বছরের আর সব দিনের মতো সাধারণ এক বাজার, কিন্তু একটি বিশেষ দিনে এই বাজারই হয়ে ওঠে উৎসবের কেন্দ্র। বলছি যশোরের ঢাকুরিয়া অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ঘাটুরিয়া বাজারের জামাইমেলার কথা। প্রায় সাত দশকের বেশি সময় ধরে চলে আসা এই মেলা শুধু একটি কেনাবেচার স্থান নয়, এটি জামাইদের সম্মান রক্ষার এক অলিখিত প্রতিযোগিতার মঞ্চ। বিজয়া দশমী উপলক্ষে এই মেলা আয়োজিত হয়।
১৯৫০ সাল থেকে ঘাটুরিয়া বাজারে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। স্থানীয় লোকজনের হাত ধরে শুরু হওয়া এই আয়োজন সময়ের সঙ্গে হয়ে উঠেছে এলাকার প্রধান সামাজিক উৎসবগুলোর একটি। পৌষসংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এই মেলার মূল উদ্দেশ্যই হলো জামাইদের আপ্যায়ন। সেই আপ্যায়নের প্রধান অনুষঙ্গ হলো বড় মাছ। মেলাকে ঘিরে এলাকার প্রতিটি বাড়িতে জামাই ও আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রণ করা হয়।
মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো সারি সারি সাজিয়ে রাখা বিশাল আকারের মাছ। রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, পাঙ্গাশ, ব্রিগেডসহ নানা প্রজাতির মাছ শোভা পায় দোকানগুলোতে। তবে এখানে প্রতিযোগিতাটা ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে নয়, বরং জামাইদের নিজেদের মধ্যে।
কে কত বড় মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন, তা নিয়েই চলে এই মধুর প্রতিযোগিতা। ৫ কেজি থেকে শুরু করে ১০ থেকে ১৫ কেজি ওজনের মাছও দেখা যায় এই মেলায়। জামাইরা নিজেদের সামর্থ্যের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির সম্মানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে তুলনায় বড় মাছটি কিনতে চান। এই এক দিনের প্রতিযোগিতায় মিশে থাকে ভালোবাসা, দায়িত্ব আর ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান।
এমনই এক জামাই রতন সাহার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিবছরই এই মেলায় আসি। চেষ্টা করি বড় মাছটা কেনার। এটা মাছ কেনার মহোৎসব আমার মতো জামাইদের জন্য। কুয়াদা জামজামি গ্রামে আমার শ্বশুরবাড়ি। এখন বড় মাছটি কিনে সেখানেই যাব।’
এই এক দিনের মেলা শুধু সামাজিক উৎসবই নয়, এটি এলাকার অর্থনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখে। আয়োজকদের সভাপতি আবদুল হান্নান গাজী প্রথম আলোকে বলেন, মেলার এক দিনে প্রায় এক কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়ে থাকে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞকে ঘিরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা থেকেও মাছ ব্যবসায়ীরা তাঁদের সবচেয়ে বড় মাছের সংগ্রহ নিয়ে হাজির হন।
শুধু মাছই নয়, মেলাকে ঘিরে বসে নাগরদোলা, মিষ্টির দোকানসহ নানা ধরনের গ্রামীণ আয়োজন। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাক আর হাজারো দর্শনার্থীর ভিড়ে ঘাটুরিয়া বাজার হয়ে ওঠে এক মিলনমেলা। দূর-দূরান্তের বিভিন্ন জেলা থেকেও মানুষ আসে এই ঐতিহাসিক জামাইমেলার সাক্ষী হতে।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসা এই জামাইমেলা আজও তার আবেদন হারায়নি। এটি এখন আর শুধু একটি মেলা নয়, বরং যশোর অঞ্চলের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর পারিবারিক বন্ধনের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
ছবি: লেখক