আঠারো শ শতকের শুরুর দিকে বেশ কয়েকজন বাইসাইকেল নির্মাণে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিলেও ১৮২০ সালের দিকে এ ব্যাপারে প্রথম সত্যিকারের সাফল্য পান জার্মান উদ্ভাবক ব্যারন কার্ল। তাঁর এবং পরবর্তী আরও কয়েকজনের ডিজাইনে তৈরি সেই প্রাথমিক পর্যায়ের বাইসাইকেলের সঙ্গে আজকের বাইসাইকেলের কাঠামোগত পার্থক্য যথেষ্ট স্পষ্ট। তবে বেসিক বাইসাইকেলের ডিজাইনের মূলনীতি হচ্ছে দুই চাকার ওপর বসানো কাঠামো, যাতে ন্যূনতম একজন বসতে পারে। সেই বেসিক ডিজাইনের বাইসাইকেল থেকে এখন অত্যাধুনিক সব প্রফেশনাল পর্যায়ের বাইসাইকেল আমাদের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে।
বাইসাইকেলপ্রেমী বা যাঁরা নিয়মিত সাইক্লিং করে থাকেন, তাঁরা এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে বাইসাইকেল শুধু এক ব্যক্তিগত দ্বিচক্রযান নয়, এ এক আবেগের নাম। আজ ৩ জুন বিশ্ব সাইকেল দিবস। ১৯৮৮ সাল থেকেই বাইসাইকেল চালানোর জন্য নিরাপদ অবকাঠামো নির্মাণ ও সাইক্লিংয়ের উপকারিতার ব্যাপারে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে বিশ্বব্যাপী দিবসটি গুরুত্বসহকারে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের বাইসাইকেলপ্রেমীরা ও সাইক্লিং কমিউনিটি অত্যন্ত উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজকের বিশেষ দিনটি উদ্যাপন করে থাকে।
বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বাইসাইকেলের সম্পর্ক বেশ গভীর। এ দেশে বাইসাইকেলের সবচেয়ে বাস্তবধর্মী ও বহুল ব্যবহার দেখা যায় গ্রামাঞ্চলে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে শহর এলাকাগুলোতেও বাইসাইকেল আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। রাজধানী এবং দেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা এবং যানজট পরিস্থিতির কারণে বহু মানুষ এখন বাইসাইকেলকেই প্রথম পছন্দনীয় বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অনেকের কাছে বাইসাইকেল বিলাসিতা, ব্যায়ামের অনুষঙ্গ বা অবসরের সঙ্গী হলেও এক বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য বাইসাইকেল জীবন ও জীবিকার জন্য অপরিহার্য আর মৌলিক চাহিদা স্বরূপ হয়ে উঠেছে।
উন্নত দেশগুলোতে বাইসাইকেলের জন্য আলাদা নিরাপদ লেন থাকলেও বাংলাদেশে তা খুবই হাতে গোনা কয়েক জায়গায় আছে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে। গণপরিবহনের গড় গতিবেগ ঢাকায় এখন ঘণ্টায় ৬ কিলোমিটারের কাছাকাছি। তাই বেশির ভাগ মানুষ এখানে এখন বাইসাইকেল ও মোটরবাইকমুখী। তারপরও জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বগতি, ট্যাক্স টোকেন আর ব্যক্তিগত সামর্থ্য ও স্বাস্থ্যের নিরিখে সবকিছুকে ছাড়িয়ে এখন বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপনে বাইসাইকেল এক বড় অংশ হয়ে উঠছে। শত শত অনলাইন ব্যবসার সহস্র ডেলিভারি এই বাইসাইকেলেই পৌঁছে যাচ্ছে ক্রেতাদের দ্বারপ্রান্তে। খাবার ডেলিভারির ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অগ্রগতির মূলেও এই বাইসাইকেল। কুরিয়ার সার্ভিসসহ সব লজিস্টিকস সেবার ক্ষেত্রে এখন আমরা বাইসাইকেলের ওপর নির্ভরশীল।
এ দেশে পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে এখন এক লাখ টাকা মূল্যের বাইসাইকেল পাওয়া যাচ্ছে। বাইসাইকেল আমদানি ও রপ্তানিকে ঘিরে দেশে তৈরি হয়েছে বিশাল বাজার। সঙ্গে বেড়েছে সার্ভিস সেন্টার, ডিলারশিপ সেন্টার, বাইসাইকেল পার্টস এবং হেলমেট ও অন্যান্য অনুষঙ্গভিত্তিক ব্যবসা। অনলাইনেও বাইসাইকেল, সাইকেলের পার্টস ও সাইক্লিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক ও অনুষঙ্গ কেনাবেচা হয়। রাজধানীর বংশালে গড়ে ওঠা অতি প্রাচীন সাইকেলের মার্কেট এখনো প্রতিদ্বন্দ্বী সাইকেল বেচাকেনায়। এ ছাড়া তেজগাঁওয়ে কিছু সাইকেল শপসহ মিরপুর ও ধানমন্ডি এলাকায় বেশ কিছু সার্ভিস সেন্টার ও অ্যাকসেসরিজ কেনাবেচার দোকান আছে।
দুনিয়াজুড়ে ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে বাইসাইকেল সবচেয়ে প্রিয় বাহন। কারণ, পৃথিবী ঘুরে দেখার জন্য পায়ে হেঁটে ভ্রমণের পর একমাত্র সাইকেলই সবচেয়ে কার্যকর। এর প্রতিটি প্যাডেল নিয়ে যেতে পারে প্রকৃতির খুব কাছে, দুর্গম আর দুর্ভেদ্য যেকোনো জায়গায়, অজানা কোনো জনগোষ্ঠীর একদম কাছাকাছি। বেগকে দূরে সরিয়ে আবেগকে আলিঙ্গন করে নিয়ে দুনিয়া দেখার জন্য সাইকেল এক উৎকৃষ্ট সঙ্গী। এ দেশের সবুজে ঘেরা দিগন্তজোড়া মাঠ, অবারিত ফসলের খেত আর প্রান্তর, মেঠো পথ, পাহাড়ি চড়াই-উতরাই, খরস্রোতা নদী, ঝিরি, ঝরনা আর খাইয়ের ধার ঘেঁষে এলোমেলো সরু পথ—সবকিছুই আপন করে নেওয়া যায় সাইকেলকে সঙ্গে করে ভ্রমণে বের হলে।
বাংলাদেশে বাইসাইকেল এবং সাইক্লিং নিয়ে যারা পরম আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের কথা না বললেই নয়। ধর্ম, লিঙ্গ, রাজনীতি—সবকিছুকে ছাপিয়ে এই সর্বজনীন কমিউনিটি বিভিন্ন ক্লাব, গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানের রূপে বিকাশ ও বৃদ্ধি পাচ্ছে সময়ের সঙ্গে জ্যামিতিক হারে। এ প্রসঙ্গে বিডিসাইক্লিস্টের কথা না বললেই নয়। যারা বাংলাদেশের প্রথম বৃহত্তম সাইক্লিং কমিউনিটি। তাদের হাত ধরে ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে জোরেশোরে ছড়িয়ে যাচ্ছে সাইক্লিংয়ের বার্তা। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের মতো দারুণ কিছু ইভেন্টে অংশ নেওয়া হয়েছে এই কমিউনিটির উদ্যোগে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোতে নিয়মিত বিজয় রাইড ও স্বাধীনতা রাইড অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে বিডিসাইক্লিস্টের আয়োজনে, যেখানে শুধু একটি বাইসাইকেল ও প্রয়োজনীয় সেফটি গিয়ার থাকলে যে কেউ অংশ নিতে পারেন। প্রাথমিক ও প্রফেশনাল—দুই পর্যায়েই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে এখানে। এর ধারাবাহিকতায় বিদেশের মাটিতে এ দেশের সাইক্লিস্টরা এখন বিবিধ অর্জনের মাধ্যমে দেশের পতাকা তুলে ধরছেন গৌরব সহকারে।
জীবিকা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক বন্ধন, পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী পরিবহন এবং যাতায়াত মানব জীবনের এই সবকিছুর জন্য এখন বাইসাইকেল অপরিহার্য। বাইসাইকেলের মানবীয় আবেগের জায়গাটি আমাদের জীবনের সঙ্গে এতই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে মনির হোসেন সরকার বিরচিত সেই বিখ্যাত গানটির সুরে বলা যায়, ‘হাওয়ার উপর চলে গাড়ি/লাগে না পেট্রল ডিজেল/মানুষ একটা দুই চাকার সাইকেল।’
ছবি: লেখক ও পেকজেলসডটকম