
ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সংগীত ও আধুনিক অভিজ্ঞতার অনন্য সমন্বয় খুঁজছেন, এমন বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য সৌদির অন্যতম মোহনীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে আলউলা। রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম মরুভূমির কোলে অবস্থিত এই স্থানটি যেন এক জীবন্ত জাদুঘর। ৭ হাজার বছরের সভ্যতার ছাপ বহন করে চলেছে আজকের সৃজনশীলতার আলোয়।
সোনালি মরুভূমির সকাল, সংস্কৃতিতে ভরপুর বিকেল আর ইতিহাস ও গল্পে আলোকিত রাত—আলউলা সময়ের সীমা পেরিয়ে এক অনবদ্য অভিযাত্রার সঙ্গী হওয়ার আহ্বান জানায়। জেদ্দা, মক্কা ও মদিনা থেকে সহজ যোগাযোগ এবং তুলনামূলক সাশ্রয়ী সুযোগ-সুবিধার কারণে এটি দ্রুতই বাংলাদেশি ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে।

আলউলার দিন শুরু হয় নরম সূর্যালোকের স্পর্শে। সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে বালুপাথরের পাহাড়, প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র ও ৫২ মিটার উঁচু এলিফ্যান্ট রকের মতো প্রাকৃতিক বিস্ময়ের গায়ে। দুপুরে, বিশেষ করে মিডডে অ্যাট টানতোরা আয়োজনে প্রতীয়মান হয় নাবাতিয়দের অসাধারণ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। সূর্যের অবস্থান যখন ঐতিহ্যবাহী টানতোরা সূর্যঘড়ির সঙ্গে মিলে যায়, তখন দর্শনার্থীরা প্রত্যক্ষ করেন—কীভাবে আলো ও ছায়ার চলনে প্রাচীন মানুষ ঋতু ও দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি প্রহর নির্ধারণ করত। অনেক বাংলাদেশি পর্যটকের কাছে এটি হয়ে ওঠে গভীর আবেগের মুহূর্ত—যেখানে ইতিহাসকে অনুভব করা যায় প্রকৃতির ভাষায়।

বিকেল নামতেই আলউলা রূপ নেয় সংগীত, শিল্পকলা ও সামাজিক মিলনমেলায়। উইন্টার অ্যাট টানতোরা উৎসব চলাকালে আলজাদিদাহ আর্টস ডিস্ট্রিক্ট, আলমানশিয়াহ প্লাজায় আয়োজন করা হয় শোরফাত টানতোরা—যেখানে বারান্দা থেকে ভেসে আসে সুরের ঝরনাধারা। ঐতিহ্যবাহী তালে মিশে যায় আধুনিক বিট, আর আলোর নিচে হাঁটতে হাঁটতে দর্শনার্থীরা স্থানীয়দের সঙ্গে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেন অনিন্দ্য পরিবেশনা। এই সাংস্কৃতিক বিনিময় তৈরি করে উষ্ণ ও আপন আবহ—যেখানে বাংলাদেশি পর্যটকেরাও হয়ে ওঠেন উৎসবের অংশ।
১৯ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত চলা আলমানশিয়াহ কার্নিভাল ঐতিহ্য ও বিনোদনের এক প্রাণবন্ত মেলবন্ধন। রঙিন ক্ষুদ্র প্যারেড, পুরোনো দিনের খেলা, লাইভ কনসার্ট, কারুশিল্প কর্মশালা ও পরিবারবান্ধব নানা আয়োজন এই উৎসবকে করে তোলে আনন্দমুখর। শিশুদের নিয়ে ভ্রমণে আসা বাংলাদেশি পরিবারগুলোর জন্য এটি হয়ে ওঠে শীতকালীন ভ্রমণের অন্যতম স্মরণীয় অধ্যায়।

১৬ জানুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় আলউলা আর্টস ফেস্টিভ্যাল বিশ্বজুড়ে সৃজনশীলতার এক অনবদ্য উদ্যাপন। প্রদর্শনী, ইনস্টলেশন, লাইভ পারফরম্যান্স ও আন্তর্জাতিক শিল্পীদের আবাসিক কর্মসূচির মাধ্যমে এখানে ফুটে ওঠে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমান্তরাল সহাবস্থানের সৌন্দর্য। মরুভূমির বিস্তীর্ণ প্রান্তর হয়ে ওঠে সৃজনের ক্যানভাস, যা বাংলাদেশি আলোকচিত্রশিল্পী, তরুণ ভ্রমণপ্রেমী ও শিল্পানুরাগীদের জন্য অফুরন্ত অনুপ্রেরণা জোগায়।

১৮ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত চলা ওল্ড টাউন কালিনারি ভয়েস অতিথিদের নিয়ে যায় স্বাদের এক অনন্য যাত্রায়। একাধিক রেস্তোরাঁয় পরিবেশিত চার পর্বের খাবারের এই অভিজ্ঞতায় প্রতিটি পদ পরিবেশিত হয় গল্পের সঙ্গে, যেখানে উঠে আসে স্থানীয় উপকরণ, রন্ধনপ্রথা ও ঐতিহ্যের কথা। ঝাল থেকে মিষ্টি—প্রতিটি স্বাদে ভ্রমণকারীরা আবিষ্কার করেন আলউলার খাদ্যসংস্কৃতির গভীরতা।

রাত নামতেই আলউলা প্রকাশ করে তার সবচেয়ে মায়াবী রূপ—হেগরা আফটার ডার্ক। সৌদি আরবের প্রথম ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হেগরা দিনে যতটা বিস্ময়কর, রাতে তা হয়ে ওঠে অবিস্মরণীয়। আলো, গল্প, নাট্যদৃশ্য ও থিমভিত্তিক ডাইনিং প্রাচীন নাবাতিয় সমাধিগুলোকে রূপ দেয় জীবন্ত ইতিহাসে। আলোকিত পথে হাঁটতে হাঁটতে দর্শনার্থীরা অনুভব করেন—সভ্যতার উত্তরাধিকার কীভাবে নতুনভাবে প্রাণ পায়। বাংলাদেশি পরিবার, দম্পতি বা বন্ধুদের দলের কাছে এটি প্রায়ই পুরো ভ্রমণের সেরা অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।
• যাতায়াত: রিয়াদ, জেদ্দা বা দুবাই থেকে সরাসরি আলউলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট
• থাকার ব্যবস্থা: বিলাসবহুল মরুভূমি রিসোর্ট থেকে শুরু করে বুটিক লজ ও পরিবেশবান্ধব ক্যাম্প
• উৎসবের হাইলাইট: শোরফাত টানতোরা, হেগরা আফটার ডার্ক, আলউলা আর্টস ফেস্টিভ্যাল
• অতিরিক্ত অভিজ্ঞতা: হেগরায় হাইকিং, তারাভরা আকাশ দেখা, জিপলাইন, ওল্ড টাউনের সুক ঘোরা
• পরিকল্পনা: উইন্টার অ্যাট টানতোরা টিকিট আগেভাগে বুক করতে হয়
আলউলা এমন এক গল্প বলে, যা ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে নতুন অধ্যায় যোগ করে। ইতিহাসের ভেতর প্রবেশ করুন, সংস্কৃতির সুরে ভাসুন, আর অনুভব করুন—সংগীত, শিল্প ও চিরন্তন সৌন্দর্যে জীবন্ত মায়াবী এক মরুভূমি শহরের ইন্দ্রজাল।
আরও তথ্যের জন্য ভিজিট করুন: visitsaudi.com
ছবি: সৌদি টুরিজম অথিরিট