তখনো প্রবাসজীবনে লেখাপড়ার ব্যাধি খুব একটা চেপে বসেনি। পরিণত বয়সে আরেক দফা ছাত্রজীবন শুরু করেছি বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব এনটর্পে। ঠিক করলাম, সপ্তাহান্তের ছুটিতে বেলজিয়ামের পরিবেশবান্ধব শহর হেসেল্টে যাব। সে শহরে থাকেন হিমু মামা প্রায় বছর পঁচিশ ধরে। হিমু মামাকে বলা হয় হেসেল্ট শহরের প্রথম বাঙালি। একজন উদার এবং ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। সকাল সকাল এনটর্প সেন্ট্রাল স্টেশনে হাজির হলাম। টিকিট কাটলাম। তা ১২-১৩ ইউরোর মতো পড়ল আসা-যাওয়া মিলিয়ে।
ঘণ্টাখানেকের বেশি লাগল না হেসেল্টে পৌঁছাতে। মামা বললেন, দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে তবেই আমরা বের হব। খেতে বসে এ কী বিস্ময়! হরিণের মাংস! আমি আমার খুব কম বয়সে একবার খেয়েছিলাম।
- এ জিনিস কোথায় পেলেন, মামা?
- এখানকার কিছু কৃষকের নিজস্ব খামার আছে। এ খামার আয়তনে বেশ বড়, এক–দুই কিলোমিটারের মতো। অনেকটা বনের মতো দেখতে। সেখানে তাঁরা হরিণ পালেন। আবার কারও কারও ৮০-৯০ শতাংশের মতো জায়গা থাকলে সেখানে নেট দিয়ে বেড়া বানিয়ে হরিণ লালন–পালন করেন। তাঁরা অধিকাংশ পুরুষ হরিণ বিক্রি করে দেন, প্রজননের জন্য নারী হরিণ রাখতে হয় কয়েকটা। এখানে কিছু দোকানও আছে, যেখানে ‘ওয়াইল্ড মিট’ পাওয়া যায়।
- শুনেছি হরিণ ধরা বেশ কঠিন!
- বেশ কঠিন। প্রথমে গুলি করে ফেলে দিতে হয় অথবা নেট পেতে রাখতে হয় তাদের ধরার জন্য।
দুপুরের খাবার শেষ করে হিমু মামার গাড়িতে উঠে পড়লাম। মামা অসাধারণ গাড়ি চালাচ্ছেন। হেসেল্ট শহরটা বেলজিয়ামের মধ্যে, কিন্তু নেদারল্যান্ডসের এত কাছাকাছি যে, গাড়ি কখন বেলজিয়ামের ওপর দিয়ে যাচ্ছে আর কখন নেদারল্যান্ডসের রাস্তার ওপর দিয়ে যাচ্ছে, তা বলা মুশকিল। হেসেল্ট শহরটা নাকি বেশ কয়েকবার পৃথিবীর সেরা পরিচ্ছন্ন শহরের তকমা পেয়েছে। রাস্তার দুই পাশে দৃষ্টি রেখেই আমি তার প্রমাণ পাচ্ছি, আমাকে আর কোনো নথি ঘেঁটে তা যাচাই করতে হবে না। আমরা যাচ্ছি এক বিখ্যাত পাহাড়ে, যে পাহাড় তিনটি দেশকে ধারণ করেছে তার সীমানায়। এ পাহাড়ের অবস্থান হল্যান্ড, বেলজিয়াম আর জার্মানির সীমান্তে। স্থানটিকে বলা হয় ‘থ্রি কান্ট্রি পয়েন্ট’। পর্যটকদে জন্য জনপ্রিয় স্থান। পর্বতটির নাম ভ্যালসবার্গ। তার উচ্চতা ১ হাজার ৫৮ ফুট। ভ্যালস শহরের কাছে অবস্থান, তাই নামকরণ হয়েছে ভ্যালসবার্গ। ভ্যালসবার্গ নেদারল্যান্ডের সর্বোচ্চ বিন্দু। ভ্যালসবার্গ পর্বত জার্মানি, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যবর্তী স্থানে। তাই এর শিখরকে ডাচ ভাষায় ‘ড্রিল্যান্ডেনপুন্ট’ (তিনটি দেশ বিন্দু) বলা হয়। আর জার্মান ভাষায় ‘ড্রাইল্যান্ডায়েক’ (তিন দেশের কোণ) এবং ফরাসি ভাষায় বলা হয় ‘ট্রয়েস ফ্রন্টিয়ার্স’ (তিন সীমা)।
তিন উপায়ে ওই পাহাড়ে যাওয়া যায়। হল্যান্ড হয়ে, বেলজিয়াম হয়ে আর জার্মানি হয়ে। জার্মানির আখেন শহরের দিকে আমাদের গাড়ি এগোচ্ছে। গাড়ি উঠছে পাহাড়ের ওপর। খুব একটা সমান সোজা উঁচু রাস্তা নয়। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আঁকাবাঁকা রাস্তা হয়েছে এখানে। গাড়ি গিয়ে থামল পাহাড়ের মাথায়। গাড়ি রাখার জুতসই জায়গা আছে। ইউরোপের শীতের হালকা ঠান্ডা লাগছে গায়ে। একটা শীতল আরাম, সঙ্গে উচ্ছ্বাস। ফটকের মুখে একটি মানচিত্র আছে। মানচিত্র জিনিসটা আমি বুঝি কম। না, কোনো সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর বালাই নেই কোথাও। ফটক দিয়ে প্রবেশ করছি। হাতের ডানে একটা কফিশপের মতো মনে হলো। খুব একটা তাকাচ্ছিলাম না সেদিকে। পা বাড়াতেই সেই ঐতিহাসিক স্থান। স্থানটি দেখতে আমার বুক পর্যন্ত দণ্ডায়মান একটি পিলার বা খাড়া প্রস্তরখণ্ড। আমার কৈশোরে হানিফ সংকেতের জনপ্রিয় ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে প্রথম দেখেছিলাম তাকে। আজ স্বচক্ষে দেখছি।
এই প্রস্তরখণ্ডের তিন দিকে আছে তিন দেশের তিন শহর—জার্মানির আখেন, নেদারল্যান্ডসের ফালস্ এবং বেলজিয়ামের কেলমিস শহর। প্রস্তরখণ্ডের চারদিকে একটি বৃত্ত আঁকা। পিলারটিকে সামনে রেখে দাঁড়ালে আমার পেছনেই জার্মানি। ঠিক বাঁয়ে বেলজিয়াম এবং আমার ডানে নেদারল্যান্ডস। পাথরের পিলারের তিন দিকে আছে তিনটি দেশের নামের অদ্যাক্ষর: ডি, বি আর এনএল। তিন দিকে আবার তিনখানা সবুজ বেঞ্চি পাতা বৃত্তের ওপরই। বৃত্তের পেছনে তিন দেশের তিন পতাকা দণ্ডায়মান। ভাবা যায়? না আছে কোনো কাঁটাতারের বেড়া, না আছে কোনো সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বা সেনাবাহিনী। নির্দ্বিধায় সিনা টনটন করে হাঁটছি। কোনো ধরনের পাসপোর্ট বা নথি না দেখিয়ে তিনটি দেশ ঘুরে বেড়ানো; এ চাট্টিখানি কথা নয়। ইউরোপের এই খোলা সীমান্তের নীতি আমায় মুগ্ধ করেছে। ভিসা, মুদ্রা কিংবা অন্য কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা না করে হেঁটেছি তিন দেশে। উন্মুক্ত ইউরোপের ধারণাটি বুঝতে গেলে ওখানে যেতে হবে পর্যটকদের। ভ্রামণিকরা ছবি তুলছেন নানান কায়দায়। আমিও থেমে থাকার পাত্রী নই। ইতিহাসের এই অধ্যায়ের সঙ্গে আমার কিছু সখ্যের চিহ্ন রাখা চাই।
পাশে সাত-আট কদম এগিয়ে যেতেই একটি ওয়াচটাওয়ার কিংবা বলা যেতে পারে ভিউটাওয়ার। নাম তার বউদুইন টাওয়ার। এর আরেকটি নাম কোনিং বাউডেভাইনটোরেন। বেলজিয়ামের রাজা বাউডেভাইনের নামানুসারে এর নামকরণ হয়েছে। টাওয়ারটি বেলজিয়াম অংশে পড়েছে। ৫০ মিটার (১৬০ ফুট) ওপরের দিকে গেছে। জার্মানি থেকে ৬ মিটার এবং নেদারল্যান্ডস থেকে ২০ মিটার দূরে। এখান থেকে জার্মানির কিছু অংশ এবং ডাচ অঞ্চল দেখা যায় ভালো। আমি টাওয়ারে উঠব। আমি পা ফেললাম। আমি এর শেষ দেখতে চাই।
শরীরের সব শক্তি শেষ অর্ধেক উঠেই। আকাশ তো মেঘলা নয়, ওপর থেকে তিন দিকের তিন দেশ আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। থামলাম, দম নিলাম। পৃথিবীর পরতে পরতে জমে থাকা বিস্ময় দেখার শক্তি বোধ হয় আমি প্রকৃতি থেকে পাই। আমি আবার পা বাড়াই। যত আকাশের দিকে যাচ্ছি, দিগন্তরেখা তত বেশি স্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। রবি ঠাকুরের মতো করে বলতে ইচ্ছা করছে,
‘হে উদাসীন পৃথিবী,
আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে
তোমার নির্মম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি।’
শুনেছি ডাচরাও তাদের সীমান্তে ভিউ টাওয়ার নির্মাণ করেছে। তবে কি প্রত্যেকের প্রতিবেশীর দিকে নজর রাখতে এই প্রয়াস? জানি না। হয়তো তা–ই। চূড়া থেকে দেখতে পাচ্ছি, চারদিকে বনভূমি। আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো, ১৮৩০ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত ৯০ বছর চার দেশের সীমানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো এই পাহাড়। সে সময় নিউট্রাল মোরেসনেট নামে একটি ছোট কন্ডোমিনিয়াম ছিল এখানে, যার অবস্থান ছিল নেদারল্যান্ডস এবং প্রুশিয়া রাজ্যের মধ্যে। নেপোলিয়ানের পতনের পর, যখন ভিয়েনা কংগ্রেস ইউরোপের মানচিত্র পুনরায় আঁকছিল, এখানে কিছু সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। যে এলাকা পরবর্তীকালে ‘নিউট্রাল মোরেসনেট’ নামে পরিচিতি পায়। সেখানে একটি দস্তা খনি বিদ্যমান ছিল এবং দুটি রাজ্যের কেউই এর ওপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চায়নি। এই দ্বন্দ্ব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পরে এটি বেলজিয়ামের অংশ হয়। এখনো তিনটি দেশ সীমান্তের স্থানটিকে বলা হয় ভিয়ারগ্রেনজেনওয়েগ; ডাচ ভাষায় যার অর্থ চারটি বর্ডার রোড।
শরীর ক্লান্ত, অবসন্ন। কফিশপে গিয়ে বসি। সঙ্গে স্যুভেনিরের দোকানও আছে। নেদারল্যান্ডসের এক জোড়া কাঠের জুতা কিনি। এই ঐতিহ্য আজীবন সঙ্গে না রাখলে চলে? আমরা ফিরছি মাস্ট্রিক্ট হয়ে। মাস্ট্রিক্ট নেদারল্যান্ডসের সীমান্তের একটি শহর। কাছেই। গাড়ি চলছে। আমি রবি ঠাকুরকে মাথা থেকে সরাতে পারছি না। আমি এখন ‘শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে’।
লেখক: গবেষক ও পরিব্রাজক
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া
ছবি: লেখক