ঘুম থেকে জেগে ওঠার কয়েকটি ধাপ আছে। প্রথম ধাপ গভীর তন্দ্রা। সেই ধাপ পার হওয়ার পর আসে তন্দ্রাচ্ছন্নতা; আধো ঘুম আর আধো জাগরণের মাঝামাঝি একটা অবস্থা। এ সময় মানুষ অবচেতন অবস্থায় থাকে। এরপর ঘুম ভাঙে আর চেতনা ফিরে আসে। মানুষ স্বপ্ন দেখে অবচেতন অবস্থায়। এ সময় খুব সাধারণ শব্দগুলোও জোরালো হয়ে মানুষের কানে ধরা দেয়। এই যেমন ঘুম ভাঙার পর বুঝতে পারছিলাম না, টিক–টক শব্দটা আসছে কোত্থেকে? দেয়ালে কোনো ঘড়ি ঝোলানো নেই। তারপর খেয়াল হলো যে ঘুমের সময় হাতঘড়িটা বালিশের পাশেই রেখেছিলাম। ঘূর্ণায়মান সেকেন্ডের কাঁটার শব্দই কানে বাজছে।
আড়মোড়া ভেঙে কম্বলের নিচে শুয়ে থাকতে খারাপ লাগছে না। ঘণ্টা আর মিনিটের কাঁটা নির্দেশ করছে, সকাল সাড়ে দশটা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি? তারপরই মনে পড়ল, ঘড়ির সময় বদলানো হয়নি। এখনো বাংলাদেশ সময় নির্দেশ করছে। তার মানে ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজে। জেট ল্যাগের পাল্লায় পড়েছি নিশ্চিত।
হোটেলে পৌঁছেছিলাম সন্ধ্যা সাতটায়। আটটায় সূর্যাস্ত হওয়ার কারণে সন্ধ্যাবেলায়ও দিনের আলো থাকে। অভ্যর্থনাকক্ষের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রুমে পৌঁছে দেখি, শরীর আর চলছে না। থাকার জায়গা দেখে আমি মুগ্ধ। এক রুমের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। এরা বলে, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। মোটামুটি ৩০ বর্গফুট জায়গার মধ্যে সবই আছে। বিছানা, চেয়ার, টেবিল, ক্লজেট, বৈদ্যুতিক চুলা, ওভেন, ফ্রিজ, রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ইস্ত্রি, হেয়ার ড্রায়ার কিছুই বাদ নেই।
ঢাউস লাগেজটা খুলে জিনিসপত্র বের করে গোছাতেই অনেক সময় চলে গেল। তারপর রান্নার বন্দোবস্ত করতে গিয়ে দেখি, চুলা জ্বালাতে পারছি না। এমন চুলা আগে কখনো ব্যবহার করিনি। গ্যাসের লাইন নেই, বৈদ্যুতিক তারের বালাই নেই, এমনকি কোনো প্লাগও নেই। কাউকে জিগ্যেস করব, সে উপায়ও নেই। ইন্টারকমে ফোন করে জানতে পারি, কিন্তু ইজ্জতের ফালুদা হবে ভেবে সেটাও করতে পারছি না। আবার চুলা জ্বালাতে না পারলে রান্নাও হবে না, পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমও আসবে না। শেষমেশ লজ্জার মাথা খেয়ে দিলাম রিসিপশনে ফোন। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ভদ্রলোক এসে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন, কীভাবে চুলা জ্বালাতে হবে।
বিছানা থেকে নেমেই দেখি, লাল চুলের এক অষ্টাদশী তরুণী আমার দিকে পাশ ফিরে চুল আঁচড়াচ্ছে। কী আশ্চর্য, দেয়ালে ঝোলানো এই সুন্দরীকে রাতে চোখে পড়ল না কেন? বিখ্যাত ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক শিল্পীরই দুটি মাতৃভূমি। একটি, যেখানে সে জন্মেছে; অন্যটি ফ্রান্সে।’ প্যারিসের সৌন্দর্যের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের সংরক্ষণ এবং মূল্যায়নের জন্যও ফ্রান্স ভ্রমণের ইচ্ছা ছিল অনেক আগে থেকেই। বোদলেয়ার মিথ্যে বলেননি। তাই প্যারিসের হোটেলকক্ষে তৈলচিত্র না থাকলে সেটাকে অস্বাভাবিক ধরে নিতাম। যে বিষয়টা দ্বিধায় ফেলেছিল সেটা হচ্ছে, ছবিটা আমার পরিচিত, কিন্তু মনে করতে পারছি না, কোথায় দেখেছি। আঁকিয়ের স্বাক্ষরও দেখতে পাচ্ছি না। বিষয়টা পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত মনের মধ্যে খুঁতখুঁত করতেই থাকবে।
জানালা খুলেই পরবর্তী ধাক্কাটা খেলাম। ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের হাড়কাঁপানো শীতল হাওয়া যে বিনা আমন্ত্রণে ঘরের দখল নিল, ধাক্কা সেটা নয়। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আইফেল টাওয়ারের চূড়া। কত স্বপ্ন ছিল, আইফেল টাওয়ার থেকে প্যারিস শহরটাকে দেখব, সেই স্বপ্ন পূরণের এত কাছে চলে এসেছি, বুঝতেই পারিনি। যে হোটেলে উঠেছি, সেটার নাম ‘সিটাডিন ট্যুর আইফেল প্যারিস’। আইফেল টাওয়ারের এত কাছে বলেই হয়তো এমন নামকরণ। মাথায় ভূত চাপল, এখনই বের হব। ভোরের সূর্যকিরণে আইফেল টাওয়ার কেমন চমকায়, সেটা না দেখা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না।
শীত যে ভালোই পড়েছে, সেটা বুঝলাম বাইরে বের হয়ে। এমন ঠান্ডায় কম্বলের ওম ছেড়ে বের হওয়ার দুঃসাহস কয়জন ভেতো বাঙালি করতে পারবে ভেবে নিজেকে নিজেরই সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। মাথা থেকে ঠান্ডার চিন্তা বের করে চারপাশের সৌন্দর্য অবলোকনে মন দিলাম। আমাদের হোটেলটা যে রাস্তায়, সেটার নাম বুলেভার্দ দি গ্রেনেল। প্যারিসের রাস্তাগুলোকে স্ট্রিট, অ্যাভিনিউ বা বুলেভার্দ বলা হয়। কোনো রাস্তা যদি উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর যায়, তাহলে সেটাকে বলে স্ট্রিট, আর পূর্ব-পশ্চিমে হলে বলে অ্যাভিনিউ।
বুলেভার্দ বলতে বোঝায় এমন স্ট্রিট যেটির দুপাশে গাছের সারি এবং মাঝবরাবর সড়ক বিভাজক আছে। সোজা বাংলায় স্ট্রিট হচ্ছে ছোট রাস্তা আর বুলভার্দ বড় রাস্তা। অ্যাভিনিউ হচ্ছে সরণি। এই রাস্তা বুলেভার্দের মতো চওড়া না হলেও দুপাশে সারি দিয়ে গাছ থাকবে। স্বাস্থ্যসচেতন পথিকদের পদভারে অ্যাভিনিউগুলো সাধারণত প্রকম্পিত থাকে। বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, বই কিংবা ফুলের দোকান এমনকি বিউটি পারলারও থাকে বুলেভার্দের আশপাশে। আমি যে বুলেভার্দ ধরে হাঁটছি, সেটিও এর ব্যতিক্রম নয়।
ক্যাফে, রেস্তোরাঁ আর পানশালার ছড়াছড়ি চারপাশে। এগুলো প্যারিসের প্রাণ। চেয়ারের সংখ্যা ভেতরের চেয়ে বাইরে বেশি। এমনিতে লোকজনে গমগম করলেও সাতসকাল বলেই হয়তো কাকপক্ষীও চোখে পড়ছে না। পাশেই একটা অ্যাভিনিউতে দেখা মিলল ডিজিটাল সাইকেল স্ট্যান্ডের। শহরের বিভিন্ন জায়গায় এমন সাইকেল স্ট্যান্ড বিদ্যমান। টিয়া রঙের অনেকগুলো সাইকেল রাখা আছে যা কিনা মোবাইল অ্যাপ দিয়ে খুলতে হয়। নির্দিষ্ট অ্যাপ ইনস্টল করে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখতে হয় প্রথমে। তারপর সেই অ্যাপ দিয়ে লক খুলে ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি শেষে অন্য কোনো স্ট্যান্ডে সাইকেল রেখে দিলেই হলো। এ রকম ব্যবস্থা যদি কোনো সংস্থা ঢাকায় করে, তাহলে আর দেখতে হবে না। এক রাতের মধ্যেই অর্ধেকের বেশি সাইকেল চুরি হয়ে যাবে। এসব প্রযুক্তি মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা আমাদের এখনো হয়ে ওঠেনি।
প্রতিটা অ্যাভিনিউতেই সাইকেলের জন্য আলাদা লেন করা আছে। এত দিন কেবল শুনেই এসেছি, বাস্তবেও দেখা মিলল বিদ্যুচ্চালিত পরিবেশবান্ধব গাড়ির। বাড়ির সামনেই চার্জে দেওয়া আছে। রাতে চার্জ দিলে সারা দিন চলে। সবকিছুই বাইরে রাখা, চুরি হওয়ার ভয় নেই। তাই ফ্ল্যাটবাড়ির নিচতলায় গ্যারেজ বানিয়ে জায়গা নষ্ট করে না কেউ এখানে। সামনের দিনগুলোয় আরব শেখদের কপালে খারাবি আছে। বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি যদি ব্যাপক হারে দুনিয়াব্যাপী চালু হয়েই যায় (আইসল্যান্ডে ইতিমধ্যে চালু হয়েছে), তাহলে পেট্রলচালিত গাড়ির চাহিদা যাবে কমে। পেট্রো–ডলারের ওপর নির্ভরশীল মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি কি পারবে এই ধাক্কা সামলাতে? সৌদি আরব হজ্বের বদৌলতে কিছুটা বেঁচে গেলেও বাকি দেশগুলো পার পাবে কী করে?
মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরই চোখের সামনে উদয় হলো প্যারিসের বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক আইফেল টাওয়ার। আহা আইফেল টাওয়ার! ছোটবেলায় দেখেছি পোস্টকার্ডে, বড় হয়ে দেখেছি টেলিভিশনের পর্দায়, আর এখন দেখলাম সামনাসামনি। যদিও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার মতো এতটা আবেগাপ্লুত হতে পারেননি। আইফেল টাওয়ারের উদ্বোধন হয় ১৮৮৯ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে পা রেখেছিলেন তার পরের বছর। তাঁর বর্ণনাতেই শোনা যাক:
‘প্যারিসের কী বর্ণনা করব। প্রকাণ্ড কাণ্ড। রাস্তা, গাড়ি, বাড়ি, ঘোড়া, দোকান, বাগান, প্রাসাদ, প্রস্তরমূর্তি ফোয়ারা ইত্যাদি। অনেক ঘুরে ঘুরে এক বইয়ের দোকানে গেলুম। সেখান থেকে গোটা কয় বই কিনে এক খাবারের জায়গায় যাওয়া গেল। সুসজ্জিত চিত্রিত স্বর্ণপত্রমণ্ডিত স্ফটিকখচিত প্রকাণ্ড ঘরের একটি প্রান্ত টেবিলে আহারাদি করে এক গাড়ি নিয়ে ইফেল টাউয়ার দেখতে বেরোলাম। এক মস্ত দৈত্য তার সহস্র লৌহকঙ্কাল নিয়ে আকাশে মাথা তুলে চার পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। লিফটে করে প্রথমে আমাদের একতলায় চড়িয়ে দিলে—চতুর্দিকে প্যারিস উদ্ঘাটিত হয়ে গেল। ক্রমে আমরা চতুর্থ তলায় উঠলাম। সমস্ত বিরাট প্যারিসের ওপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলুম—আশ্চর্য ব্যাপার! টাউয়ারে চড়ে বাবি, সলি আর ছোট বউকে তিনটে পোস্টকার্ড পাঠিয়ে দিলুম।’
রবিঠাকুরের বর্ণনার লৌহকঙ্কাল আদতে ১ হাজার ৬৩ ফুট উঁচু এক লৌহস্তম্ভ ছাড়া কিছুই নয়। তারপরও কেন প্রতিবছর সত্তর লাখের অধিক আদমসন্তান পয়সা দিয়ে এখানে চড়তে আসে? কারণ, ব্র্যান্ডিং। ফ্রান্স এমনভাবেই আইফেল টাওয়ারকে ব্র্যান্ডিং করেছে যে আমার–আপনার মতো সাধারণ মানুষের মগজে গেঁথে যাবে, আইফেল টাওয়ারে চড়ে প্যারিসের শোভা উপভোগ না করলে প্যারিস ভ্রমণ বৃথা। এই যে সাতসকালে কম্বলের ওম ছেড়ে এই লৌহশলাকা দেখতে বের হয়েছি, সেটিই তো বড় প্রমাণ। এমনিতে প্যারিসের যেকোনো প্রান্ত থেকেই আইফেল টাওয়ার দর্শন সম্ভব, তবে টাওয়ারে চড়তে হলে আপনাকে ২৫ ইউরো খরচ করতে হবে। শুধু তা–ই নয়, আগে থেকে টিকিট করতে হয় এবং বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে পায়ের ওপর অত্যাচার চালানোর পর সেখানে ওঠা যায়। কে যায় বাপু এত ঝামেলা মাথায় নিতে? আমি বাইরে থেকে দেখেই খুশি, ওপরে উঠার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।
আইফেল টাওয়ার যখন তৈরি হয়, তখন সেটি ছিল পৃথিবীর উচ্চতম মানবসৃষ্ট স্থাপনা। টানা ৪১ বছর এই খেতাব অক্ষুণ্ন ছিল। বর্তমানে পৃথিবীর উচ্চতম ১০০ স্থাপনার ভেতরে আইফেল টাওয়ারের নাম নেই। উঁচু টাওয়ার বানানো বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মর্যাদার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই নিয়ে বিস্তর প্রতিযোগিতাও চলছে। বর্তমানের সর্বোচ্চ ভবন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা (২ হাজার ৭১৭ ফুট) কত দিন শীর্ষ স্থান ধরে রাখতে পারে, সেটা দেখার বিষয়।
আইফেল টাওয়ারের পাশেই একটা বাগান আছে, সেই বাগানে দেখার মতো আরও দুটো বস্তু আছে। একটা হচ্ছে ‘শান্তির দেয়াল’ নামক স্মৃতিস্তম্ভ। জেরুজালেমের ‘কান্নার দেয়াল’–এর ধারণা থেকে উৎসাহিত হয়ে এই শান্তির দেয়াল তৈরি করেছেন শিল্পী ক্লারা হ্যাল্টার এবং স্থপতি জিন মাইকেল উইলমোট। সারা পৃথিবীতে যেন শান্তি নামে, সেই কামনায় এটি তৈরি হয়েছিল। ১৬ দশমিক ৪ মিটার দৈর্ঘ্য, ১৩ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থ এবং ৯ মিটার উচ্চতার এই স্মৃতিস্তম্ভে কাঠ ও কাচের চমৎকার ব্যবহার হয়েছে। পাশাপাশি ৩২টি স্টিলের দণ্ডও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চারপাশে। কাচ ও লোহার দণ্ডে ৪৯টি ভাষায় শান্তির বাণী লেখা আছে। ২০০০ সালে এটির উদ্বোধন করেছিলেন ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক। এর পর থেকেই বিভিন্ন শান্তিকামী সংগঠন প্রতিবছর হিরোশিমা দিবসে অল্প সময়ের জন্য এখানে ব্যানার নিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করে আসছে যেন পৃথিবী থেকে পরমাণু বোমা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঢাকা প্রেসক্লাবের সামনের অবস্থান ধর্মঘটগুলোকে যেমন বাংলাদেশ সরকার পাত্তা দেয় না, এখানকার ধর্মঘটকেও ফ্রান্স সরকারের পাত্তা দিতে বয়েই গেছে। ফ্রান্স নিজেই পরমাণু বোমার অধিকারী দেশ বলে কথা।
নির্মাণের সময় এই স্মৃতিস্তম্ভে দর্শনার্থীরা শান্তির বাণী লিখতে পারতেন। দেয়ালে ইন্টারনেট সংযোগ থাকায় সেগুলো পৃথিবীর আনাচকানাচে পাঠানোও যেত। এখন সেই সুযোগ বন্ধ। এমনকি স্মৃতিস্তম্ভের চারপাশে লোহার বেষ্টনী দিয়ে সাধারণ লোকজনকে স্মৃতিস্তম্ভের ভেতরে যাওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এই স্মৃতিস্তম্ভের মাধ্যমে দুনিয়ায় কতটুকু শান্তি এসেছে, সেটা তর্কের বিষয় হলেও শিল্পী ও স্থপতির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের যে সমৃদ্ধি এসেছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কারণ, প্যারিসের এই শান্তির দেয়ালের ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ এবং জাপানের হিরোশিমায়ও শান্তির দেয়াল তৈরি করা হয়েছে যেগুলোর ডিজাইন এই দুজনই করেছেন।
দ্বিতীয় যে বস্তুর কথা বলব, সেটাও একটা স্মৃতিস্তম্ভ, মানবাধিকারের স্মৃতিস্তম্ভ। ফরাসি বিপ্লবের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছিলেন চেক প্রজাতন্ত্রের ভাস্কর ইভান থেইমার। পাথর ও ব্রোঞ্জের তৈরি এই ভাস্কর্যে দুটো সূচালো স্মারকস্তম্ভ আছে যেখানে মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র উৎকীর্ণ আছে। জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকারের যে ঘোষণাপত্র তৈরি করেছে, সেটার ভিত্তিমূলে ফরাসি মানবাধিকারের ঘোষণার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভূমি থেকে দুই ফুট উঁচু পাথরের পাটাতনে স্মারকস্তম্ভ ছাড়া আছে দুটি পুরুষ এবং একটি নারীভাস্কর্য, আছে মিসরের মাস্তাবা সমাধির সাদৃশ্যপূর্ণ অষ্টভুজাকৃতি স্থাপনা এবং ব্রোঞ্জের দুটো আগুনপাত্র। লোকজন এই স্মৃতিস্তম্ভের দিকে খুব একটা ফিরে তাকায় না বলেই মনে হলো।
সাধারণ দর্শনার্থীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। চোখের সামনে বিখ্যাত আইফেল টাওয়ার থাকলে কে আর আশপাশে ফিরে তাকাতে চাইবে! অনেকটা বাংলা সিনেমার নায়িকার সখীদের মতো। সখীরা নায়িকার চারপাশে ছায়ার মতো ঘিরে থাকবে, নায়িকার প্রেমের সফলতার জন্য এমন কোনো ত্যাগ নেই যা কিনা তারা স্বীকার করতে পিছপা হবে, কিন্তু দিন শেষে আপনি নায়িকাকেই মনে রাখবেন, সখীদের নয়।
আইফেল টাওয়ারকে পেছনে রেখে পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত, কুখ্যাত ও অখ্যাত ব্যক্তি ছবি তুলেছেন। এর সামনে ব্রিটেনের রাজপুত্র প্রিন্স উইলিয়ামের যেমন সস্ত্রীক ছবি আছে, তেমনই আছে জার্মানির একনায়ক হিটলারের ছবিও। আমার নিজেরও তো এখানে ছবি তোলার ইচ্ছা, কিন্তু এই সাতসকালে তুলবেটা কে? স্রষ্টা সদয় হলেন, পাঠিয়ে দিলেন এক মেক্সিকান দেবদূত। ভদ্রলোক আমার মতোই হাতে মুঠোফোন নিয়ে ঘুরছেন, কিন্তু ছবি তুলে দেবে এমন কাউকে পাচ্ছেন না। দুজন দুজনের ছবি তুলে হাসিমুখে নিজেদের পথ ধরলাম। যাক, অখ্যাতদের কাতারে নিজের নামটাও তোলা হলো।
ছবি: লেখক