যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল শহরের নাম আমার কাছে খুব পরিচিত একটা উদ্ভট কারণে। আমাদের শৈশবে এক আত্মীয় আমাদের বাড়ি আসতেন মাঝেমধ্যেই। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও তিনি ধূমপায়ী ছিলেন। পান করতেন ব্রিস্টল সিগারেট। ওটা মূলত দেশি ব্র্যান্ডের ফিল্টার সিগারেট; কিন্তু নাম ছিল ১৮৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত ডব্লিউ ডি অ্যান্ড এইচও উইলস টোব্যাকো কোম্পানির ব্রিস্টল সিগারেটের নাম নকল করে। সেই থেকেই নামটা গেঁথে ছিল মনের মধ্যে। এর বহু বছর পর ব্রিটেনে পরিযায়ী হয়েছি। তা–ও তো বেশ অনেক বছর হয়ে গেল। কিন্তু নানা কারণে রোমান গেটওয়ে খ্যাত ব্রিস্টলে যাওয়া হয়নি। বছর সাতেক আগে ব্রিস্টলের একেবারেই পাশের শহর রোমান বাথ আর উইল্টাশায়ারের নিওলিথিক সময়ের স্থাপনা স্টোনহেঞ্জ ঘুরে এসে লিখেছিলাম ভ্রমণ গল্প।
অবশেষে এ বছরের মার্চে ব্রিস্টল দর্শনের সুযোগ করে দিল আইসিআইটি নামের একটি আন্তর্জাতিক রিসার্চ কনফারেন্স। আইসিআইটি একটি স্বনামধন্য কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং কনফারেন্স, যা প্রতিবছর ইউরোপ, আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ার আলাদা দেশে আয়োজিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় দেড় শ গবেষক উপস্থিত হন সেই কনফারেন্সে। এবারের আয়োজক ছিল ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের বিখ্যাত রোবোটিকস ল্যাব। এআই শ্রেণিবিন্যাস, অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ফুসফুসের ছবি পর্যালোচনা করে ফুসফুসের ক্যানসার চিহ্নিত করার নতুন কৌশল বিষয়ে আমাদের একটি গবেষণাপত্র সেই কনফারেন্সে পাবলিশ করা হবে। সেই গবেষণাপত্র উপস্থাপন করার জন্য নিমন্ত্রণ পেলাম আমি এবং আমার সহ–গবেষক।
শেষ মার্চের সেই সকালে যাত্রা শুরু করলাম কেমব্রিজ থেকে। গন্তব্য বিখ্যাত এভন নদীর তীরের রোমান শহর ব্রিস্টল। ব্রিটেনের শীত তখনো বেশ জাঁকিয়ে রয়েছে। পুলওভার, হাতমোজা আর পায়ে পুরু মোজা ছাড়া চলার উপায় নেই। অগ্যতা ভারী সব শীতবস্ত্র পরেই বেরোলাম। প্রথমে কেমব্রিজ নর্থ স্টেশন থেকে গ্রেটার এংলিয়া ট্রেনে কিংসক্রস সেইন্ট প্যানক্রাস স্টেশন। সেখান থেকে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে প্যাডিংটন স্টেশন। সেখান থেকে ব্রিস্টল। সর্বমোট চার ঘণ্টার ট্রেন যাত্রা। ট্রেন থেকে নেমে মিনিট আটেক হাঁটাপথ। তারপরই ডাবল ট্রি হিল্টন হোটেল, যেখানে ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে তিন দিনের এই কনফারেন্স।
সিদ্ধান্ত হলো কনফারেন্সের ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু দেখা যায়, ততটুকু দেখব এই শহর, যে শহরে মানুষের বাসস্থান ছিল সেই প্রস্তর যুগ থেকে। তবে ব্রিস্টল নামের এই শহর যাত্রা শুরু করে পনেরো শ বিয়াল্লিশ খ্রিষ্টাব্দে। জানা যায়, প্রায় ষাট খ্রিষ্টাব্দে রোমানরা ব্রিস্টল এবং বাথ শহরের আশপাশে বসতি স্থাপন করে। ধীরে ধীরে তারা নির্মাণ করে রোমান বাথ এবং সেই উষ্ণজলের প্রস্রবণ।
প্রথম দিনের কনফারেন্স শেষে সন্ধ্যায় বেরোলাম ডিনারের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথেই দর্শন হলো বিখ্যাত এভন নদী। যে নদী বিধৌত করেছে আরেক বিখ্যাত শহর রোমান বাথ এবং অবশ্যই শেক্সপিয়ারের শহর স্ট্রাটফোর্ড আপ-অন-এভন।
এই এভন নদীর আলো হাওয়ায় সতেরো শ শতকে জেইন অস্টিন হয়ে উঠেছিলেন বিখ্যাত লেখিকা। নদীর কূলের ক্যাফেতে বসে মনে পড়ল ভবা পাগলার সেই বিখ্যাত গান:
আমরা কী যে আশায় ভাসিয়া চলেছি
আপনারই সব ভুলে
জীবন-নদীর কূলে কূলে...
আসলে জীবন আসে জীবন যায়। কিন্তু নদী, প্রকৃতি রয়ে যায় অনন্তকাল। তবে এবারে পদ্মাপারে গিয়ে প্রচণ্ড মন খারাপ হয়েছিল দুই কূলে প্লাস্টিক বর্জ্যের বহর দেখে। জানি না কত দিন বেঁচে থাকবে বাংলার নদীগুলো। বুঝতে পারি না আমাদের মানুষ কেন জেনেবুঝে এমন আত্মঘাতী কাজ করেন। তবে কি নিরোদ সি চৌধুরীর ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ আখ্যাই ঠিক?
নৈশভোজ থেকে ফেরার পথে দেখা মিলল সেন্ট ম্যারি র্যাডক্লিফ ভারতবর্ষ ভাগকারী র্যাডক্লিফ নয়। সেন্ট ম্যারি র্যাডক্লিফ ব্রিস্টলের প্রাচীন র্যাডক্লিফ ডিস্ট্রিক্টের প্রায় হাজার বছরের পুরোনো একটি গোথিক মাস্টারপিস। হাজার বছর আগের শৈল্পিক কারুকার্য দেখে বোকা বনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সামনের দিকটা অনেকটাই এডিনবরার হাইল্যান্ড ক্রিক চার্চের মতো।
জানালার কাচের কারুকার্য আর চিত্রশিল্পের আবেদন অনেকটাই ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের মতো। প্রতিটা কারুকার্য দেখে সহজেই অনুমান করা যায় কেন গোটা চার্চ তৈরি করতে শত বছরের বেশি সময় লেগেছিল। ব্রিটেনের সব গির্জার ভেতরে ঢুকলে এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে মনটা ভরে যায়। গোটা চার্চে থাকে না কোনো পিনপতনের শব্দ। সেই সঙ্গে প্রাচীন ভবনের অদ্ভুত এক ঘ্রাণ। অনেকটাই কার্তিক মাসের শেষের কোনো এক সন্ধ্যায় কাঠের আলমারি থেকে বের করা লেপ কিংবা সোয়েটারের গায়ে লেগে থাকা ঘ্রাণের মতো। যে ঘ্রাণ দিয়ে শিগগির ছুঁয়ে আসা যায় শৈশব–কৈশোর।
পরের দিন সকালে আবার শুরু হলো কনফারেন্স। চলল বিকেল তিনটা পর্যন্ত। এরপরেই আমি আর সুইডেনের মালমো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু–গবেষক আরডেল বেরিয়ে পড়লাম বাকি ব্রিস্টল দর্শনে। প্রথমে ঢুকলাম ব্রিস্টল ক্যাথিড্রালে। এটাও এক হাজার বছরের পুরোনো ক্যাথিড্রাল। তবে সেন্ট ম্যারি র্যাডক্লিফের থেকে খানিকটা বড়। ব্রিস্টল ক্যাথিড্রালকে ব্রিটেনের অন্যতম মধ্যযুগীয় স্থাপনা হিসেবে গণ্য করা হয়।
এখানেও অসাধারণ সব স্থাপত্যশৈলী আর সেই সঙ্গে মৃদুস্বরে চলছে অর্কেস্ট্রার সুর। বিশেষ করে ব্রিস্টল ক্যাথিড্রালের মতো বিশাল চার্চের ভেতরের সারি সারি বেঞ্চের কোনো একটাতে চোখ বন্ধ করে বসে থাকলে মনের মধ্যে কেমন যেন বুদ্বুদ উদ্গিরণ হয়। বারবার মনে পড়ে পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশের সেই বিখ্যাত বাংলা বন্দিশ ‘কূল ছেড়ে এসে মাঝ দরিয়ায়, পেছনের পানে চাই...’। পাওয়া যায় জীবনের ভিন্ন মানে। ঠিক যেমন মনটা আকুল করেছিল অস্ট্রো–হাঙ্গেরিয়ান শহর ক্লোজ নেপোকার সেই বিখ্যাত সেইন্ট মিকাইল (মাইকেল) চার্চ।
ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো তারা তাদের প্রাচীন স্থাপত্যকর্ম আগলে রাখে বুক দিয়ে। এই দেশেও অন্তত আরও পাঁচ মতবাদের চার্চ আছে; যেমন এংলিক্যানিজম, ক্যাথলিজম, চার্চ ইন ওয়েলস, মেথডিস্ট চার্চ অব গ্রেট ব্রিটেন, চার্চ অব আয়ারল্যান্ড ইত্যাদি। কিন্তু সব মতবাদই প্রাচীন স্থাপত্য রক্ষার মন্ত্রে দীক্ষিত।
ব্রিস্টল ক্যাথিড্রাল থেকে প্রচুর জীবনীশক্তি নিয়ে বেরিয়ে হাঁটা দিলাম ক্লক টাওয়ারের উদ্দেশে। যেখান থেকে পাখির চোখে দেখা যায় ব্রিস্টলের সৌন্দর্য। উঁচু টাওয়ারের ওপর থেকে ব্রিস্টল শহরকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে কোনো উপায়ই নেই। এদিকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা বেশ চেপে ধরেছে। অগত্যা সিদ্ধান্ত হলো কফি ব্রেকের। আর্কিটেক্ট নামের এক কফি শপে কফি পান শেষে যাত্রা শুরু সেই বিখ্যাত ক্লিফটন সাসপেনশন ব্রিজের উদ্দেশে। আঠারো শতকের বিখ্যাত ব্রিটিশ সিভিল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ইসমবার্ড ব্রুনেলের নকশায় তৈরি। জনসাধারণের জন্য এই ব্রিজ খুলে দেওয়া হয় ১৮৬৪ সালে। ইসমবার্ড ব্রুনেলের কথা যখন উঠলই, তখন বলে রাখা ভালো যে ব্রুনেল তাঁর পিতা মার্ক ব্রুনেলের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ১৮৪১ থেকে ১৮৪২ পর্যন্ত কাজ করেন টেমস নদীর নিচ দিয়ে যাওয়া ব্রিটেনের প্রথম টানেলের, যা পূর্ব লন্ডনের রদারহিথ ও ওয়াপিংকে সংযুক্ত করেছিল।
ব্রুনেলের তৈরি বিখ্যাত ক্লিফটন ব্রিজ থেকে হোটেলে ফেরার সময়ও থেকে গিয়েছিল সেই ঘোর লাগা আবেশ। যে আবেশ দানা বাঁধা শুরু করেছিল বিখ্যাত সেন্ট ম্যারি র্যাডক্লিফ চার্চের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা অসাধারণ শিল্পকর্ম দেখে এবং তা আরও পূর্ণতা পায় ব্রিস্টল ক্যাথিড্রালের ভেতরে প্রতিধ্বনিত অর্কেস্ট্রার সুরে।
তবে সব সৌন্দর্যের মধ্যেও থাকে কিছু রক্তে পিচ্ছিল অন্ধকারের গল্প। ব্রিস্টলের সেই কালো অধ্যায় হলো এই শহরের হারবারে দাস বিকিকিনির ইতিহাস। জানা যায় সতেরো শ এবং আঠারো শ শতকে শুধু এই বন্দর দিয়েই জাহাজ ভরে প্রায় পাঁচ শ হাজার আফ্রিকান দাস নিয়ে আসা হয়। যাদের দিয়ে সেসব কাজ করানো হতো, যা তৎকালীন ব্রিটিশরা করতে চাইত না। শুধু ব্রিটেনেই নয়, তৎকালীন বিশ্বে প্রায় সব শক্তিধর শাসকেরাই এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; যার নিদর্শন রোমান, কনস্টাইনটেন, অটোম্যান, মোগল, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ কিংবা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস পাঠ করলে জানা যায়। এই অঞ্চলের দাস ক্রয়–বিক্রয়ের হোতা ছিলেন এডওয়ার্ড কোলস্টোন।
২০২০ সালে বিশ্বজোড়া ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের অংশ হিসেবে এই কোলস্টোনের ভাস্কর্য ব্রিস্টল হারবারের জলে নিক্ষেপ করেন উত্তেজিত অধিকারকর্মীরা। স্লেভ ট্রেইডের ট্রেইল এবং ছোট ছোট গল্পগুলো পড়ছিলাম ব্রিস্টল ক্যাথিড্রালের একটি ওয়ালে। তবে দাসপ্রথার কালো অধ্যায় নিয়ে ব্রিস্টলের সেই বিশাল মিউজিয়াম অদেখা রয়ে গেল।
আরও অদেখা থেকে গেল ব্রিস্টলের ভারতবর্ষের অন্যতম দার্শনিক, সমাজসংস্কারক রামমোহন রায়ের স্মৃতিমিনার। যিনি ব্রিটেন ভ্রমণের সময়ে কঠিন মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ব্রিস্টলের কাছের স্টেপল্টনে ১৮৩৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কিছু জিনিস অদেখা রাখতে হয়, তাতে সেসব জায়গা পুনঃভ্রমণের একটা সুযোগ থাকে। আবার এসব জায়গা অন্যের চোখে দেখারও সম্ভাবনা থাকে। যেমন ব্রিস্টলের বাকি গল্প শুনব প্রিয় শেখ সাইফুর রহমানের কাছ থেকে।
ছবি: লেখায়