ইউরোপের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান জাদুঘর ‘সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’তে যেতে চাইলে ৭ নম্বর মেট্রোতে চেপে নামতে হবে পোর্ট ডি লা ভিলে স্টেশনে। স্টেশন থেকে ওপরে উঠলেই জাদুঘরের দেখা মিলবে। বিশালাকৃতির তিনটি কাচের কিউবিকলের ভেতরেই সবকিছু। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের দুই তলা মাটির নিচে। সেগুলোতে এবং ওপরের দুই তলায় যেতে টিকিট কাটতে হয়। কাউন্টারে গিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক সমস্যার জন্য আপাতত টিকিট প্রদান বন্ধ, কিছুক্ষণ পর চালু হবে। অপেক্ষার সময় নেই, তাই শুধু নিচতলাটাই ঘুরে যাই। অনেক স্কুলের ছেলেমেয়েকে দেখলাম মা–বাবা কিংবা শিক্ষকদের সঙ্গে ঘুরতে এসেছে। এখানে স্কুলের বাচ্চাদের নিয়মিত বিভিন্ন জাদুঘরে কিংবা সংগ্রহশালায় নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি তাঁদের আগ্রহ তৈরি হয়। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কেবল প্যারিসেই তিন ডজন বিজ্ঞান জাদুঘর আছে। পাশের দেশ ভারতের কলকাতায়ও কত চমৎকার বিজ্ঞান জাদুঘর আছে। ঢাকায় এক নভোথিয়েটার ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। আমাদের ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হবে কীভাবে?
নিচতলায় মূলত বাচ্চাদের সেকশন। ছোট্ট একটা রোবটের চারপাশে দেখি বাচ্চাদের ভিড়। থাকবেই না কেন, এই রোবটের কোনো এক জায়গায় সেন্সর লাগানো আছে। তাই কেউ সেটার সামনে গেলেই বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে। আবার জায়গা পরিবর্তন করলে সেটাও চোখ ঘুরিয়ে তাকায়। বুকে একটা মনিটর বসানো, সেখানে কিছু লিখলে উত্তরও দেয়। এই জাদুঘরের উদ্বোধনের সঙ্গে এক বিশেষ ঘটনার যোগসূত্র আছে। হ্যালির ধূমকেতুর নাম আমরা অনেকেই শুনেছি। ৭৬ বছর পরপর এই মেহমান পৃথিবীকে সাক্ষাৎ দিতে আসে এবং বেশ কিছুদিন পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থান করে নিজের জায়গায় ফেরত যায়!
১৯৮৬ সালে হ্যালির ধূমকেতু যখন পৃথিবীর কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিল তখন ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি জিয়োটো নামের মহাকাশযানকে মহাশূন্যে পাঠায় হ্যালির ধূমকেতুকে খুব কাছাকাছি অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। যে দিনটিতে জিয়োটো হ্যালির ধূমকেতুর সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছায় সে দিনটি ছিল ১৩ মার্চ। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই প্যারিসের বিজ্ঞান জাদুঘর সেদিনই উদ্বোধন হয়।
বাচ্চাদের সেকশনে ঘোরার মজা আছে। যেহেতু বাচ্চারা কল্পনাবিলাসী, তাই তাদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধির জন্য অদ্ভুত সব ছবি, খেলনা আর ভাস্কর্য সাজানো আছে চারদিকে। এমনই এক ভাস্কর্য ছিল সাত পায়ের দৈত্য। দৈত্যের মাথা সব সময় ঘুরছে, দেখে অবশ্য ভিনগ্রহের প্রাণী বলে ভ্রম হয়। আছে স্যুভেনিরের দোকান। সেক্রেকার চার্চের মতো একটা টাকার মেশিনও আছে। দুই ইউরো খরচ করে একটা কচকচে সুদৃশ্য নোট সংগ্রহ করলাম, যেটা দিয়ে কিছু কিনতে পারব না; কিন্তু ভবিষ্যতে নাতিপুতিদের দেখিয়ে গল্প করতে পারব।
ল্যুভের জাদুঘরকে আদতে একটি জাদুঘর কমপ্লেক্স বলা চলে। কয়েকটা ভবন নিয়ে এই জাদুঘর। একেক ভবনে একেক ধরনের প্রদর্শনী চলে। কেউ যদি পুরো জাদুঘর ঘুরে দেখতে চান তাহলে কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় দিতে হবে। মূল জাদুঘরের অবস্থান মাটির নিচে। সুন্দর একটা কাচের পিরামিডের ভেতরে প্রবেশপথের অবস্থান।
পাশে আরও দুটো ছোট পিরামিড আছে। চৈনিক স্থপতি ইয়েও মিং পেই এর ডিজাইন করেছেন। এমনিতে খুব একটা আহামরি না লাগলেও রাতের বেলা যখন আলো জ্বেলে দেয় তখন দেখতে দারুণ লাগে। সংগ্রহ সংখ্যার হিসাবে এটি বর্তমানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জাদুঘর। প্রতিবছর এক কোটির বেশি মানুষ এটি পরিদর্শনে আসেন, যার মধ্যে বেশির ভাগই আসেন মোনালিসাকে দেখতে। তাই বলা যায়, এর খ্যাতি মূলত মাদাম মোনালিসার জন্যই।
লম্বা লাইন পেরিয়ে যখন জাদুঘরে প্রবেশ করলাম তখন হাতঘড়িতে সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট। ইনফরমেশন ডেস্ক থেকে একটি মানচিত্র নিয়ে নিলাম। এগুলো খুব কাজে লাগে কোনো জায়গায় ঘুরতে গেলে। মনটা খারাপ হয়ে গেল ডেস্কের পেছন দিকের কাঠের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় ‘স্বাগত’ শব্দটা লেখা আছে, কিন্তু সেখানে পঞ্চম বৃহত্তম ভাষা বাংলার চিহ্ন নেই। মাত্র দেড় ঘণ্টা সময় আছে হাতে। প্রথমেই যে কথাটা মনে এল, অন্য কাউকে দেখার আগে মাদাম মোনালিসাকে দেখে আসি।
বিভিন্ন গলি–ঘুপচি পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত কক্ষে পৌঁছে দেখি কারওয়ান বাজারের মাছবাজারের মতো আসর বসেছে। পুরো জাদুঘরের অন্য কোনো কক্ষে এত জনসমাগম নেই। সবই মাদাম মোনালিসার কৃপা। উনি একাই কক্ষটি দখল করে আছেন। যে দেয়ালে ছবিটি টানানো, সেটির চারপাশে ফিতা দিয়ে একটা সীমানা বেঁধে দেওয়া আছে, ছবির কাছাকাছি যাওয়া যাবে না। এমনিতে পুরো জাদুঘরে অন্য কোনো ছবিতেই এমন সীমানাপ্রাচীর নেই। শুধু তা–ই নয়, ছবির বাইরে আলাদা করে বুলেটপ্রুফ কাচের আবরণও দেওয়া আছে, যা কি না অন্য কোনো ছবিতে নেই। ১৯১১ সালে ছবিটি একবার চুরি হয়েছিল। বছর তিনেক পর অবশ্য এর সন্ধান মেলে। সেই থেকে এই ছবি নিয়ে এত সতর্কতা!
যেই করিডর দিয়ে হেঁটে মোনালিসার কক্ষে প্রবেশ করেছিলাম সেটার দেয়ালেই অনেকগুলো ছবি সাঁটানো আছে। আমি শিল্পবোদ্ধা নই, ছবির খুঁটিনাটি খুব একটা বুঝিও না, তারপরও মুগ্ধতার একটা আবেশ ছড়িয়েছিল মনের ভেতর ছবিগুলো দেখে।
বেশির ভাগই ইউরোপীয় রেনেসাঁর যুগের। সময়ের অভাবে খুব বেশিক্ষণ যে ছবিগুলোর মাহাত্ম্য বোঝার জন্য ব্যয় করতে পেরেছিলাম, তা নয়। কয়েকটা ছবি বেশ মনে ধরেছিল। এই যেমন ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী কার্লো ব্রাকেস্কোর আঁকা ‘ট্রিপটিক’ (পাশাপাশি তিনটি ছবির একটি সিরিজ), আন্দ্রে মাতেগনার বিখ্যাত ছবি ‘ম্যাডোনা ডেলা ভিটোরিয়া’ কিংবা কজমে তুরার পাঁচ বছর ধরে যিশুখ্রিষ্টের মৃতদেহ উপজীব্য করে আঁকা ছবি ‘পিয়েতা’। ফরাসি চিত্রশিল্পী লুই ম্যাতোর আঁকা ‘দেবতাদের সমাবেশ’ ছবিটিও নজর এড়ায়নি। বিশালাকৃতির ক্যানভাসে আঁকা ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে স্বর্গের সব দেবদেবী একত্র হয়ে পার্টি করছেন।
অবাক হতে হয় গ্রিক ভাস্কর্যগুলো দেখলে। বিশালাকৃতির মার্বেল পাথর কেটে এত মসৃণ ও নিখুঁতভাবে শরীরের প্রতিটি ভাঁজ ফুটিয়ে তোলা কীভাবে সম্ভব! এই যেমন গ্রিক বীর হারকিউলিসের কথা পড়েছি। তার ভাস্কর্য দেখার সুযোগ হলো প্রথমবারের মতো। এক হাতে গদা, আরেক হাতে শিশুপুত্র টেলিফস, সঙ্গে পোষা কুকুর, নিষ্পলক তাকিয়ে আছে দিগন্তপানে। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর এই ভাস্কর্য নির্মাণে শিল্পীর কত দিন সময় লেগেছে কে জানে।
ল্যুভে বিখ্যাত ভাস্কর্যের অভাব নেই। তবে সবচেয়ে বেশি যেটি দেখার জন্য লোকজন ভিড় করেন সেটি নিঃসন্দেহে ভেনাস ডি মিলোর ভাস্কর্য। ভেনাস নামটা রোমানদের দেওয়া, গ্রিকরা বলে আফ্রোদিতি। প্রেমের দেবীর ভাস্কর্যের হাত দুটো বাহু থেকে গায়েব। এ অবস্থায়ই এটিকে উদ্ধার করা হয়েছিল গ্রিসের মিলোস দ্বীপ থেকে ১৮২০ সালে। আরেকটা ভাস্কর্যের কথা না বললেই নয়। সামথ্রেসের বিজয় নিশান। আট ফুট উঁচু একটা মার্বেল পাথরের নারী মূর্তি। মূর্তিটির দুই হাত এবং মাথা নেই, তবে কাঁধের কাছ থেকে চমৎকার দুটো ডানা বের হয়েছে।
আকাশ থেকে যিনি নেমে এসেছেন একটা জাহাজের সামনের দিকের বো বা গলুইয়ের ওপর। গ্রিক মিথলজি অনুযায়ী, এই ভদ্রমহিলা যুদ্ধের দেবী নাইকি। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ বছরেরও আগের এজিয়ান সাগরতীরের রোডস দ্বীপের অধিবাসীদের কোনো যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে এটিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। গ্রিসের সামথ্রেস দ্বীপ থেকে ১৮৬৩ সালে যখন এটি উদ্ধার করা হয়, তখন একটা ডানা ভাঙা ছিল। মিরর ইমেজ টেকনোলজি ব্যবহার করে ডান পাশের ডানাটি যুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিটি ছবি কিংবা ভাস্কর্যের পেছনেই আছে ইতিহাস। সব লিখতে গেলে বাংলাপিডিয়ার মতো ১০ খণ্ডের বইয়েও কুলাবে না। ৩ লাখ ৮০ হাজার নিদর্শনের মধ্যে মাত্র ৩৫ হাজার নিদর্শন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। সবগুলো যদি কেউ ৩০ সেকেন্ডের জন্যও একবার করে দেখতে চান তাহলে ১০০ দিনের বেশি সময় লাগবে। বের হওয়ার পথে অনেকগুলো স্যুভেনিরের দোকান দেখা যায়। দুই ইউরো দিয়ে মোনালিসার ছবি খোদাই করা একটি মুদ্রা কিনলাম। মুদ্রার অন্য পাশে ল্যুভের ছবি। ভবিষ্যতে স্মৃতিচারণা করা যাবে।
ছবি: লেখক