মমার্ত পাহাড়ের চূড়া থেকে নটর ডেম গির্জার চাতালে ২
শেয়ার করুন
ফলো করুন

১৮৭০ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে পরাজয়ের পর ফ্রান্সের জনগণ স্বাভাবিকভাবেই মুষড়ে পড়ে। তৎকালীন বিশপ ফুর্নিয়ার এই পরাজয়ের জন্য দায়ী করেন ফ্রান্সের জনগণের নৈতিক পদস্খলন ও ধর্মহীনতাকে। তাঁদের উদ্দীপ্ত করার জন্যই সেক্রেকার ব্যাসিলিকা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮৭৫ সালে। বিখ্যাত ফরাসি স্থপতি পল আবাদি ইস্তানবুলের সেইন্ট সোফিয়া ও ভেনিসের সান মার্কো গির্জার ডিজাইন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সেক্রেকারের ডিজাইন করেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, জীবদ্দশায় তিনি গির্জার প্রতিরূপ দেখে যেতে পারেননি। পল আবাদি মারা যান ১৮৮৪ সালে। তাঁর মৃত্যুর পর ৫ জন স্থপতি নির্মাণকাজ এগিয়ে নিয়ে যান এবং ১৯১৪ সালে কাজ শেষ হয়। কিন্তু সে বছরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় গির্জাটি উদ্বোধন হতে ১৯১৮ সাল লেগে যায়।

মেরি দি সেন্তোয়ার শান্ত শহরতলীর দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি
মেরি দি সেন্তোয়ার শান্ত শহরতলীর দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি

রোমানো-বাইজেন্টাইন স্থাপত্যরীতির এই ব্যাসিলিকায় ব্যবহার করা হয়েছে ‘ট্রাভারটিন’ নামের এক বিশেষ ধরনের পাথর। এই একই পাথর ব্যবহার হয়েছে আর্ক ডি ট্রায়াম্ফ ও আলেকজান্ডার থ্রি সেতু নির্মাণে। এই পাথরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ভেতরে পানি প্রবেশ করতে পারে না। শুধু তা–ই নয়, এই পাথরের ওপর বৃষ্টির পানি পড়লে ‘ক্যালসাইট’ নামের বিশেষ পদার্থের নিঃসরণ ঘটে, যা কিনা পাথরের সাদা রংকে অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি জাজ্জ্বল্যমান রাখে। তাই সূর্যালোকের প্রতিফলনে অনেক দূর থেকেও এই গির্জা ঝকঝকে দেখায়। এই সৌন্দর্যের জন্যই প্রতিবছর ১০ মিলিয়নেরও বেশি দর্শনার্থী এখানে পদধূলি দেন। এর থেকে বেশি দর্শনার্থী (১৩ মিলিয়ন) কেবল নটর ডেম ক্যাথেড্রাল দর্শন করে থাকেন।

বিজ্ঞাপন

এমনিতে গির্জায় প্রবেশে ফি লাগে না। তবে টাওয়ারে উঠতে চাইলে টিকিট কাটতে হয়। মিনিট পাঁচেক লাইনে দাঁড়ালেই মূল গির্জায় প্রবেশের অনুমতি মেলে। প্রবেশদ্বারের ওপর জোয়ান অব আর্ক ও রাজা নবম লুইয়ের ঘোড়ায় চড়া মূর্তি দণ্ডায়মান। সাদা গির্জার পটভূমিতে পান্না সবুজ রঙের ভাস্কর্য দুটি আলাদাভাবে চোখে পড়ে। ভেতরে প্রবেশের পর চমৎকৃত হতে হয়। কি সুন্দর অন্দরসজ্জা। এমনভাবে গির্জাটি তৈরি হয়েছে যেন ভেতরে সূর্যালোকের অভাব না হয়। মূল গম্বুজ দিয়ে আলো আসছে বেশি। সেই আলোয় উদ্ভাসিত ক্রুশে বিদ্ধ যিশু এবং তাঁর পাশে লোহার শিরস্ত্রাণ হাতে দুই দেবদূত। প্রার্থনাবেদির ওপরের ছাদে চমৎকার মোজাইকের ফ্রেসকো আঁকা। ৪৭৫ বর্গমিটার আয়তনের এই ফ্রেসকো পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মোজাইক নির্মিত চিত্র। সাদা পোশাক পরা যিশুখ্রিষ্ট দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন। যিশুর হৃৎপিণ্ড থেকে সোনালি আভা ছড়াচ্ছে চারদিকে। সেই আভায় উদ্ভাসিত তাঁর সহচরেরা।

নতরদাম গির্জার প্রবেশপথে আছে সূক্ষ্ম কারুকাজ
নতরদাম গির্জার প্রবেশপথে আছে সূক্ষ্ম কারুকাজ

গির্জাজুড়েই ছোট কিন্তু সুন্দর সব ভাস্কর্যের সমাহার, যাদের বেশির ভাগই সাধুসন্ত কিংবা দেবদূত। গির্জার একটা ছোট্ট প্রতিরূপ সাজানো আছে কাচের বাক্সে। এ রকম দেখেছিলাম ঢাকার আহসান মঞ্জিলে বেড়াতে গিয়ে। জানালার কাচে সুন্দর সব রঙিন চিত্রকল্প আঁকা। আরও আছে ডিজিটাল দানবাক্স। আপনি দুই ইউরোর একটা কয়েন প্রবেশ করাবেন, সুন্দর একটা সোনালি মুদ্রা বেরিয়ে আসবে, যেখানে গির্জার প্রতিকৃতি খোদাই করা থাকবে। এমন স্মারক সংগ্রহের সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়? পরে অবশ্য দেখেছি, প্যারিসের প্রতিটা দর্শনীয় স্থাপনাতেই এমন ব্যবস্থা রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বের হওয়ার সময়ই প্রার্থনাসংগীত শুরু হলো। এর আগে একবারই গির্জার প্রার্থনাসংগীত শোনার সুযোগ হয়েছিল। সেটাও ভারতের শিলংয়ের লাইমুখ্রা নামের এক জায়গায়। এবারের প্রার্থনাসংগীত সেটার চেয়ে আলাদা, কিন্তু শ্রুতিমধুর। সংগীত শেষে সবাই দাঁড়িয়ে গেল, আমি চুপিসারে বেরিয়ে এলাম। গির্জার চারদিকে যে লোহার সীমানাপ্রাচীর দেওয়া, সেটাতে হাজারো তালা ঝোলানো। যদ্দুর জানি, এগুলোকে লাভলক বলে। প্রেমিক–প্রেমিকারা তাঁদের সম্পর্কের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য সঙ্গী বা সঙ্গিনীর নাম তালায় লিখে তালা বন্ধ করে চাবিটা পানিতে ফেলে দেন। শুনেছিলাম, এই লাভলকের ব্যাপারটা সাধারণত নদীর ওপর কোনো সেতুতে করা হয়। এটা যে স্থলভাগেও করে, সেটাও দেখা হলো। প্রশ্ন হচ্ছে, চাবিগুলো তাহলে যায় কোথায়? আর যে উদ্দেশ্যে এই তালা–চাবির ব্যবস্থার চল শুরু হয়েছে, সেটা কি আদৌ কাজে দেয়? খোদ ফ্রান্সেই বিবাহবিচ্ছেদের হার ৬০ ভাগেরও বেশি; প্রেমের সম্পর্কের কথা না হয় বাদই নিলাম।

রেলিংয়ে ঝোলানো আছে অসংখ্য তালা
রেলিংয়ে ঝোলানো আছে অসংখ্য তালা

মমার্ত পাহাড়ের যে পাশ দিয়ে উঠেছিলাম, তার বিপরীত পাশ দিয়ে নামা সুবিধাজনক। চলন্ত লিফট আছে, অনেকটা কেবল কারের মতো ব্যবস্থা। সিঁড়ি দিয়েও নামা যায়। নিচে নামার পরপরই এক দেশি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। রবি ভাই যদিও পই পই করে বলে দিয়েছেন, দেশি ভাইদের এড়িয়ে চলতে; কিন্তু এতটা নিষ্ঠুর হওয়া তো সম্ভব নয়। জাহাঙ্গীর নামের ভাইটির বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বৈধভাবেই ফ্রান্সে এসেছিলেন, ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অবৈধভাবে থেকে গেছেন। পুলিশ ধরলে খবর আছে, তাই লুকিয়ে লুকিয়ে পর্যটকদের কাছে পেনড্রাইভ কিংবা মুঠোফোন চার্জার বিক্রি করে দিন গুজরান। ভাবতেই কষ্ট হয়। যৌবনের শক্তি–সামর্থ্য ইউরোপ নামের মরীচিকার পেছনে ছুটে কীভাবে নষ্ট করে মানুষ। কোনোভাবে যদি বৈধ অভিবাসীর তকমা জোটে কপালে, সেই আশায় আছেন। নিজেও জানেন, সেটার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফ্রান্স সরকার এককালে অভিবাসীদের প্রতি নমনীয় থাকলেও এখন যথেষ্ট কঠোর। শুধু ফ্রান্স কেন, ইউরোপজুড়েই ডানপন্থীদের উত্থানে উদারপন্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, যার প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে জাতীয় রাজনীতিতেও।

৪ নম্বর মেট্রো ধরে খুব সহজেই মমার্ত থেকে নটর ডেম ক্যাথেড্রালে যাওয়া যায়। এটি সেই গির্জা, যেটিকে বিখ্যাত করেছেন ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো তাঁর ‘হাঞ্চব্যাক অব নটর ডেম’ উপন্যাসের মাধ্যমে। আমার লেখায় একই স্থানের বেলায় গির্জা, ব্যাসিলিকা, ক্যাথেড্রাল শব্দগুলো বারবার আসছে, অনেকেই হয়তো বিভ্রান্তও হচ্ছেন। খ্রিষ্টানদের উপাসনালয়কে আমরা গির্জা হিসেবেই জানি। যদিও উপাসনালয়গুলো চার্চ, চ্যাপেল, ব্যাসিলিকা ও ক্যাথেড্রালে বিভক্ত। আদতে সব কটিই গির্জা, তাই বাংলায় গির্জা হিসেবে সরলীকরণ করা হলেও সমস্যা নেই। পার্থক্যগুলো একটু পরিষ্কার করা যাক।
চার্চ হচ্ছে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট স্থান, যেখানে লোকেরা একত্র হয়ে প্রার্থনা করে থাকেন। চার্চে পাদরির উপস্থিতি আবশ্যক। চ্যাপেলে এমন ঝামেলা নেই। প্রার্থনার জায়গা থাকলেই হলো, পাদরির উপস্থিতি আবশ্যক নয়। চ্যাপেল তাই চার্চের চেয়ে আকারে ছোট, এমনকি চার্চের অভ্যন্তরেই একটামাত্র কক্ষ নিয়েও হতে পারে। হাসপাতাল, বিমানবন্দর এমনকি বিপণিবিতানেও চ্যাপেল থাকতে পারে। ক্যাথেড্রালও একধরণের চার্চ, তবে এর মর্যাদা সাধারণ চার্চ থেকে ঊর্ধ্বে, যা কিনা একজন বিশপ দ্বারা পরিচালিত হয়। ক্যাথেড্রালে বিশপের বসার জন্য একটি চেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক। যে ধর্মীয় স্থাপনাতেই বিশপের জন্য চেয়ার থাকবে, সেটিই ক্যাথেড্রাল। পুরো একটা জেলার দায়িত্ব একজন বিশপের কাঁধে ন্যস্ত থাকে, তাই প্রতি জেলায় একের অধিক ক্যাথেড্রাল থাকে না। প্যারিসেও তাই একটাই ক্যাথেড্রাল, নটর ডেম। মধ্যযুগে ইউরোপ যখন ধর্মরাষ্ট্রের অধীন ছিল, তখন পোপ, বিশপ এমনকি পাদরিরাও প্রভূত ক্ষমতা ভোগ করতেন। এখনকার হিসাব অবশ্য আলাদা, ইউরোপের মানুষজন দিন দিন যে হারে ধর্মহীনতার দিকে ঝুঁকছে, তাতে করে উপাসনালয়গুলো পূজারিদের তুলনায় পর্যটকদের তীর্থস্থানেই পরিণত হচ্ছে।

ব্যাসিলিকার ব্যাপারটা আবার আলাদা। এটি হচ্ছে পোপের দেওয়া বিশেষ খেতাব। কোনো ধর্মীয় স্থাপনার, সেটি চার্চ কিংবা ক্যাথেড্রাল উভয়ই হতে পারে; ঐতিহাসিক, আধ্যাত্মিক কিংবা স্থাপত্যকলার ওপর ভিত্তি করে পোপ সেই স্থাপনাকে ব্যাসিলিকা আখ্যা দিতে পারেন। সেক্রেকার গির্জা তাই ব্যাসিলিকা, আর নটর ডেম গির্জা হচ্ছে ক্যাথেড্রাল।

নতরদাম গির্জার সামনে লেখক
নতরদাম গির্জার সামনে লেখক

মধ্যযুগীয় গথিক স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এই ক্যাথেড্রাল ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। প্রায় ২০০ বছর সময় নিয়ে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। সেইন নদীতীরের এই স্থাপত্য ফরাসি স্থপতিদের উৎকর্ষের এক অনুপম নিদর্শন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনী কর্তৃক ফ্রান্স পুনর্দখলের উদ্‌যাপন হয়েছিল এই গির্জাতেই। এর ভেতরে খ্রিষ্টধর্মের পবিত্র কিছু স্মারক রক্ষিত আছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যখন সেখানে পৌঁছেছি, তখন পরিদর্শনের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনটা প্রবেশপথের দুটিই ছিল বন্ধ, অপরটা দিয়ে ভেতরের দর্শনার্থীরা বের হচ্ছিল। নিরাপত্তারক্ষীদের অনুরোধ করেও কাজ হয়নি। বাইরে থেকে দেখে কি আর দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে? প্রবেশপথগুলোর ওপর খ্রিষ্টধর্মমত অনুযায়ী, শেষ বিচারের দিনের বিভিন্ন ঘটনা ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিখুঁতভাবে। এত সূক্ষ্ম কাজ যে মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়।

গির্জার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সেইন নদী। মূল রাস্তা থেকে ধাপে ধাপে সিমেন্ট বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে নদী পর্যন্ত। যে কেউ চাইলেই নদীর তীরে বসে নিজেকে সময় দিতে পারে। কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে বসে ফেলে আসা সময়গুলোর কথা ভাবছিলাম। মনে পড়ে গেল মার্গারিটের কথা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মার্গারিট, ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’র মার্গারিট। আজ থেকে অর্ধশত বছর আগে সুনীল মার্গারিটের সঙ্গে প্যারিস চষে বেড়িয়েছিলেন। সেইন নদীর পাড় ধরে হেঁটেছিলেন। গল্প করেছিলেন নটর ডেম গির্জার চাতালে বসে। ৫০ বছর পর তাঁর এক ভক্ত–অনুরাগী তাঁরই পদচিহ্ন অনুসরণ করে মার্গারিটের সঙ্গে সুনীলের বিচ্ছেদের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। একজন লেখকের সার্থকতা তো এখানেই। অনুভূতিগুলোকে তিনি পার করে দিতে পারেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

স্যেন নদীর তীরে অবস্থিত নতরদাম গির্জা
স্যেন নদীর তীরে অবস্থিত নতরদাম গির্জা

সন্ধ্যা হয়ে আসছে, হোটেলে ফিরতে হবে। একটা ব্যস্ত দিন অপেক্ষা করছে সামনে। কেন জানি না, বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার হোটেলকক্ষের ছবির মেয়েটিকে আমি চিনতে পারলাম। এই ছবি আমি দেখেছিলাম সুনীলের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’র প্রচ্ছদে। নন্দিত ফরাসি চিত্রশিল্পী পিয়ের অগুস্ত রেনোয়া এঁকেছিলেন মেয়েটিকে। এক জীবনে তিনি বারবার মেয়েটির ছবি এঁকেছিলেন, বিভিন্নভাবে। ছবিটি সুনীলের খুব পছন্দের ছিল। তিনি কি ছবির মেয়েটির মাঝেই মার্গারিটকে খুঁজে পেতেন?
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৫, ০৯: ১৭
বিজ্ঞাপন