আমিও বাবা হয়ে গেছি
শেয়ার করুন
ফলো করুন

সাতক্ষীরা থেকে এক বন্ধুর ফোন, রিসিভ করতেই তার প্রথম বিস্ময়, ‘তুইও বাবা হয়ে গেলি!’ এই কথাটা আমিও ভেবেছিলাম। গত বছর যখন প্রথম ‘কনফার্ম’ হয়েছিলাম, তারপর। অদ্ভুতভাবে সেদিন আমাদের বারান্দার টবে প্রথম বাগানবিলাস ফুটেছিল। অথচ তখন দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রীমঙ্গল বেড়াতে যাওয়ার জন্য আমাদের বাক্সপেটরা গোছানো শেষ। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে সাবধানে রওনা হলাম শ্রীমঙ্গল।
স্ত্রীর সঙ্গে এর আগে অনেকবার বেড়াতে গেলেও এবারই প্রথম তার হাঁটা-চলা, ব্যাগ ক্যারি করার দিকে আমার বাড়তি খেয়াল। আসলেই কি স্ত্রীর খেয়াল? নাকি তার ভেতরে বাড়তে শুরু করা এক ভালোবাসার খেয়াল, আমি জানি না। একেকটি মাস পার হয় আর টেনশন, অস্থিরতা বাড়তে থাকে। কয়েক মাস পর যেদিন প্রথম সন্তানের নড়াচড়া টের পেলাম, এক অদ্ভুত শীতল বাতাস যেন খেলে গেল আমার শরীরজুড়ে। হাতের দিকে চেয়ে দেখি আমার লোম দাঁড়িয়ে গেছে।

যেদিন প্রথম সন্তানের নড়াচড়া টের পেলাম, এক অদ্ভুত শীতল বাতাস যেন খেলে গেল আমার শরীরজুড়ে
যেদিন প্রথম সন্তানের নড়াচড়া টের পেলাম, এক অদ্ভুত শীতল বাতাস যেন খেলে গেল আমার শরীরজুড়ে

স্ত্রীর পেটে কান রেখে তার (অনাগত সন্তানের) কর্মকাণ্ড বোঝার চেষ্টা করি। সাত মাস পর থেকে বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হতে থাকে। না দেখা এক সন্তানের জন্য কেমন যেন মায়া জন্ম নিতে শুরু করল। একবেলা নড়াচড়া কম হলেই ডাক্তারের কাছে ফোন করি, নিজেরা বোঝার চেষ্টা করি, কীভাবে অনাগতের নড়াচড়া ঠিক রাখা যাবে। ইউটিউব ছেড়ে নানা রকম ‘পিস সাউন্ড’ বাজাই। রাতের বেলা এই সুর শুনে আস্তে আস্তে মায়ের পেটে বাড়তে থাকা একটি ছোট্ট প্রাণ ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো কোনো দিন স্ত্রীর পেটের কাছে গিয়ে ডাকতেই সাড়া আসে ভেতর থেকে। নড়াচড়া বেড়ে যায়। অদেখা কোনো বিষয়ের প্রতি যে এমন মায়া জন্মাতে পারে, সেকি আগে ভেবেছি কখনো!

বিজ্ঞাপন

আমরা দুজনে (আমি ও স্ত্রী) নানা রকম পরিকল্পনা করি। এটা সেটা কেনাকাটা করি সন্তানের জন্য। অপেক্ষার সময় কমতে কমতে এগিয়ে এল দিনক্ষণ। নরমাল ডেলিভারির জন্য শুরু মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিল আমার স্ত্রী তবে শেষ মুহূর্তের কন্ডিশন দেখে ডাক্তার সিজার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। নির্ধারিত তারিখ ২০ এপ্রিল ২০২২। হাসপাতালে যাওয়ার আগে ভোররাত থেকে বছরের প্রথম কাল বৈশাখীর হানা। ঝড়বৃষ্টির প্রকোপ কমলে হাসপাতালে গেলাম আমরা। ওটিতে নেওয়া হলো স্ত্রীকে। বাইরে তখন পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও কাছের বেশ কজন বন্ধুবান্ধব। দমবন্ধ পরিবেশে আমি শুধু পায়চারি করছি। কয়েক মিনিটের সেই অপেক্ষার সময়টুকুতে হাজারো চিন্তাভাবনা এসে ভর করল মাথায়। কোনোটা হাসির, কোনোটা বেদনার। এর মধ্যেই একসময় ডাক্তার বাইরে এলেন। জানিয়ে গেলেন ছেলে হয়েছে, দুজনই সুস্থ আছে। আমার উদ্বেগ কিছুটা কমল। এরও কয়েক মিনিট পর আমাকে ভেতরে ডেকে নিলেন একজন চিকিৎসক। ঝড়ের বেগে আমি এগিয়ে গেলাম সেই রুমের দিকে।

আমি এগিয়ে যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে পিট পিট করে তাকালো সে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে জলে ভরে গেল
আমি এগিয়ে যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে পিট পিট করে তাকালো সে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে জলে ভরে গেল

ছেলেকে তখন ক্লিন করে ওজন মাপার যন্ত্রের ওপর রাখা হয়েছে। আমি এগিয়ে যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে পিট পিট করে তাকালো সে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে জলে ভরে গেল, গলার স্বরে যেন খিল পড়ে গেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে হাতটা শুধু এগিয়ে দিতেই খপ করে আঙুল ধরে ফেলল আমার ছেলে। সঙ্গে সঙ্গে ৩১০০ গ্রামের শিশুর ওজন যেন বেড়ে গেল আরও কয়েক কেজি। শারীরিক ওজনের সঙ্গে সেখানে স্নেহ, মায়া আর ভালোবাসার ওজন পরিমাপ করার কোনো যন্ত্র থাকলে মন্দ হতো না।

ভাষাহীন সেই কথোপকথনে বাকি জীবনের সব বোঝাপড়া যেন হয়ে গেল আমাদের
ভাষাহীন সেই কথোপকথনে বাকি জীবনের সব বোঝাপড়া যেন হয়ে গেল আমাদের

সাদা কাঁথায় মুড়িয়ে ছেলেকে প্রথম আমার কোলে দিলেন ডাক্তার। ছোট্ট শিশুদের কোনোদিন ঠিকমতো কোলে নিতে না পারা এই আমি নিজের ছেলেকে কোলে নিয়েই যেন সর্বোচ্চ কমফোর্ট দিতে চেষ্টা করলাম। ছোট ছোট হাত–পা ছুড়ে শিশুটি শুধু আমার দিকেই চেয়ে আছে। আর আমি চেয়ে আছি তার দিকে। ভাষাহীন সেই কথোপকথনে বাকি জীবনের সব বোঝাপড়া যেন হয়ে গেল আমাদের।

বিজ্ঞাপন

ছোট্ট কয়েকটি জটিলতায় ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে থাকতে হলো বাড়তি কয়েক দিন। আর এই সময়ে যেন বুঝে গেলাম সন্তানের জন্য বাবার উদ্বেগ ঠিক কেমন হয়। রাত-বিরেতে দুধের জোগাড়যন্তর, ওষুধ-পথ্য খোঁজা, হঠাৎ জরুরি খরচাপাতি—সবকিছুই যেন উদ্বিগ্ন করে তোলে, বাবাদের কাঁধ আরও চওড়া করে দেয়। প্রতিদিন নিজেকে যেন আরও পরিণত করে দিচ্ছে আমার ছেলে।

প্রতিদিন নিজেকে যেন আরও পরিণত করে দিচ্ছে আমার ছেলে
প্রতিদিন নিজেকে যেন আরও পরিণত করে দিচ্ছে আমার ছেলে

একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর এক দিন রাতে হঠাৎ মায়ের দুধ টেনে খেতে পারছিল না ছেলেটি। রাত তখন ১২টার কিছু বেশি। খিদেয় তার সে কি কান্না। বাসার সবাই মিলে তাকে থামাতে ব্যর্থ। আমার স্ত্রী গুগলে নানা আর্টিকেল পড়ে আর ইউটিউবে ভিডিও দেখে আমাকে বলল, দোকান থেকে একটা ‘নিপল শিল্ড’ (শিশুকে বুকের দুধ টেনে খাওয়ানোর নকল আবরণ) কিনে আনতে। শ্যালকের বাইকের পেছনে বসে বের হলাম রাতের ঢাকায়।

এখন বুঝি সন্তানের জন্য বাবার উদ্বেগ ঠিক কেমন হয়
এখন বুঝি সন্তানের জন্য বাবার উদ্বেগ ঠিক কেমন হয়

কলাবাগান থেকে ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা, পল্টন, সেগুনবাগিচা, মালিবাগ, মগবাজার, বংশাল, রামপুরা, তেজগাঁও, ফার্মগেট, কলেজ গেট, শ্যামলী, আগারগাঁও এলাকার খোলা থাকা সব কটি ফার্মেসি ও জরুরি দোকান ঘুরে ব্যর্থ হয়ে যখন বাসায় ফিরছি ভোরের আলো নিয়ে ঢাকা তখন জেগে উঠেছে। ঘরে ফিরে দেখি ছেলে তখনও কাঁদছে, তবে গলায় আর আওয়াজ নেই। অসহায় হয়ে স্ত্রীর হাত ধরে বসে রইলাম। ছেলের সঙ্গে আমরাও কাঁদলাম অনেকক্ষণ। নিজেকে এক ব্যর্থ বাবা মনে হচ্ছিল সেই সময়।

কাল (২০ জুন) আমার ছেলের বয়স দুই মাস পূর্ণ হবে। এখন তার খাবার, ঘুম, সুবিধা-অসুবিধার অনেক কিছু আমরা বুঝতে পারি। দুটি নরম হাত, বিস্ময়ভরা চোখ, আর মখমলের মতো তুলতুলে গাল নিয়ে একটা শিশু বেড়ে উঠছে আমারই ছায়ায়, ভাবলে অবাক লাগে।

সন্তানের সঙ্গে প্রতিদিন  একটু একটু করে পরিণত হচ্ছি আমিও
সন্তানের সঙ্গে প্রতিদিন একটু একটু করে পরিণত হচ্ছি আমিও

তার সঙ্গে প্রতিদিন যেন একটু একটু করে পরিণত হচ্ছি আমি। অফিস টাইমের বাইরে এখন দ্রুত বাসায় ফিরতে মন চায়, এমনকি পুরোনো বন্ধুদের আড্ডাও আটকে রাখতে পারে না। ছেলে এখন হাসে, গাল ফুলিয়ে কাঁদে। দিনের বেলা ঘুমিয়ে সারা রাত জেগে থাকে। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়েও ঠায় বসে থাকি তার ঘুমানোর অপেক্ষায়। তারপরও মনে হয় মা হিসেবে আমার স্ত্রী যে ত্যাগ স্বীকার করছে, তার তুলনায় আমি কিছুই করছি না।

একটা শিশু বেড়ে উঠছে আমারই ছায়ায়, ভাবলে অবাক লাগে
একটা শিশু বেড়ে উঠছে আমারই ছায়ায়, ভাবলে অবাক লাগে

তবে এটাও সত্যি, তিন মেয়ের পাশে মা-বাবার একমাত্র ছেলে হিসেবে বেড়ে ওঠা এই আমি কী কখনো ভেবেছি, নিজের বাবা হওয়ার কথা। এখনো যে ছেলেকে তিনবেলা নিয়ম করে ফোনে খাওয়াদাওয়া আর সাবধানে চলাচলের কথা মনে করিয়ে দেন মা আর বোনেরা। তাদের যত্ন দেখেও তো মনে হয় না আমি বাবা হয়ে গেছি।

লেখক: সাংবাদিক
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২২, ০৬: ০৬
বিজ্ঞাপন