজ্যান্টে। ওটাও বেশ সুন্দর। ফেরার পথে অনেকগুলো গাধার ফ্যামিলির সঙ্গে দেখা হল। পরদিন সকালে গেলাম বোটানিক্যাল গার্ডেনে; এটা ক্যাকটাসের জন্য বিখ্যাত।

সব ঘুরে রাতে আমার স্কুলের বন্ধু রায়হানের বাসায় রাতে দাওয়াত। যেয়ে দেখি বগুড়ার বিখ্যাত আলুঘাটি। খেলাম আবার সঙ্গে করে নিয়েও আসলাম। এবার নিউইয়র্ক ফেরার পালা। এয়ারপোর্ট সিকিউরিটিতে ধরলো আলুঘাটি, আবার ছেড়েও দিলো। পুরোটা সময় আমাদের জার্নি ছিল প্রায় ২৫০০ কিমি। আশেপাশের দৃশ্য ছিল অসাধারণ। কোথাও বরফ পড়ে আছে কোথাও অনেক গরম। ৬ ঘন্টা পর নিউইয়র্ক ফিরি। মিনহাজ আমাদেরকে ড্রপ করে চলে যায়। অ্যারিজোনা ট্রিপ আমার সারাজীবন মনে থাকবে।

আমি বগুড়ায় থাকতে রিয়াজ ভাইয়ের পরিচিত শিবলু ভাই এসেছিলেন বগুড়ায় আমার খামার দেখতে। উনি আমেরিকায় থাকেন। ফেসবুকে আমার পোস্ট দেখে উনি কানেকটিকাট থেকে সোজা নিউইয়র্ক চলে আসেন সঙ্গে নানা উপহার নিয়ে। ওঁদের সঙ্গে সারাদিন ঘুরি। ব্রুকলিনে যাই, খাওয়াদাওয়া করি। সেদিই ওঁরা চলে যান।
এরপর একদিন গোপালগঞ্জের রবি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। পর পর ২ দিন আড্ডা হয়। রোহান ভাইয়ের সঙ্গে ডামবো ঘোরা হয়। আস্তে আস্তে সময় হয়ে আসে ফেরার।
শিহাবুল পরের দিন সকালে নিয়ে যায় মনটাক লাইট হাউজে। খুব সুন্দর জায়গা; নিউইয়র্ক থেকে আড়াই ঘন্টার মত লাগে। ঠান্ডা বাতাসে জমে যাওয়ার অবস্থা। প্রচন্ড বাতাস ছিল। আমরা লাইট হাউজে উঠি। সারাদিন ঘুরে রাতে বাসায় আসি।

পরের দিন ছিল পহেলা বৈশাখ। নাজমুল–তানিয়ার বাসায় দাওয়াত। শাওন নিউ জার্সি থেকে এসে আমাদের নিয়ে যায় কানেকটিকাট। অনেক সুন্দর একটা স্টেট। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। রাস্তায় হরিণও দেখা যায়। দুপুরে খেয়ে আড্ডা দিচ্ছি এর মধ্যে শিবলু ভাই হাজির। ওনার বাসায়ও যেতে হবে। আমরা ওনার শপ ঘুরে বাসায় যেয়ে দেখি বিশাল আয়োজন। ওখানে খাওয়া–দাওয়া করে আবার নাজমুল–তানিয়ার বাসায় এসে পান্তা–ইলিশ খাই। সারাটা দিন খাওয়ার উপরেই ছিলাম। রাতে বন্ধু মাসুদ কানেকটিকাট থেকে নিউইয়র্কে ড্রপ করে। দেশের বাইরে সুন্দর একটা পহেলা বৈশাখ কাটে। রাতে টিল আর ওর স্ত্রী কেক নিয়ে হাজির আনিকার বার্থডে উপলক্ষে। একটু পর ফারহানা আন্টিও হাজির কেক নিয়ে। সারা রাত আড্ডা দিয়ে এবার ফেরার পালা।
অ্যারিজোনার টিকেট করার সময় মিনহাজ আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশেরও টিকেট কাটে। পরের দিন বিকেলে মিনহাজ আমাদেরকে নিয়ে সোজা নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টে। গন্তব্য বাংলাদেশ। পরের বার ইউটাহতে ৭ দিনের প্লান করে আপাতত এবারের জার্নি এখানেই শেষ।

বিজ্ঞাপন
প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৫, ০৬: ৫৬
বিজ্ঞাপন