এভারেস্ট বেজক্যাম্পে বিয়ে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

কী পরব, এটা নিয়ে খানিক দোটানা। লাদাখিদের কৌশল অবলম্বন করব কি না, ভাবছিলাম। ভারতের লাদাখ অঞ্চলে খুব শীত পড়ে বলে লাদাখিরা কয়েক পরতের জামা পরে। সবচেয়ে ভালো জামাটা ওরা সাধারণত সবার ভেতরেই নাকি পরে আর খারাপ জামাটা পরে বাইরে। আর কোনো পার্বণ হলে উল্টে দেয় ক্রম। তুষারপাতের তীব্রতায় অবশ্য বেশ অনেকগুলো জামাই পরে আছি। ওলটপালটের ঝামেলায় আর গেলাম না।

পরিচয় হলো বর মারেক আর কনে আগার সঙ্গে। বিখ্যাত পর্বতারোহী জর্জি কুকোঝকার দেশ পোল্যান্ডের বাসিন্দা দুজনেই। কনে আগা পছন্দ করে পাহাড়। তাই হিমালয়ের গহন লোককে বেছে নিয়েছে বিয়ের ভেন্যু হিসেবে। আমি খুঁজছি মন্ত্রপড়ুয়া লামাকে। ধর্মা জানাল, লামা গতকালই আমাদের ক্যাম্পে এসেছে। পরে বুঝতে পারলাম, সকালে যার সঙ্গে কিচেন টেন্টে বসে তিব্বতি নুন–চা খেলাম, সেই লা স্পোর্টিভার জুতো পায়ে আর গোর-টেক্সের জ্যাকেট গায়ে গোলগাল দেখতে লোকটাই লামা।

সকালের নাশতার পরেই শুরু হলো বিয়ের অনুষ্ঠান। বরযাত্রীর বদলে বিয়েতে উপস্থিত হলাম আমরা পর্বত অভিযাত্রীরা! উষাদি, হাভিয়ের আর আমি; সঙ্গে সাতোরি অ্যাডভেঞ্চারের এক পোলিশ ক্লাইম্বার। এ ছাড়া আছে মারেক আর আগার সঙ্গে থাকা গাইড ও পোর্টার। আমরা এই কয়জনাই বিয়ের সাক্ষী। আমাদের কিচেন স্টাফরা ব্যস্ত বিয়ের জন্য নানান জিনিস জোগাতে।  

বিজ্ঞাপন

বেজক্যাম্পে পুজোতে যেমন সাম্পা ময়দার তৈরি কেক বানানো হয়েছিল, এখানেও ঠিক একই রকম কেক আগেই বানিয়ে রেখেছে কুক পেম্বা দাই। এখানে বলে রাখি, নেপাল-ভারত হিমালয়ের যেকোনো পর্বত অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই বেজক্যাম্প পুজো। মাউন্টেন গডের উদ্দেশ্যে নিরাপদে আরোহণের জন্য দেওয়া হয় এই পুজো। শেরপা-তামাং জনগোষ্ঠীর সদস্যরা এই পুজো না হওয়া অবধি বেজক্যাম্প ছেড়ে ওপরের ক্যাম্পে যায় না।

ভারী তুষারপাতের কারণে বাইরে না হয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে তাঁবুর ভেতরেই। বেদি বানানো হয়েছে বিস্কুটের একটা খালি কার্টনের ওপর। ক্রিম ক্র্যাকার্সের বোতল আড়াআড়ি করে সেখানে রাখা হয়েছে পুজোর অন্যতম উপসর্গ চাল। এ ছাড়া টেবিলের সামনে ভগবান তথাগতর উদ্দেশে নানান সামগ্রী ইতিমধ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে। আছে জুনিপারের ডালও। এই গাছের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এতে কাঁচা অবস্থায়ও অতি উত্তম আগুন ধরানো যায়। বেজক্যাম্প পুজোতে যে একটা বড় বই দেখে মন্ত্র পড়েছিলেন লামা, এখানেও অনেকটা তাই। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এক হাতে ঘণ্টি আর অন্য হাতে মহাদেব শিবের ডমরুর মতো দেখতে এক বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন লামা। আর ডমরুতে বোল তুলতে তুলতে বলে উঠছেন, ‘উমা, উমা।’ হিমালয়-দুহিতা ও শিব-জায়া ‘দুর্গা’-কেই কি বারবার স্মরণ করছেন এই গিরিলোকে?

তিব্বতি ভাষার টেক্সট পড়ার সময় হাতের জপমালাও ঘুরছে অবিরত। ট্রেকিং বুট, ডাউন প্যান্ট আর উইন্ডচিটারে পরিবৃত হয়ে বেজক্যাম্পে আসা বর-কনের গায়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী শেরপা পোশাক। বরের ওই চুড়োওয়ালা টুপি আমার ভারি পছন্দ হলো। ভালোমতো জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে অমন টুপি কোথায় পাওয়া যায়। বিয়ে এই জীবনে না হোক, বিয়ের টুপি অন্তত সংগ্রহে থাকুক! মন্ত্রের ফাঁকে ফাঁকে চলছে চাল ছিটানো। হাতে হাতে ঘুরে আমাদের মুঠোতেও উঠে আসছে চাল। বর-কনে অনুষ্ঠানের বড় অংশজুড়েই হাতে হাত রেখে বসেছিল। তবে ঠান্ডার তীব্রতা বাড়তেই দুজনে দুখানা উলের টুপি হাতের মুঠোয় নিয়ে তালু গরম করতে লাগল। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকেই চলছে চা–পান। প্রথম পর্ব শেষ হতেই নানান ধরনের খাবারসহ থালি টেবিল থেকে আমাদের সামনে চলে এল।

আরেক দফা চায়ের পর লামা জানালেন, এবার বিয়ের মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে! তাহলে এতক্ষণ ধরে কী হলো? জানলাম, এতক্ষণ সৃষ্টিকর্তার নিকট নবদম্পতির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। অবশ্য মূল বিয়ের অনুষ্ঠান বেশ সংক্ষিপ্তই হলো। সাম্পার তৈরি কেক একে অপরকে খাইয়ে দিল বর-কনে। দুজনের জন্য এল সুপের বাটিভর্তি চা। সেটাতে চুমুক দিয়ে একে অপরের কপালে এঁকে দিল তিলক। বর-কনেকে খাদ পরিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করলেন লামা। পরের ধাপে বর-কনে তিনবার মাথা নত করলেন। এরপর বিবাহ পড়ানো বাবদ লামা পেলেন তাঁর পারিশ্রমিক। বর-কনের কাছ থেকে পৃথকভাবে, তা–ও আবার ইউএস ডলারে। এদিকে তুষারপাতের বিরাম নেই। সাবুদানার মতো ঝরেই যাচ্ছে। রাতে বিবাহ উপলক্ষে আনা কেকের অংশ পেলাম আমরা। নামে কেক হলেও স্বাদ একেবারে পেস্ট্রির মতোই। নববিবাহিত দম্পতির স্থান হলো আমার পাশের তাঁবুতে।

ছবি: বাবর আলী

বিজ্ঞাপন
প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪, ১৫: ০০
বিজ্ঞাপন