পরদিন আমার মাফুশি আইল্যান্ডে যাওয়ার পালা। নির্জন, নিরালায় দুদিন কাটানোর পর এবার আমাকে হইহট্টে মাতিয়ে রাখা কোনো এক দ্বীপ টানছিল। ওলুভেলি দ্বীপকে বিদায় জানাতে না চাইলেও বিদায় জানাতে হলো।
এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যাওয়ার জন্য একমাত্র বাহন স্পিডবোট। এবারের স্পিডবোট আকারে ছোট আর মাঝসাগরে কয়েকবার মনে হয়েছিল যে ডুবেই বুঝি যাবে, উত্তাল সাগরের সঙ্গে আদতেই তাল মেলাতে পারবে না। কিন্তু কেমন করে যেন আবার ঠিকই উতরে গেল।
মাফুশি আইল্যান্ড। একটি নতুন দ্বীপে অভিযান। পৌঁছাতেই ঝমাঝম বৃষ্টি আরম্ভ হলো। জেটির ছাউনি থেকে নড়ার উপায় নেই। শুনেছি, দ্বীপটিও খুব সহজে হেঁটে পার হওয়া যায়।

বৃষ্টি থামতেই জেটির ধারের রাস্তা ধরে হোটেল খুঁজে বের করলাম। এ দ্বীপে ট্যুরিস্ট ছাড়াও স্থানীয় মানুষ বসবাস করে। ওলুভেলিতে যেমন স্থানীয় লোকজনের বসবাস ছিল না, তেমনই ছিল না কোনো যানবাহন। তাদের যানবাহন বলতে স্কুটি বা এ-জাতীয় ইলেকট্রনিক মোটরবাইক আর বাইসাইকেল। তবে এ দ্বীপেও কোনো দূষণ নেই। পথে দু-একজন স্থানীয় মানুষ চলাফেরা করছে ঠিকই, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন পটচিত্র।
এবারে খুব সাধারণ হোটেল বুক করেছি এখানে। অনেকগুলো কারণের একটি হলো, হোটেলের কর্মীদের সাহায্যে স্থানীয় লোকজনের জীবনযাপন এতে খুব কাছ থেকে দেখা যাবে। আর বাংলাদেশি ভাইয়েরা কেমন আছেন এখানে, তা-ও জানা যাবে। গতকাল রিসোর্টে কারও কথা বলার অনুমতি ছিল না।
হোটেলের রিসেপশনে যে ছেলেটি বসে ছিল, চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় ছেলেটি বাংলাদেশি। আমি বাংলায় কথা বলতেই খুব খুশি হলো। ছেলেটির নাম রায়হান, বাড়ি কুমিল্লা। আরও বলল, এখানে যত জনসংখ্যা, তার সমানসংখ্যক বাঙালি ভাইয়েরা এই দ্বীপে কাজ করেন। আমার সঙ্গে লাগেজ বলতে একটা ছোট হ্যান্ডব্যাগ। গরমের দেশ, বেশি কাপড়চোপড় বাহুল্য। ভেলানা এয়ারপোর্টে অন্যদের ঢাউস ঢাউস লাগেজের সঙ্গে আমাকে একেবারেই বেমানান লাগছিল। একজন কাস্টমস কর্মকর্তা তো জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, ‘তোমার আর লাগেজ নেই?’

হোটেল রুমে ব্যাগ রেখে চললাম মাফুশি অভিযানে। মাফুশি বা ওলুভেলি কারোরই মূল সড়ক পাকা নয়, সমুদ্রের বালু বিছানো। তবে তটের বালুর মতো পা দেবে যায় না, বেশ পোক্ত। মালদ্বীপের যেকোনো দ্বীপেই এক কোনা দিয়ে হাঁটা শুরু করলে হাঁটতে হাঁটতে আবার একই জায়গায় এসে পৌঁছানো যায়। বৃষ্টির পর এখন আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমি জেটির দিকের মূল পথ ধরে চললাম। জেটির এক পাশে সমুদ্র আর অন্য পাশে রেস্তোরাঁ, ওয়াটার স্পোর্টসের অফিস, কিছু হোটেলও আছে। আরেকটু সামনের দিকে নারকেলগাছের ঘের, পেছনে আরও হোটেল। এদিকটায় অল্প কিছু ট্যুরিস্ট অপেক্ষা করে আছেন সূর্যাস্তের। এখনো জলধি রং হারায়নি। এ দ্বীপের জলের রং আলাদা। কেমন যেন ঘোর লাগানো পান্না সবুজ, ছুঁতে গেলে রং দূরে চলে যায়। তার বদলে হাতে আসে স্বচ্ছ জল।
ট্যুরিস্টরা নিজেদের মতো সন্তরণ বা সার্ফিং করছেন। কেউ অলস শুয়ে আছেন তটে। মালদ্বীপের মতো অন্যান্য দেশের পাবলিক বিচে এত কম ট্যুরিস্ট আমি দেখিনি। এই তটে ইউরোপীয় ট্যুরিস্টদের সঙ্গে দু-চারজন ভারতীয় ট্যুরিস্টও দেখলাম।
সূর্যাস্ত হলো স্বর্ণালি স্বর্গের দ্বার খুলে দেওয়া এক পাখি। এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপ ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুটে চলছে। সে পাখিকে যে ধরতে পারে, তার মাথায় বসে সোনালি সন্ধ্যার মুকুট।
লালিমা মুছে যাওয়ার আরও কিছুক্ষণ পর অলিগলি পার হয়ে হোটেলের দিকে চললাম। অলিগলিতে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ, সুপার শপ, স্যুভেনিরের দোকান দেখলাম। স্থানীয় লোকজনের বসতবাড়ি এই লম্বা গলিগুলোতেই। প্রায় সবই একতলা বাড়ি। হোটেলে ফেরার পথে একটা মসজিদও দেখলাম। ভেতরে এখন এশার নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা।
মাফুশি আইল্যান্ড আমার দেখা অন্যান্য দেশের দ্বীপের তুলনায় অনেক বেশি নীরব। জনসংখ্যা সাকল্যে পনেরো শ; কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পথে কাউকে দেখলাম না। প্রায় দেড় কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে আছে দ্বীপটি। হোটেলে গতকাল এক ভারতীয় যুগলের সঙ্গে দেখা হয়েছে। পল্লবী আর ঋষিকেশ। দুজনই ডাক্তার, ভারতের আসাম থেকে এসেছেন। আজ আবার দেখা হলো। তাঁরাও আজ দ্বীপটি ঘুরে বেড়াবেন আমার সঙ্গে।
হোটেলের সঙ্গের পথ শেষ হয়েছে তটে। আমার রুমের বারান্দা থেকে দেখা যায়। আজ সূর্যোদয় বারান্দায় বসেই দেখলাম। আবার একই স্ট্রিটের আরেক দিক শেষ হয়েছে অপর পাশের জেটির দিকের তটে। প্রতিটি গলিতেই একই দৃশ্য। আমি আমার বারান্দার কাছের তটে নেমে পড়লাম। এদিকটার জল নীলকান্তমণির মতো গাঢ় নীল; তার সঙ্গে আজকের আকাশও প্রতিযোগিতা করছে। আকাশের পুঞ্জ পুঞ্জ ধবধবে সাদা মেঘের গুঞ্জনে ঝুঁকে পড়েছে সাগরের জলে, ছায়া ফেলছে জলকে একটুও না ছুঁয়ে। সাদা তট আর তার পাশের জলাধিপতি মিশে গেছে অন্তরিক্ষে; যেন জলই আকাশ, এদের মধ্যে এখন আর কেউ নেই, কোথাও নেই।
এই তটের কাছ থেকে চলে আসা যায় না, তবু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের রাগ বাড়ছে, তাড়াতে চাইছে আমাকে। আমি দ্বীপের একদম মাঝখানের পথটা ধরে হাঁটা দিলাম। তার আগেই এখানকার ফুটবল মাঠ পেরোলাম। মাঠে খেলার সুবিধার জন্য কৃত্রিম ঘাস বিছানো হয়েছে। ঘাস তো এখানে জন্মায় না। মালদ্বীপের প্রতিটি দ্বীপই পরিবেশবান্ধব। প্লাস্টিক, বায়ুদূষণকারী যানবাহন এখানে নিষিদ্ধ।

মাঝের পথটায় প্রথমে পড়ল এই দ্বীপের একমাত্র সরকারি কার্যালয়। একতলা ছোট ভবন, বাইরের ছাদ চৌকো। বড় বড় নিম, আম আর জামরুলগাছে ঢাকা। আমার ইচ্ছা হলো অফিসটা কেমন দেখি। ভেতরের উঠানে নানান ফুল গাছের বাগান। লালরঙা জামরুলগাছ থেকে ঝরে নিচে পড়ে আছে। এই অফিসের ভেতরে তিনজন কর্মচারী ছাড়া আর কেউ নেই। দ্বীপের সব কাজ এখানেই হয়। ভবনের বাইরে বা আশপাশে কোনো মানুষ নেই। সরকারি অফিসের সামনে জটলা বাঁধা ভিড় না দেখে হতাশ হলাম। ঠিক তার পাশেই একতলা সরকারি হাসপাতাল দেখে আরও অবাক হলাম। বাইরে গাছপালায় ঘেরা ভেতরে পার্কিংয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড় করানো। আশপাশে কোনো মানুষ নেই। রিসেপশনেও কেউ নেই। এদের কি অসুখবিসুখ হয় না! একজন স্টাফ এগিয়ে এলেন। বললেন, এখানে একজন ডাক্তার ও দুজন নার্স আছেন। স্থানীয় লোকজনের তেমন অসুখ করে না। মাঝেমধ্যে দু-একজন বিদেশি আসেন চিকিৎসা নিতে। এ কেমন জায়গা রে বাবা, কারও কোনো অসুখই হয় না! অথচ আমাদের দেশে গ্রামের হাসপাতালে তো জায়গাই হয় না।
হাসপাতাল পেরিয়ে খানিক এগোলে এখানকার একমাত্র স্কুল। এখন স্কুলের সময় হয়ে এল। স্কুল ভবনটি একতলা ও বাউন্ডারি দেওয়া। দেয়ালের তিন পাশে সারি সারি ক্লাসরুম আর মাঝখানে বিশাল খেলার মাঠ। মাঠে গাছের ছায়া নকশার কারুকাজ করে চলছে।
জুনিয়র সেকশনের কয়েকজন শিশু স্কুলে প্রবেশ করছে, এখন তাদের ক্লাস শুরু হবে। ভেতরে অবশ্য সিনিয়র সেকশনের ক্লাস চলছে।
শিশুদের ইউনিফর্ম সবুজ টি-শার্ট আর কালো প্যান্ট। কেউ হেঁটে এসেছে বাবা বা মায়ের সঙ্গে, কেউ এসেছে স্কুটিতে চড়ে। এই দ্বীপে ইকো ফ্রেন্ডলি, স্কুটি আর বাইসাইকেল চালানোর অনুমতি আছে।
স্কুলের পরের ভবনটি একতলা মসজিদ। যে মসজিদ আমি গতকাল দেখেছিলাম। এখন বন্ধ। সাধারণ মসজিদের মতোই, তবে অন্যান্য সরকারি ভবনের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে এর ছাদও চৌকো।
এখান থেকে সোজা চলে এলাম অপর পাশের তটে। মাঝখানে পার হলো স্থানীয় মানুষের ঘর। সবার বাড়ির সামনে বাউন্ডারি দেয়ালজুড়ে লতানো গাছ বেয়ে যাচ্ছে, কোথাও ঘন ম্যাজেন্টা রঙের বাগানবিলাস, কোথাও অপরাজিতা বা গোল্ডেন ট্রাম্পেট। বাড়ির সম্মুখভাগে এক চিলতে উঠানে বাগান, বড় বড় গাছের পাশাপাশি নানা ফুল-পাতার গাছ তাতে। বাউন্ডারির মাঝখানে কাঠের প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বারের পাশে বাইরে এদের স্টাইলের কয়েকটা বসার জায়গা। কাঠের চারকোনা ফ্রেমের ভেতরে দড়ির বুনন, সবার বাড়ির সামনে এ রকম বসার ব্যবস্থা আছে। কারও বাড়ির প্রবেশদ্বার বাদে বাকি সব দেয়াল লতানো গাছে ছেয়ে আছে। একজনের বাসার সামনে মনে হলো মাটি সুবাস ছড়াচ্ছে তীব্র, কিন্তু এখানে তো মাটি নেই, সব বালু। নিচে পড়ে আছে বকুল ফুলের দল। এ দেশে বকুল ফুল দেখব ভাবিনি। সুবাস তারাই ছড়ায়, যারা আপন করে নিতে জানে।
গলির মোড়ের মনিহারি দোকানে ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়েছে রমজান মাস চলছে তা-ই। অনেক মুসলিম দেশে রমজান মাসে সব পণ্যদ্রব্যের ওপর আকর্ষণীয় ছাড় দেয়।
সামনের তটের জলধির রং দেখে মন আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছিল না। যত এগোচ্ছি, ততই রং ঘোর লাগাচ্ছে। জলের রং এখন সবুজ আর ফিরোজা মিশেল। এ রং গায়ে মাখা যায় না, কণ্ঠমণি করে রাখতে হয় সামান্য হাতে নিয়ে অথবা করতে হয় মাথার মুকুট।
এমন রঙিন জলের ভুবন ছেড়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। তটের কয়েক জায়গায় বড় বড় পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। আমি একটা পাথরে বসে জলের আর হাওয়ার ঝাপটায় ভেসে থাকি।
দুজন ট্যুরিস্ট ইতিমধ্যে সার্ফিং বোট নিয়ে নেমে পড়েছেন। এই তটের জল শান্ত, তাই বোটে লম্বা হয়ে শুয়ে সময় কাটানো যায়। চার-পাঁচজন জলে সন্তরণে ব্যস্ত।
এই জল তো রত্নভান্ডার। এখানে ভেসে বা ডুবে গেলে কখনো কোনো ক্ষতি হতে নেই। মিলবে মুঠো মুঠো রত্ন। মাফুশি আইল্যান্ড এখন আমার অনেক ভালো লাগছে। এখানে স্থানীয় মানুষ ও ট্যুরিস্ট আছেন, অল্প হলেও আনন্দের অভিব্যক্তি সবার চোখেমুখে লেগে আছে। স্থানীয় ছেলেমেয়েদের আমি তটে ঘোরাঘুরি করতে দেখিনি। সবাই নিজের দোকান বা ওয়াটার স্পোর্টস আউটলেটের ভেতরে বসে, কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। ছেলেরা প্রায় সবাই শর্টস পরা, মেয়েরা শার্ট-প্যান্ট। বেশির ভাগ ছেলের মাথায় লম্বা চুল কাঁধ ছাপিয়ে নেমেছে। দ্বীপের কোনো লেন পাকা নয়, বালু বিছানো; কিন্তু কোথাও কোনো ময়লা পড়ে নেই। সব ঝকঝকে সমুদ্রসৈকতের মতো ধোয়ামোছা।
আমি সেই যে জাদুর রং করা তটে বসেছি, আর উঠি না। সামনের দিকের তটে একজনও মানুষ নেই। ওদিকে চললাম।
ওদিকটায় যাওয়ার পথে দেখলাম, এখানকার এক হোটেলের অতিথিদের জন্য তটে মিউজিক বাজিয়ে কোমরসমান জলে যোগব্যায়াম আর নাচের আয়োজন করা হয়েছে। একজন ইনস্ট্রাক্টর আছেন, যিনি সমুদ্রের দিকে মুখ করে বিভিন্ন মুদ্রা শেখাচ্ছেন আর তাঁকে দেখে জলে থাকা মানুষের একেকজন শিল্পী হয়ে উঠছেন। অবশ্য এই ইভেন্টে যেকোনো অতিথি অংশগ্রহণ করতে পারেন। আহা! সাগরে এলে কি শুধু তটে বসে বা পা ভিজিয়েই চলে যেতে হয়, কত আনন্দ করার আছে!
সন্ধ্যায় এই তটেই চেয়ার-টেবিল পেতে আয়োজন করা হয় ডিনারের সঙ্গে জ্যাজ বা ব্লুজ লাইভ মিউজিক। যার ইচ্ছা ডিনার করো বা তটে বসে শীতল হাওয়ার ঝাপটায় শ্রবণে সুধা ঢালো।
এখন যেদিকে যাচ্ছি, এই তট একদম ওলুভেলি দ্বীপের মতো মনে হচ্ছে। একটু আগের অবিরাম নীল আকাশে এখন গুঞ্জরিত মেঘ। আর সে কারণে জলেও তার ছায়া পড়েছে। তটের দিকের জল সবজে ফিরোজা রং আর সামনের দিকে নীল। জলাধিরাজ জলেই যেন সব রহস্য আটকে রেখেছে এখন। যেভাবে বলবে, সেভাবেই জল রং খেলবে। তটের গায়ে গা লাগিয়ে হাঁটার কারণে এখন জলতরঙ্গ বাজানোর শব্দ আসছে জলধির হৃদয় থেকে। ঢেউয়ের শব্দ যে এত মিষ্টি হতে পারে, কে জানত!
আরেকটু সামনে গাছের ডালে একটা দোলনা ঝুলছে। দোলনা, গাছ আর জলাধি ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। এখানে বসে দিন পার করলে খুব বেশি হেলা করা হবে না এই সবজে ফিরোজা রংকে। দোলনায় বসে সাগরের প্রাণীর কোনো কোনোটি দেখা যায়। আমি জীবন্ত শামুক ও ঝিনুক আগে কোনো তটে দেখিনি। এই সফেদ অভয়ারণ্যে বিভিন্ন আকার আর রঙের শামুক, ঝিনুক ও কাঁকড়া খেলে বেড়াচ্ছে। তটে বসলে কুড়ানো যায় এদের খোলস। কিন্তু সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না। পরিবেশ রক্ষার জন্য এদের এখানেই ফেলে যেতে হবে।
মেঘে ঢাকা সূর্য, কখনো তাপ, কখনো জোর হাওয়া আর ঢেউয়ের চলাফেরা শেষ হয় না। দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি বাকি দ্বীপ ঘুরে দেখার জন্য দোলনা থেকে উঠলাম। অলিগলিতে ঢোকার আগে দেখলাম, বাচ্চাদের খেলার জন্য রঙিন একটা পার্ক। সব খেলনাই আছে—স্লাইড থেকে সি স’ অবধি। তার পাশে উন্মুক্ত জায়গায় অন্যান্য বাসিন্দার জন্য শরীরচর্চার সরঞ্জাম। সাগরের তীরে এমন সুন্দর ব্যবস্থা আর অন্য কোথাও দেখিনি।
একটি গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এখানকার একমাত্র থানায় চলে এলাম। কালো পোশাক পরা কয়েকজন নারী ও পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তা বসে রয়েছেন। সারা দ্বীপে মোটরবাইক নিয়ে তাঁরা টহল দেন। অপরাধ হয় না তেমন এখানে, মাঝেমধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ে ধরা পড়েন স্থানীয় ব্যক্তিরা। তখন শাস্তি হয়। শাস্তি দেওয়ার জন্য এই দপ্তরের পাশে আছে উঁচু দেয়ালে ঘেরা কারাগার।
আরেকটু এগোলে এই দ্বীপের সবচেয়ে বড় মসজিদ। একতলা, গাছপালায় ঘেরা।
আমার হোটেল এখান থেকে দেখা যায়। রাতে এক স্থানীয় বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে। মেয়েটির সঙ্গে আমার পরিচয় ভেলানা এয়ারপোর্টে। সে অবশ্য থাকে মালে শহরে। যার বাড়িতে এসেছে, সে মেয়েটির বন্ধু। আর আমার নেমন্তন্ন চেয়ে নিতে একটুও লজ্জা করে না।
বাকি সময়টা হোটেলের বারান্দায় বসে অর্ণব দেখা যায়।
হোটেলের পাশে এখানকার একমাত্র ব্যাংক, ব্যাংক অব মালদ্বীপ। এখন পর্যন্ত এই দ্বীপে ঘুরে বেড়াতে কোনো টাকাপয়সাই লাগেনি রেস্তোরাঁ আর হোটেলের বিল ছাড়া।
হোটেল রিসেপশনে আরেক বাংলাদেশি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। এই দ্বীপের সব হোটেলে বাংলাদেশি ভাইয়েরা চাকরি করেন। এখানে দেশি খাবারের একটা রেস্তোরাঁও আছে, যেখানে দেশি মাছ পাওয়া যায়, অন্যান্য খাবারও পাওয়া যায়। একটু পরই ইফতারের সময়। আমাকে ভাইয়েরা বললেন, তাঁদের সঙ্গে ইফতার করতে। আমার অনুমতি নিয়ে তাঁরা হোটেলের ডাইনিংয়ে ইফতারি সাজালেন। হোটেলের অন্যান্য ইউরোপীয় আর ভারতীয় অতিথিদের ডাকলেন ইফতার করতে। ইফতারের সময় দেখি, পেঁয়াজি, বেগুনি, চপ, বুট ভাজা, মুড়ি, জিলাপি, ফল, শরবত—সবই টেবিলে সাজানো। এসব আনা হয়েছে দেশি রেস্তোরাঁ থেকে। ইফতার করতে করতে শুনলাম, দেশি ভাইদের এই দেশে আসার এবং থাকার কাহিনি। বেশির ভাগই অবৈধভাবে আসেন কাজ করতে, দেশে চাকরি নেই বা সম্মান নেই। এসএসসি বা এইচএসসি পাস তাঁরা। এখানে এসে পরে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে নেন। কিন্তু এই পারমিট পেতে এবং পর্যাপ্ত টাকা জোগাড় করে দেশে পাঠাতে তিন-চার বছর চলে যায়। এর মধ্যে দেশে যেতে পারেন না, দেখা হয় না পরিবার-পরিজনের সঙ্গে। তাঁরা থাকেনও মেস করে। নিজেরাই রান্না করে খান, যদি সময় পান; না হলে দেশি রেস্তোরাঁই ভরসা। যেসব দেশি ভাই ওলুভেলির মতো আইল্যান্ড রিসোর্টে থাকেন, তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রিসোর্ট থেকে করা হয়, তাঁরা অবশ্য বৈধ কর্মী। পরিবারকে সামান্য স্বাচ্ছন্দ্য দিতে কত কিছুই না করেন তাঁরা।
ইফতারের পর এই দ্বীপের বাসিন্দা তাবিনার বাড়িতে গেলাম নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। যাওয়ার পথে একটা গলির ভেতরে দরজির দোকানের সামনে বাংলায় লেখা আছে, ‘টেইলর আবশ্যক’। চোখ বন্ধ করে বলা যায়, এ আহ্বান বাংলাদেশি ভাইদের জন্য। আর এখন পর্যন্ত যত দোকানে ঢুঁ মেরেছি, সব কটিতেই বাংলাদেশি ভাইয়েরা কাজ করেন। এখানকার অধিবাসীদের সমানসংখ্যক আছেন দেশি ভাইয়েরা।
তাবিনার বাড়ি অন্য একটি দ্বীপে, কিন্তু তার স্বামী এই দ্বীপে কাজ করেন এখন। তাবিনাও এখানকার একটা সুপার শপে কাজ করে। এই দ্বীপে সুপার শপ আছেই মোট ছয়টা। তাবিনার বাড়ি মাফুশি আইল্যান্ডের অন্যান্য বাড়ির মতোই, ছিমছাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বাড়ির বাইরের দেয়ালজুড়ে ঝাড়লতা আর ভেতরে একচিলতে বাগান। তাবিনার বাড়িতে আমার সেই বন্ধু আসরাও ছিল।
বাসার ভেতরটাও পরিচ্ছন্ন। তারা বলেছিল আমাকে সামুদ্রিক মাছ খাওয়াবে। ভাতের সঙ্গে এদেশীয় ফিশকারি গারুধিয়া আর মাছ ভাজা এবং শুকনা লঙ্কার চাটনি, সালাদ। গারুধিয়া রান্নার পদ্ধতি খুব সোজা। পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ কুচিয়ে মাছের টুকরার সঙ্গে জলে সেদ্ধ করে নিতে হয়, তেল ছাড়া রান্না হয় এই পদ। দেখতে সাদা স্যুপের মতো, কিন্তু খেতে খুব সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যসম্মত। এই খাবারের স্বাদ আমি কখনোই ভুলব না।
মালদ্বীপ দেশটার আয়ের মূল উৎস হলো ট্যুরিজম। নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বলতে কিছুই প্রায় নেই। সে জন্য খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসপত্র বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তবে পণ্যের গুণগত মান উচ্চ এবং এ দেশে সব জিনিসপত্রের দামও উচ্চ। এমনকি প্রধান খাদ্য ভাত—চালও আমদানি করতে হয়। মাত্র ১০ শতাংশ ভূমিতে অল্প কিছু ফলের চাষ হয়। বাকি সবজি, ফল আমদানি হয়। রপ্তানি হয় সামুদ্রিক মাছ।