কসোভো কি সত্যিই একটি স্বাধীন দেশ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে একটু থমকে দাঁড়াতে হয়। উত্তরটা সরল নয়—একদিকে ‘হ্যাঁ’, অন্যদিকে ‘না’। আপনি কাকে প্রশ্ন করছেন, সেটাই ঠিক করবে কী উত্তর পাবেন। কসোভোর সাধারণ মানুষের মুখে ফেরা আত্মবিশ্বাস আর গর্ব: ‘অবশ্যই, আমরা স্বাধীন! আমরা ইউরোপের নবীনতম রাষ্ট্র।’ কিন্তু একই প্রশ্ন যদি কোনো সার্বিয়ানকে করেন, হয়তো ভুরু কুঁচকে বলবে, ‘এই স্বাধীনতা তো কাগজে-কলমে, বাস্তবে নয়!’
আসলেই, প্রশ্নটি এখানে একধরনের নীরব সংবেদনশীলতা—যা সবাই বোঝে, কিন্তু সবাই খোলাখুলি বলতে চায় না।
বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশ কসোভোকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ দেশ এর মধ্যে রয়েছে। কিন্তু সার্বিয়া এখনো সেই স্বীকৃতি দেয়নি, আর তার সঙ্গে আছে রাশিয়া, চীনসহ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ। এই জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা আমাদের স্বাধীনতার শুরুর দিনে কিছু রাষ্ট্রের দ্বিধা ও অস্বীকৃতির গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বলকান অঞ্চলের এই ছোট্ট স্থলবেষ্টিত দেশটির চারপাশে রয়েছে সার্বিয়া, মন্টেনেগ্রো, আলবেনিয়া ও উত্তর মেসিডোনিয়া। জনসংখ্যা মাত্র ১৮ লাখ, যার প্রায় ৯০ শতাংশ আলবেনীয় মুসলিম। তুর্কি ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে এক বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি। রাজধানী প্রিসটিনা শুধু প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, এটি ইতিহাস, সংগ্রাম, তারুণ্য এবং আত্মপরিচয়ের প্রতীক। বলে রাখা ভালো, এই অঞ্চল প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, আর তাই তার উত্তরাধিকার আজও চারপাশে স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়।
আমার কসোভো ভ্রমণ আসলে এক হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্তের ফল। এক দুপুরে বসেই ঠিক করলাম—বলকান অঞ্চলের তিনটি দেশ ঘুরে দেখব: কসোভো, উত্তর মেসিডোনিয়া আর সার্বিয়া। টিকিট বুকিং, ব্যাগ গোছানো আর কিছু প্রাথমিক রিসার্চ শেষে নির্দিষ্ট দিনে সুইডেনের স্টকহোমের আরল্যান্ডা বিমানবন্দর থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এয়ারলাইনসে চড়ে পৌঁছে গেলাম প্রিসটিনায়। বিমানের দরজা খুলতেই যে বাতাস মুখে এসে লাগল, তাতে মিশে ছিল অপরিচিত এক উষ্ণতা।
প্রথম নজরে প্রিসটিনা আমাকে মুগ্ধ করেনি। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শহরটি যেন ধীরে ধীরে নিজেকে উন্মোচন করল। রাস্তায় তরুণ-তরুণীদের ভিড়, দেয়ালে রঙিন ম্যুরাল, পুরোনো আর নতুন স্থাপনার মিশ্রণ—সবই যেন বলছে, ‘আমরা এখনো গড়ে উঠছি, কিন্তু থেমে নেই।’
এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি চলে গেলাম শহরের কেন্দ্র—মাদার তেরেসা বুলেভার্ডে। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালাম নিউবর্ন মনুমেন্টে, যা স্বাধীনতা উপলক্ষে উন্মোচিত হয়েছিল এবং প্রতিবছর নাকি নতুনভাবে রং করা হয়। এরপর চোখে পড়ল জাতীয় গ্রন্থাগার—অদ্ভুত ও অনন্য স্থাপত্যের এক নিদর্শন। আর কিছু দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি প্রাচীন মসজিদ, শহরের দীর্ঘ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যেকোনো নতুন দেশে গিয়ে আমার ভ্রমণ শুরু হয় খাবার দিয়ে। আমার কাছে খাবার শুধু পেট ভরানোর উপায় নয়—এটি একটি সাংস্কৃতিক ভাষা, যেখানে প্রতিটি মসলা, প্রতিটি রান্না সেই দেশের গল্প বলে। তাই কসোভোতে পৌঁছেই ঠিক করলাম, আজকের দিনটি হবে একান্তই ‘রসনা-যাত্রা’।
সকালে হোটেল থেকে বের হয়ে শান্ত রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ঢুকলাম এক ছোট্ট কিন্তু আধুনিক ক্যাফেতে। অর্ডার করলাম গরম গরম টোস্ট—চিকেন, পনির আর সবজির সুন্দর সংমিশ্রণ, পাশে ছোট জলপাই। প্রথম কামড়েই মনে হলো, যেন কারও বাড়ির সকালের নাশতায় বসেছি—এতটাই ঘরোয়া, এতটাই উষ্ণ স্বাদ! চা বা কফি সঙ্গে না নিয়ে বরং সেই স্বাদ মুখে রেখে কসোভোর ঠান্ডা সকালের বাতাসে হাঁটতে থাকলাম।
হাঁটতে হাঁটতে থামলাম স্থানীয় এক ঐতিহাসিক মসজিদের পাশের ছোট্ট রেস্তোরাঁয়। সেখানে নিলাম তুর্কি চা—টিউলিপ আকৃতির কাচের গ্লাসে পরিবেশিত, হালকা তেতো স্বাদ, সঙ্গে চিনি আর লেবুর টুকরা। গরম ধোঁয়া উঠতে থাকা সেই চায়ের কাপ হাতে জানালার ধারে বসে দেখছিলাম রাস্তায় শিশুদের খেলা, বৃদ্ধদের আড্ডা, দোকানিদের ডাক। মনে হচ্ছিল, সময় যেন ধীরে বইছে, আর আমি তার ভেতরে ভেসে আছি।
দুপুরে গেলাম স্থানীয় এক খাবারের দোকানে। অর্ডার করলাম ডোনার কাবাব—তবে এটি সাধারণ র্যাপ নয়, বরং তুর্কি স্টাইলের পিদে রুটিতে পরিবেশিত। নরম, হালকা টোস্ট করা রুটির ভেতরে মসলা-মাখানো পাতলা মাংস, টক দইয়ের সস, টমেটো, শসা আর লেটুস। উপকরণে সরলতা থাকলেও প্রতিটি কামড়ে ছিল স্বাদের বিস্ফোরণ। দামও অবিশ্বাস্য—মাত্র কয়েক ইউরো!
বিকেলে শহর ঘুরে ফিরে ক্ষুধা পেয়ে চেখে দেখলাম বোরেক—পাতলা ময়দার স্তরের ভেতরে মাংস, পনির বা পালংশাকের পুর। বাইরে মুচমুচে, ভেতরে নরম। এক কামড়ে মনে হলো, আমি যেন হঠাৎ চলে গেছি শতাব্দী প্রাচীন তুর্কি রান্নাঘরে।
দিনের শেষ খাবারের জন্য বেছে নিলাম গ্রিলড ল্যাম্ব কাবাব। সঙ্গে টমেটো-পেঁয়াজের সালাদ, স্থানীয় রুটি আর ঠান্ডা আয়রান—লবণ মেশানো দইয়ের পানীয়। রসাল কাবাব মুখে দিলেই গলে যাচ্ছিল, আর আয়রানের ঠান্ডা স্বাদ পুরো দিনের খাবারের যাত্রাকে নিখুঁত সমাপ্তি দিল।
রাতের প্রিসটিনা তখন আলো, সংগত আর মানুষের হাসিতে ভরা। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, আজকের দিনটি আমাকে শিখিয়েছে—প্রথমত, ‘সস্তা মানেই খারাপ’ এই ধারণা ভুল। দ্বিতীয়ত, খাবারের মাধ্যমে আপনি একটি জায়গাকে এমনভাবে জানতে পারবেন, যা কোনো বই বা মিউজিয়াম শেখাতে পারবে না।
কসোভো আমাকে দেখিয়েছে, স্বাধীনতার গল্প শুধু রাজনীতির পাতায় নয়—এটি মানুষের হাসি, চায়ের ধোঁয়া, রুটির গন্ধ আর বাজারের কোলাহলে লুকিয়ে থাকে। এই দেশের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি খাবার, প্রতিটি দৃষ্টি যেন বলছে, ‘আমরা বেঁচে আছি, আমরা এগোচ্ছি।’
আপনি যদি এমন একটি জায়গা খুঁজে থাকেন, যেখানে একদিকে রয়েছে ইতিহাসের বাস্তবতা, আর অন্যদিকে সুলভে পাওয়া যায় সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা, তবে প্রিসটিনা ও বলকানের অন্যান্য শহর হতে পারে আপনার পরবর্তী গন্তব্য। খোলামনে রওনা দিন, প্রতিটি পদক্ষেপে মানুষের গল্প শুনুন, আর চায়ের কাপ হাতে অনুভব করুন—কসোভো তার নতুন ইতিহাস লিখছে, আর আপনিও যেন সেই গল্পের অংশ হয়ে আছেন।
ছবি: লেখক