ভাবতেই অবাক লাগে, শত বছর আগেও বিশ্ব মানচিত্রে জর্ডান নামে কোনো দেশ ছিল না। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সৌদি আরব, জর্ডান, প্যালেস্টাইন, ইসরাইল ইত্যাদি ভূখণ্ডের নামকরণ হয়নি। সব মিলিয়ে পুরো আরব ভূখণ্ড অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
জর্ডান নদীর পূর্ব তীর থেকে ইরাকের সীমান্ত পর্যন্ত এই আরব ভূমিকে বলা হতো ট্রান্সজর্ডান। ভূমধ্যসাগর থেকে পুবে মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক) পর্যন্ত পুরো আরব ভূখণ্ড একসময় পরিচিত ছিল লেভান্ত নামে। ট্রান্সজর্ডান এলাকায় জনপদ ছিল ব্রোঞ্জ যুগ থেকে। এরপর ট্রান্সজর্ডানে চলতে থাকে সাম্রাজ্য ও শাসকের পরিবর্তন। গ্রিক, নাবাতিয়ান, রোমান, দামেস্কের উমাইইয়া খেলাফত, বাগদাদের আব্বাসীয় খেলাফত, কায়রোর ফাতিমিদ খেলাফত আর সবশেষে তুরস্কের অটোমানরা ট্রান্সজর্ডানসহ সমগ্র লেভান্ত এলাকা দখল করে প্রায় সাড়ে চার শ বছর তাদের শাসনে রাখে। শেষমেশ আরব বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে অটোমান শাসনের পতন হয়। বিশ্ব মানচিত্র, ইতিহাস ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জর্ডান নামের একটি বৈচিত্র্যমণ্ডিত ও প্রত্নসমৃদ্ধ অঞ্চল বিশ্ববাসীর সামনে আসে। সুপ্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও খাদ্যসামগ্রীর কারণে জর্ডান ক্রমেই বিশ্ব পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়।
‘দ্য রেড রোজ সিটি’ মানে খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ বছরের পুরোনো পেত্রা নগরী, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম স্থাপত্য ভ্রমণে গিয়েছিলাম। প্রত্নস্থল ভ্রমণ ছাড়াও তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। সেসব বৈচিত্র্যময় খাদ্যসামগ্রীই আজকের উপজীব্য।
তুরস্ক, জর্ডান, মরক্কো, মিসর—এই চার দেশের খাবার আমার কাছে প্রায় একই রকম লেগেছে, নামের ভিন্নতা ছাড়া। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কৃষ্টি, ভাষা, খাদ্যসংস্কৃতি স্রোতের মতো বহমান। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। জর্ডানের খাবারে উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নানা দেশের খাদ্যসংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে। অবশ্য এটা আমার কথা নয়, বলেছেন ট্যুর গাইড মোহাম্মদ ইয়াসির।
জর্ডান, মিসর আর তুরস্কের আরও একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, তা হলো, প্রতি দশজনের মধ্যে একজনের নাম মোহাম্মদ, আহমেদ কিংবা ইয়াসির। জর্ডানের রেস্তোরাঁ হোক কিংবা পথের পাশের খাবারের দোকানই হোক, হামুস, ফালাফেল স্যান্ডউইচ, সালাদ ও বিভিন্ন ধরনের রুটি সহজলভ্য। হয়তো মান ও গুণের ফারাক থাকতে পারে। জর্ডানের রসনাকে অন্য সব আরব দেশের থেকে আলাদা করেছে ৪টি খাবার—মানসাফ, মাগলোবা, ফালাফেল ও জার্ব।
জর্ডানের কুইজিনে জাতীয় খাবারটি হলো মানসাফ। এটি আরবের অন্যান্য দেশের মতোই মনে হলো। স্থানীয় মসলার ব্যবহারে একটি আলাদা ফ্লেভার টের পাওয়া যায়। খুশবুতে আধা ভোজন হয়ে যায়। ফলে একটু খেলেই মনে হয়, মেলা খেয়ে ফেলেছি। এটি সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মত। মানসাফ খাওয়ার আগে রীতিমতো আধ্যাত্মিক বিষয় রয়েছে। সবাই দাঁড়িয়ে কেবল ডান হাত দিয়ে এটি উপভোগ করে থাকে। একটি বড় পাত্রে সবাই একসঙ্গে খাবার গ্রহণ করে। অবশ্য পর্যটকদের জন্য এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। জর্ডানের সব শহরেই দুপুরের আয়োজনে মানসাফ খেয়েছি।
আবার জার্বের রন্ধনপদ্ধতি বেশ নাটকীয়। ওয়াদি রাম মরুভূমিতে এক রাতের তাঁবুবাস করেছি। দিনে জিপে চড়ে পাথরের পাহাড় আর সোনালি বালুকাময় প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছি। সন্ধ্যাবেলায় ক্যাম্পে ফেরার পর বেদুইন চায়ের সঙ্গে উপভোগ করেছি জার্ব। পুরো রান্নার পদ্ধতি দেখিনি। কিন্তু রান্না হওয়ার পর মাটির নিচ থেকে পাত্র উত্তোলনের আয়োজন দেখেছি। এটি বেদুইন বারবিকিউ। জার্ব রান্না হয় মাটির নিচে।
মাংস ও সবজি মসলায় মাখিয়ে একটি ট্রেতে নেওয়া হয়। তারপর একে ঢেকে মাটির নিচে পোড়ানো হয়। এতে স্মোকি স্বাদ পাওয়া যায়। গাইড ইয়াসির বলল, ‘এলিজা তোমার ক্যামেরা নিয়ে রেডি হও। এখন জার্বের পাত্র মাটির নিচ থেকে তোলা হবে।’
রান্নার স্থলে গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। ক্যাম্পের সব পর্যটক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বালুকাময় আয়তকার একটি চত্বরে। বোঝা যাচ্ছে, সেখানে দুই থেকে তিনটি ভূগর্ভস্থ চুল্লি রয়েছে। সেখানকার একটি চুল্লিতে রান্না হয়েছে আজকের জার্ব। চারজন মিলে দুটি বড় লোহার লাঠিসহযোগে গরম একটি পাত্র মাটির নিচ থেকে তুলে আনল। পাত্র বলতে ট্রেসদৃশ কিছু একটা। পাত্রটিও লোহার। পাত্রের তিনটি পৃথক অংশ। প্রথম অংশে আলু আর মুরগি গ্রিল করা হয়েছে। তারপরের অংশে ভেড়ার মাংস। সবশেষ অংশে একটি পাত্রে পোলাও।
পুরো কর্মকাণ্ডে আমি ছবি তুলতেই ভুলে গেলাম। মনে হচ্ছিল, সেখানেই খাওয়া শুরু করি। পরিবেশনের আগে আরও কিছু নিয়মকানুন আছে। রান্নাঘরে নিয়ে জিনিসগুলোকে এখন মেশানো হবে কয়েকটি স্পেশাল মসলায়। তারপরই খাবার উপযোগী হবে। কিন্তু ডাইনিংয়ে যখন পরিবেশন করা হয়, জার্ব স্পেশাল খাবার—সেটি একদমই মনে হচ্ছিল না। সাধারণ বিরিয়ানির মতোই লাগছিল দেখতে।
মানসাফ, জার্ব ও মাগলুবা আমার কাছে প্রায় একই রকম স্বাদের মনে হয়েছে। মসলাযুক্ত মাংস, ভাত আর সবজির একটি ঐতিহ্যবাহী জর্ডানীয় খাবার। মাংস ও শাকসবজি ভাতের ওপরে স্তরে স্তরে রেখে রান্না করা হয়। পরিবেশনের সময় একটি পাত্রে হাঁড়ি থেকে পুরো খাবার ওলটানো হয়, যাতে ভাতের অংশটি নিচে থাকে। ওপরের তিনটি খাবারেই পর্যাপ্ত পরিমাণ বাদাম, আখরোট , কিশমিশসহ নানা ধরনের ড্রাই ফ্রুটস যুক্ত থাকে।
ফালাফেলকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। কারণ, এটি বছরের পর বছর ধরে আন্তর্জাতিক খাবারের সঙ্গে যুক্ত। জর্ডানের স্ট্রিট ফুডের তালিকায় ফালাফেল রয়েছে। সেই অতীতের লেভান্ত ভূখণ্ডজুড়ে ফালাফেল একটি সিগনেচার ডিশ। জর্ডানের স্থানীয় লোকজন প্রাতরাশ থেকে শুরু করে গভীর রাতের স্ন্যাকস পর্যন্ত প্রতিবারই অন্যান্য খাবারের সঙ্গে ফালাফেল খেয়ে থাকেন।
একটি রেস্তোরাঁয় বসুন এবং আপনার সময় থাকলে তাজা পুদিনা, রুটি ও একটি সুস্বাদু সবজির পাশাপাশি ফালাফেলসহকারে আপনার উদরপূর্তি করুন। ফালাফেলের সঙ্গে আরও একটি জনপ্রিয় খাবার হলো হামুস। প্রায় প্রতিটি বাড়ির প্রধান খাদ্য। এটি প্রচুর পরিমাণে প্রোটিনসমৃদ্ধ বলে সকালের নাশতায় ফালাফেল ও হামুসের প্রচলন বেশি।
মিষ্টি খাবারগুলো প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মিষ্টি মনে হয়েছে আমার কাছে। শুভাকাঙ্ক্ষী যারা আমার আগে জর্ডান ভ্রমণ করেছেন, তাঁরা সবাই আমাকে কুনাফা চেখে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন। কুনাফা বেশ লেগেছে খেতে। মাদাবা শহরে খেয়েছি কুনাফা। এটা ফিলিস্তিনের পেস্ট্রি বলে খ্যাত।
কিন্তু এখন জর্ডানে দারুন জনপ্রিয়। দিলালা নামের ভিন্ন ধরনের একটি মিষ্টান্নের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। আঙুরের পাতায় পনির দিয়ে ভাপে সেদ্ধ করা হয়। লকমাও একটি মিষ্টি খাবার। ময়দা ও ডালের গুঁড়া মিশিয়ে বানানো হয়। তেলে ভেজে তারপর চিনি গুলানো পানিতে রাখা হয়। থাকার জন্য যেসব হোটেলে রাত যাপন করেছি, বুফেতে গিয়ে ১০-১২ রকমের মিষ্টি খাবারের স্বাদ নিয়েছি—সবগুলোর নামও মনে নেই।
জর্ডানে কফি গুরুত্বপূর্ণ এবং জর্ডান সংস্কৃতির একটি মূল অংশ। জর্ডানের গ্রামের সামাজিক মিলনমেলার অন্যতম কেন্দ্র হলো কফির দোকান। তুর্কি কফি খুব জনপ্রিয়। এটি ঘন এবং এতে মিষ্টি সিরাপ ব্যবহার করা হয়। অন্য বিকল্প হলো বেদুইন কফি, যার স্বাদ আরও তিক্ত এবং প্রায় সবুজ রঙের। সাধারণত ক্যাফে বা সর্বজনীন স্থানে বেদুইন কফি খুঁজে পাবেন না। কেবল স্থানীয় লোকজন পরিবেশন করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
বেদুইন চা ও বেদুইন কফি খেয়েছি ওয়াদি রাম মরুভূমি ও পেত্রা নগরীতে স্থানীয়দের তৈরি। এ ছাড়া জর্ডানের রাজধানী আম্মান শহরের প্রায় প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্র ও স্যুভেনির শপে পর্যটকদের পুদিনা চায়ে উষ্ণ অভ্যর্থনাসহকারে স্বাগত জানানো হয়।
হয়তো আরও অনেক জনপ্রিয় খাবার আমার তালিকায় যুক্ত করা হয়নি সময়ের স্বল্পতায়। কিন্তু জর্ডানের বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যসংস্কৃতি এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল। আবার কখনো জর্ডানের খাবারের স্বাদ গ্রহণ করার সৌভাগ্য হবে কি না, জানি না।
ছবি: লেখক