সকালের মিষ্টি রোদ পিঠে নিয়ে খামারবাড়ির টানাবারান্দায় অলস বসেছি মাত্র। মৌরি আপুর হাতে মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উডস’ তো আমার চোখ মুজতবা আলীর ‘চাচা কাহিনী’র পাতায়। কফি–মগের ধোঁয়ার কুণ্ডলী বাতাসে একটা ছুটি-ছুটি ঘ্রাণ ছুটিয়ে দিচ্ছে। এই সুখ বেশিক্ষণ সইল না। হাদি ভাই আর রুমি মিলে হইহই জুড়ে দিল আজও কোথাও বেরোবে বলে। ছানারাও তাল মিলিয়ে রইরই করে উঠল। আমাদের চিঁচিঁ ক্ষীণ আপত্তির মুখে তাৎক্ষণিক একটা এলোমেলো ভোটাভুটি হলো। ‘আলসে পার্টি’ (আপা) বনাম ‘বাপ-ছেলের দল’ (বাছেদ)। অতর্কিত রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পেরে আপারা পরিষ্কার দুই ভোটের ব্যবধানে বাছেদের কাছে হেরে গেলেন। অগত্যা বইয়ের ভাঁজে বুকমার্ক গুঁজে নেহাৎ অনিচ্ছায় পায়ে চপ্পল গলালাম দুই পরাজয়ী।
আধঘণ্টার মাথায় অবশ্য পরাজয়টা অত খারাপ ঠেকল না। পাহাড়ের মাথায় জায়গাটার নাম গিডিয়ন্সয়েক। তার একটা বড় অংশ ঘিরে গাছগাছালিতে ছাওয়া ছিমছাম রেস্তোরাঁ। আরামের এমন চমৎকার ব্যবস্থা দেখে চেয়ার টেনে গ্যাট হয়ে বসে পড়লাম গাছের ছায়ায়। ওয়েটারকে ইশারা দিতেই কফি চলে এলো। সুড়ুৎ চুমুকে খামারবাড়ির আলসেমিটা ফিরিয়ে আনলাম এক ঝটকায়। দূরে দৃষ্টি ছুড়ে দিলাম। পাহাড়ের গায়ে ছককাটা আঙুরের খেত বা ভিনিয়ার্ড। আকাশে মেঘ-রোদের লুকোচুরি ভিনিয়ার্ডের বুকে আলো–ছায়ার খেলা হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে।
আঙুরের খেত ঢালু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে নেমেছে নদীর ঘোলা জলে। মাতাল হাওয়ায় পাল তুলে রাইনের ঢেউ এই পথজুড়ে বয়ে গেছে দীর্ঘ ৬৫ কিলোমিটার। রাইনের বেঁকে চলা নিখুঁত সুডৌল বাঁক যেন লাস্যময়ী লোরেলাইকেও হার মানায়। মাঝনদীতে ভিনিয়ার্ড সমেত গোলাকার বোপার্ড শহর ঝিনুক-খোলা মুক্তার মতোই জ্বলজ্বল করছে। ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তালিকায় রাইনভ্যালির নাম থাকার কারণটা বেশ বোঝা গেল এই গিডিয়ন্সয়েক থেকে।
রাইনের অলক ইশারা আর উপেক্ষা করা গেল না। গিডিয়ন্সয়েক থেকে গড়িয়ে নেমে সোজা চেপে বসলাম মাঝারি সাইজের জাহাজে। নিস্তরঙ্গ নদীতে বিলাসী নৌবিহার না করলে আর চলছে না। বাচ্চাদের বাছেদ পার্টির সিনিয়র দুই সদস্যের কাছে গছিয়ে দিয়ে কাছ থেকে আমরা দুই আপা সটকে পড়লাম রিভার ক্রুজের নিরিবিলি এক কোণে।
বেশ আয়েশ করে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছি কাঠের বেঞ্চে। হালকা খিদে পেয়েছে। মৌরি আপুর সঙ্গে টুকটাক ফলমূল থাকে। খিদের কথা শুনে তাঁর থলে থেকে কমলা আর কলা উঁকি দিল। এদিকে জাহাজের স্পিকার কড়কড় শব্দে জ্যান্ত হয়ে উঠেছে, ‘রাইনের জলরাশিতে স্বাগত। এবার আপনাদের শোনাব রাইনভ্যালির ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গল্প।’ খিদে পেটে ইতিহাসে রুচি হলো না। তার বদলে কমলার খোসা ছাড়াতে লাগলাম গভীর মনোযোগে। মৌরি আপুও গম্ভীর মুখে কলা চিবাতে লাগলেন।
বাতাস কেটে আমাদের প্রমোদতরি তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নদীর দুই ধারে প্রাচীন কেল্লা, প্রাসাদ আর দুর্গের ছড়াছড়ি। রাইনের পথে সেই আমলে মালবাহী জাহাজ যেত-আসত বেশুমার। খাজনা-টোল বাবদ টাকা আদায় হতো তেজপাতার মতোই সের কে সের। পেল্লায় কেল্লা বানানো তাই বোধ হয় নেহাত ছেলেখেলা ছিল।
স্পিকারে ঘ্যানঘ্যানে স্বরে ভাঙা রেকর্ড বেজে চলেছে তখনো। হঠাৎ ইঁদুর-বিড়াল দুর্গের প্রসঙ্গ আসতেই কান খাড়া হয়ে গেল। বোপার্ডে আসা অবধি নামগুলো খুব শুনছি। কমলার শেষ কোয়া মুখে পুরে কেচ্ছা শুনতে লেগে গেলাম।
ঘটনা সেই ৯৭৪ সালের। সত্য কি মিথ্যা, কেউ জানে না। এই এলাকার লোককাহিনি আর কি। ইঁদুর কেল্লা বা মাউস টাওয়ার তখন খাজনা আদায়ের অফিস। জার্মানির মাইঞ্জ শহরের আর্চবিশপ, নাম তাঁর ‘হাতো’। তিনি তখন সেই অফিসের দায়িত্বে। নাম হাতো হলে হবে কী, তাঁর হাত ছিল বেজায় কঞ্জুস। সেবার দুর্ভিক্ষ হলে এই হাড়কিপটে সব গম-ভুট্টা গুদাম করে ফেলল। বেশি দামে ধনীদের কাছে বেচবে বলে। ওদিকে গরিবের দল একদিন হল্লা করে জমায়েত হলো গুদামের সামনে। তাদের শস্যের ভাগ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে চুপিসারে খড়ের গাদায় আগুন দিল হাতোর বাহিনী। নির্দোষ মানুষগুলো জ্যান্ত পুড়ে মরে গেল চোখের সামনে। সেই আর্তনাদ শুনে হাতো ক্রূর হেসে বললেন, ‘হ্যাহ্, যত্তসব ইঁদুরের কিচিরমিচির!’
ঘটনার সেখানেই শেষ না; বরং শুরু। আচমকাই একটা-দুটো করে শ খানেক, তারপর হাজারে-বিজারে ইঁদুরের পাল এসে পঙ্গপালের মতো ছেঁকে ধরল হাতো সাহেবকে। পালিয়ে বাঁচতে নদী পার হয়ে তিনি তাঁর খাজনা আদায়ের কেল্লায় আশ্রয় নিলেন। ওদিকে ইঁদুরের দল পিছু ছাড়ল না। তারা সাঁতরে নদী পেরিয়ে হাঁচড়ে–পাঁচড়ে কেল্লার উঁচু দেয়াল খামচে উঠে পড়ল পিলপিল করে। তারপর হাতোকে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল উম্মাদ খিদে নিয়ে। রক্ত হিম করা কিচিরমিচির শব্দে কেঁপে উঠল কেল্লার অন্দর। আর সেই থেকে এর নাম হলো ইঁদুর-কেল্লা।
রোম খাড়া হওয়া গল্পটার রেশ না কাটতেই বিড়াল দুর্গের কাহিনি শুরু হলো। কিন্তু তা আর শোনা হয়ে উঠল না। স্পিকার থেকে গোঙানির মতো ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে। গল্পের আশা ছেড়ে বরং পাহাড়, নদী, কেল্লা আর মেঘমল্লার দেখতে লাগলাম নির্বিকার।
মৃদু ধাক্কা তুলে ঘাটে এসে ভিড়ল আমাদের রিভার ক্রুজ। নৌবিহারের পাট চুকিয়ে চললাম রাইনস্টাইন দুর্গ দেখতে। রাইনের দুই পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়ানো–ছিটানো শুধু কেল্লা আর দুর্গ। এই যেমন ঘাট বরাবর জেব্রা ক্রসিংটা পার হলেই রাইনস্টাইনের সিঁড়ি। জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে নূর আর তাফসু মিয়া এক বানর–লাফে মিলিয়ে গেল দুর্গের কোনো গহিনে। ও নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম ১৩ শতকের এই বিচিত্র স্থাপনা।
ইট-পাথর ছাপিয়ে প্রথমেই মন কেড়ে নিল প্রকাণ্ড এক ফুলের বাগান। বেগুনি ল্যাভেন্ডার আর গোলাপি ওলিয়েন্ডারের ঝোপ চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। নানা ফুলের জাত আগুন লাগিয়েছে এই কোণ-ওই কোণে। লতানো গুল্ম যেন মাথার ওপর শামিয়ানা খাটিয়েছে অতিথিরা আসবে বলে। মাটি থেকে অনেক উঁচুতে এই শূন্য উদ্যানের নাম ‘বার্গেন্ডি গার্ডেন’। লাল আঙুরের খেত, ‘বার্গেন্ডি ভাইন’ দেখা যায় নদীর ওধারে। তারই নামে নাম এই ঝুলন্ত বাগানের।
রোমান্টিক আবহটা গুবলেট করে দিয়ে ভেড়ার ডাক ভেসে এল—‘ম্যা, ম্যা, শিগগির এদিকে...!’ বাঁ দিকে নাইটস হল। ডাক আসছে ওদিক থেকেই। সেকালের সৈন্য-সামন্তের বর্ম-তলোয়ার সাজানো এ ঘরে। তাফসু মিয়া আর নূর মিয়া তরবারি ভেঙে দাঁড়িয়ে আছে কি না, কে জানে। আবছা আঁধারে ঢাকা বিরাট হলঘরে ঢুকতেই লাল-নীল আলোর ছটায় অভিভূত হলাম। রঙিন কাচের নকশা ছাদ-ছোঁয়া জানালায়। গথিক আমলের গির্জার সাজ। আবার মনে হলো ডিসকো হলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে আলো নাচছে ঘুরে ঘুরে।
কিন্তু সম্বিত ফিরল তাফসু মিয়ার ব্যাকুল ডাকে। তার হাতে একটুকরা ধাতব পাত। আবিষ্কৃত হলো সৈন্যের বর্ম ধরে ঝাঁকাঝাঁকি করতে গিয়ে খুলে এসেছে পটাং। তা–ও আবার ঊরু বরাবর এক বেজায়গা থেকে। জোড়া দিতে গিয়ে সৈনিকের আরও মানহানি ঘটতে পারে। তাই টুকরাটা আস্তে করে পায়ের কাছে রেখে বেরিয়ে এলাম নাইটস হল থেকে।
প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে একেবারে ওপরের মিনারটায় উঠে এলাম। দিগন্তজুড়ে রাইন আর রাইন। কত অতীত আর বর্তমানের সাক্ষী হয়ে আছে এই নদী। না জানি আরও কত অজানা লুকিয়ে তার জলের অতলে। ডুবুরি বেশে একবার দেখে আসতে পারলে মন্দ হতো না। ইতস্তত ভাবনায় ছেদ পড়ল হাদি ভাই আর রুমির ডাকাডাকিতে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রাইনস্টাইনের চূড়ায় সূর্য ডুবিয়ে সেদিনের মতো খামারবাড়ির পথ ধরলাম সবাই মিলে।
পরদিন। আজকেও দুর্গ দর্শনে বেরোচ্ছি। এ কয়দিন ডজন ডজন দুর্গ ঘুরে রীতিমতো দুর্গেশনন্দিনী বনে গেছি। কিন্তু আজ বোধ হয় মৌরি আপুকে হাতিটানা দিয়েও ঘর থেকে বের করা যাবে না। ‘নরওয়েজিয়ান উড’ আগলে ঝিম মেরে বসে আছেন। সুতরাং তাঁকে আর না ঘাঁটিয়ে হাদি ভাই আর নূরকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
কেল্লার নাম এরেনবুর্গ। পাহাড়ের মাথায় প্রায় ২৫০ মিটার উঁচুতে ঘন জঙ্গলের মাঝে ইট-কাঠ সমেত বেখাপ্পা দাঁড়িয়ে। লোকালয় থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। দীর্ঘ সাঁকো পেরিয়ে ফটকে পৌঁছাতে হলো। সাড়ে ৮০০ বছরের পুরোনো এরেনবুর্গ নাকি প্রতি রোববার আর ছুটির দিনগুলোতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আজও রোববার। দেখাই যাক কী ঘটছে দরজার ওপাশে। কৌতূহলী উঁকি দিতেই যেন পিছিয়ে গেলাম ৫০০ বছর। লোকজন ঢিলেঢালা ঝুল দেওয়া কাপড় পরে ঘুরছে। কারও কোমরে তলোয়ার কিংবা পিঠে তির-ধনুক। এ যেন এক টাইম ক্যাপসুল।
কাউন্টারে টিকিটের টাকা রেখে হাতে কতগুলো ধরিয়ে দেওয়া হলো বেঢপ সাইজের গোল গোল চাকতি। এগুলো নাকি মধ্যযুগীয় মুদ্রা। হালের ইউরো-ডলার এই এরেনবুর্গে অচল। স্যুভেনির কিনতে বা কিছু খেতে হলে এই মুদ্রাই ভরসা।
যাহোক, পায়ে পায়ে এগোতেই কুমারশালার দেখা মিলল। মাটির হাঁড়িকুড়ি নিয়ে এক বুড়ো বসে আছেন। তাঁর পায়ের কাছে অতিকায় এক জার্মান শেপার্ড আধঘুমে। পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু বুড়ো হেঁকে বললেন, ‘এই হাঁড়িটা নেবে নাকি? কাঁচা আলু ছুড়বে আর সেদ্ধ আলু তুলবে। দুই মুদ্রায় ছেড়ে দেবো, নিয়ে যাও।’ হাঁড়ি বগলে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা নেই। তাছাড়া, ভেতো বাঙাল। আলুর প্রতি প্রেম সীমিত। অতএব বিনয়ের সঙ্গে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম।
কুমারশালার উল্টো দিকেই কামারশালা। সেখানে হাতুড়ি-বাঁটালি ঠুকে কাজ করছেন শক্ত চোয়ালের একজন লম্বা-চওড়া লোক। কাঠের তক্তার ওপরে এক ডাঁটা গোলাপ রাখা। পুরোটাই লোহার তৈরি। দেখে তারিফ করতেই হলো। তবে লোকটা গোলাপ কিনতে সাধলেন না; বরং বাঁশের কঞ্চির মতো কী যেন একটা ধরিয়ে দিলেন। এক পাশ ফালি করে কাটা দেখে ঝাড়ু-ঝাঁটার মতো দেখাচ্ছে। বললেন ‘যাও, তোমাকে এটা উপহার দিলাম। খুব কাজের জিনিস, বুঝলে। যেমন পিঠ চুলকানো যায়, তেমনি স্যুপ নাড়াতেও দুর্দান্ত।’ বলেই সেটি দিয়ে পিঠ চুলকে একটা হ্যান্ডস অন ডেমো দেখিয়ে দিলেন। আরেক হাত উঁচিয়ে বললেন, ‘ওই দেখো চুলায় স্যুপ চাপিয়েছে।’ তাকিয়ে দেখি, অদূরেই ছাউনির নিচে কেউ একই রকম নাড়ানি দিয়ে হাঁড়ি নাড়ছে। সামনে লম্বা লাইন। লোকে কয়েন ফেলে বাটি ভরে স্যুপ নিয়ে যাচ্ছেন। রাঁধুনির উশখুশ চেহারা দেখে মনে হলো, ফাঁক পেলেই সে পিঠ চুলকে নেবে একটু। আজ আর যা–ই হোক, স্যুপ খাওয়া যাবে না দেখছি।
এর মাঝে ট্যুর গাইড চলে এসেছে। ছোট দলে ভাগ হয়ে দুর্গের অন্দরমহল ঘুরে দেখা শুরু হলো। কামরাগুলো গুহার আদলে বানানো। আরাম-আয়েশের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ভার। রাইনস্টাইনের সঙ্গে বিরাট ফারাক এরেনবুর্গ দুর্গের। তবে এই বনজঙ্গলের ভেতরে বিলাসের উপকরণও বা মিলবে কোথায়। এ ঘর-ও ঘর পেরিয়ে খোলা ছাদে এসে পৌঁছালাম। এক প্রান্তে বিচিত্রদর্শন একটি কামান পড়ে আছে। সেকালের গুলতি-কামান। ধাতব গোলা কাঠের তক্তার এক মাথায় বেঁধে উড়িয়ে মারা হতো দূরনিশানায়। শত্রু এসে এরেনবুর্গ দখলে নিতে চাইলে এই গোলার আঘাতে ভর্তা করে দেওয়া হতো একেবারে। আর যদিবা এই রক্ষাবূহ্য ভেদ করে কোনোমতে দুর্গে পৌঁছে যেতই, তাহলে বোধ হয় নাড়ানি দিয়ে বেশ করে পিঠ চুলকে স্যুপ বানিয়ে খাইয়ে দেওয়া হতো জামাই আদরে।
দুপুর নামিয়ে এরেনবুর্গ থেকে ফিরতি পথ ধরলাম। বাকি দিনটা খামারবাড়িতে গল্প-গুজবে কাটানো যাবে। আজই শেষ দিন। কাল শহুরে মানুষ আবার শহরপানে ছুটব।
খামারবাড়ির আঙিনায় বাকিদের পাওয়া গেল। খরগোশের কান মুলছে নুর, মৌরি আপু খামারবাড়ির মালিকের সঙ্গে গল্পে মজেছেন আর হাদি ভাই ‘চাচা কাহিনী’র পাতা ওলটাচ্ছেন বারান্দায় আধশুয়ে। এই না হলে ছুটি। ছুটির স্বাদ আরও বাড়ল যখন খামারবাড়ির মালিক ভদ্রলোক দড়ি ধরে দুটো টাট্টু ঘোড়া নিয়ে এলেন। মাথায় হেলমেট চাপিয়ে নূর আর তাফসু মিয়া তাতে পাকা ঘোড়সওয়ারের মতো লাফিয়ে চড়ে বসল। আর আমরা চললাম পিছু পিছু।
পথের পাশে গাছের গায়ে এক-আধটা নীল-হলুদ নিশানা সাঁটা। দেখতে অনেকটা ঝিনুকের মতন। জিজ্ঞাসু চেহারা দেখে হাদি ভাই জবাব জোগালেন, ‘এই হলো “ইয়াকবস ভেগ” (Jacobsweg)। মানে “ইয়াকুবের রাস্তা”। সেন্ট ইয়াকুব বা জ্যাকবের আরেক নাম সেন্ট জেমস। এই নীল-হলুদ ঝিনুক-ছাপ তারই প্রতীক।’ হাদি ভাই আমাদের ভ্রাম্যমাণ উইকিপিডিয়া। দলের ভেতর একজন এমন সবজান্তা থাকা জরুরি। তিনি গড়গড়িয়ে বলে চললেন আর আমরা চোখ গোল গোল করে শুনতে লাগলাম।
‘সেন্ট জেমস ছিলেন যিশুখ্রিস্টের ১২ শিষ্যের একজন।
ওই যে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘লাস্ট সাপার’ ছবিতে যে ১২ জন ছিলেন, তাঁদেরই একজন। এই সেন্ট জেমস মারা যান এক ইহুদি রাজার হাতে। তাঁকে সমাহিত করা হয় স্পেনের সান্তিয়াগো দে কম্পোস্তিলায়। জায়গাটা সারা দুনিয়ার খ্রিষ্টানদের তীর্থস্থান। এই ঝিনুক-ছাপ দেওয়া পথ ধরে লোকে হেঁটে তীর্থে যান। বেশ কয়েকটা দেশের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথটা। দীর্ঘ এই যাত্রার নাম ‘কামিনো দে সান্তিয়াগো’। অনেকে ছোটো করে বলেন শুধু ‘কামিনো’। আমাদের গুগল, হাদি এক নিশ্বাসে সব বলে ব্রেক চাপলেন এবার।
কামিনোর গল্প শুনে দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। তাফসু মিয়া বা তার বাবা কখনো বেশি ঘ্যাঁওম্যাঁও করলে পুঁটলি একটা কাঁধে ফেলে কামিনো রওনা দিতে হবে কিছুদিনের জন্যে। তীর্থযাত্রা হলো সব সাংসারিক সমস্যার সমাধান।
সন্ধ্যা নেমেছে। ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গলে ছাওয়া কামিনো পথটা ভুতুড়ে দেখাছে আবছা আঁধারে। আর না এগিয়ে আমরা উল্টো ঘুরলাম। খামারবাড়ি পৌঁছে অল্পের ভেতর খাদ্যপর্ব চুকিয়ে আমরা ঝুলবারান্দায় চুটিয়ে আড্ডায় বসেছি। এমন চাঁদের আলোয় ভূতের গল্প ফাঁদতে হয়। বাতাসে গাছের পাতা নড়ে উঠলে, কী একটা চামচিকা দৌড়ে পালালে ভয় জমে ক্ষীর একেবারে। সেটা বুঝতে পেরেই বোধহয় কালো একটা হুলো বিড়াল টপ করে কোলে উঠে এল। তুলতুলে পিঠে আলতো হাত বোলাতেই ভোঁশ ভোঁশ নাক ডাকা শুরু হলো। কিন্তু ভূতের গল্পে না মজে আমরা হানা দিলাম হাদি ভাইয়ের ক্যাডেট স্কুলের স্মৃতির পাতায়।
ক্লাসের ঘণ্টা পড়েছে। অথচ বাংলা স্যারের দেখা নেই। এই ফাঁকে ক্লাসের পাঁজি ছেলে ব্ল্যাক বোর্ডে বড় বড় হরফে লিখেছে, ‘পামোশ— পাছা মোটা শয়তান।’ ছাত্র-শিক্ষকের ভেতরে কার উপাধি এই ‘পামোশ’ ঠিক বোঝা গেল না। তবে কারও তো বটেই। হঠাৎ ক্লাসের বাইরে ভূমিকম্প তুলে থপ থপ পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো। স্যার আসছেন। পামোশ-কাণ্ড ধরা পড়লে চিকন সপাং বেতের ঘায়ে আজকে কেয়ামত নিশ্চিত। পাঁজিতে-হাজিতে ফারাক হবে না। অবস্থা বেগতিক দেখে জরুরি টিমওয়ার্কে নামল কয়েকজন ক্যাডেট। এরা বাংলায় ক্ষুরধার।
নিমেষেই চৌকস সাহিত্যজ্ঞানের কল্যাণে ‘পামোশ—পাছা মোটা শয়তান’ বদলে হলো ‘পমোশ—পরাজয় মোদের শক্তি।’ জটলা দেখে স্যার বাজখাঁই হাঁক দিলেন, ‘অ্যাঁও! হচ্ছেটা কী?।’ কেউ সাহস করে বলে উঠল, ‘স্যার, এই ক্লাসের ক্যাডেটদের নতুন স্লোগান, ‘পরাজয় মোদের শক্তি—পমোশ!’ বাকিরা গলা চড়িয়ে ধুয়া তুলল, ‘পমোশ, পমোশ!’ স্যার চওড়া হাসিতে শুধালেন, 'স্লোগান জব্বর হয়েছে রে। তোরা দেখছি জাত ক্যাডেট। নে, এবার বই খোল...।’
চায়ের কাপে টলটলে চাঁদ ভাসছে। আমাদের আড্ডা এগিয়ে চলছে তুমুল উচ্ছ্বাসে। আর হৈহুল্লোড়ে কোলের হুলোটা যে কখন পালিয়েছে, কে জানে। (সমাপ্ত)
লেখক: ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার জার্মানির মিউনিখে
একটি ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সংস্থায় মেডিক্যাল রাইটার হিসেবে কর্মরত
ছবি: আহমেদ রুমি