যুগান্তকারী আবিষ্কার অর্গানিক বারিয়াল পড: মৃত্যুর পর সবুজ বৃক্ষে পরিণত হবে মানুষ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ভাবুন তো মৃত্যুর পরেও আপনি আবার ফিরে আসছেন এই পৃথিবীতে, তবে এবার মানুষ নয়, সবুজ বৃক্ষরূপে। এটা কল্পনা মনে হলেও, বিজ্ঞান এখন সেটাকেই বাস্তবে রূপ দিতে চলেছে। আর এটা পড়ে আপনার জীবনানন্দকে মনে পড়ছে না? সেই যে, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে—এই বাংলায়? হয়তো মানুষ নয়—হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে…’

বিজ্ঞানীরাও কি জীবনানন্দের কবিতা পড়েছে? সে না হলেও তাঁর পঙ্‌ক্তিগুলি মুহূর্তেই আমাদের নিয়ে যায় এক অন্যতর ভাবনার জগতে যেখানে মৃত্যুর পরও ফিরে আসা সম্ভব, প্রকৃতির ছোঁয়ায়।

পৃথিবীর আদি জনগোষ্ঠীর অনেক রীতিই প্রকৃতির সঙ্গে এতটাই নিবিড় যে আজকের বিজ্ঞানীরা যেন সেই সব প্রথাকেই আধুনিক রূপে ফিরিয়ে আনছেন।

বিজ্ঞাপন

ইন্দোনেশিয়ার সুলাওসি দ্বীপের টোরাজা (Toraja) জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক বিস্ময়কর অন্ত্যেষ্টি প্রথা প্রচলিত আছে। তাদের বিশ্বাস, মৃত্যু মানেই চিরবিদায় নয়, বরং এটি প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। এই জনগোষ্ঠীতে যখন কোনো শিশু দাঁত ওঠার আগেই মারা যায়, তখন তাকে কফিনে নয়, বরং জীবিত গাছের ভেতরে সমাধিস্থ করা হয়। শিশুটির দেহ কাপড়ে জড়িয়ে গাছের গুড়ির ফাঁকা অংশে রেখে দেওয়া হয়, তারপর সেই অংশ তালপাতার আঁশ বা তন্তু দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই গাছ শিশুটিকে নিজের শরীরে শোষণ করে নেয়। গাছের গায়ে ছোট্ট একটি দাগ থাকে, যা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। টোরাজা জনগোষ্ঠীর কাছে এটি একধরনের আত্মার পুনর্জন্মের প্রতীক, যেখানে মৃত শিশু প্রকৃতির অংশ হয়ে ফিরে আসে।

টোরাজা জনগোষ্ঠী এই গাছের মধ্যে শিশুর মৃতদেহ ভরে রাখে। এই গাছকে বলা হয় তারা গাছ।
টোরাজা জনগোষ্ঠী এই গাছের মধ্যে শিশুর মৃতদেহ ভরে রাখে। এই গাছকে বলা হয় তারা গাছ।

একইভাবে, ফিলিপাইনের কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে ‘ট্রি বুরিয়াল’ বা গাছের ভেতর সমাধিস্থ করার প্রথা। তারা বিশ্বাস করে, মানুষ প্রকৃতির সন্তান, তাই মৃত্যুর পর তার দেহকে মাটিতে নয়, বরং গাছের কাণ্ডে আশ্রয় দিলে আত্মা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে মুক্তি পায়। কোনো বিশেষ গাছ নির্বাচন করে তার কাণ্ডে ফাঁকা জায়গা তৈরি করা হয়, তারপর সেখানেই দেহ রাখা হয় ও ঢেকে দেওয়া হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাছ দেহটিকে নিজের অংশে পরিণত করে।

বিজ্ঞাপন

এই প্রাচীন প্রথা যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃতি কেবল জীবনের নয়, মৃত্যুরও আশ্রয়।

বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব এক নতুন ধারণা দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে যার নাম ‘অর্গানিক বারিয়াল পড’, আদতে যা এই আদিবাসীদের হাজার বছরের প্রথার পুনরাবৃত্তি।

বুরিয়াল পড
বুরিয়াল পড

পরিবেশবিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় কফিন বা সমাধিফলকের জায়গা নিচ্ছে একটি জীবাণুবিযোগ্য ক্যাপসুল, যার ভেতর রাখা হয় মৃতদেহকে। তারপর এর ওপরে রোপণ করা হয় একটি গাছের বীজ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরটি প্রকৃতির নিয়মে মিশে যায় মাটিতে, হয়ে ওঠে গাছের খাদ্য। গাছটি বেড়ে ওঠে ফুলে ও ফলে। খুব সরল অথচ বিস্ময়কর প্রক্রিয়ায় মৃত্যুর পরও জন্ম দেয় জীবন। এই প্রক্রিয়া মৃত্যুকে কোনো সমাপ্তি নয়, বরং নবজন্মের সূচনা হিসেবে দেখে। একটি জীবনের শেষে আরেকটি জীবনের শুরু।

অর্গানিক বারিয়াল পডের অন্যতম লক্ষ্য হলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা। প্রচলিত কবর বা দাহপ্রথায় যেমন কাঠ, ধাতু, রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হয়, তাতে প্রকৃতির ক্ষতি হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে কোনো বর্জ্য তৈরি হয় না, বরং মৃতদেহ নিজেই প্রকৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করে। ইতালির ডিজাইন স্টুডিও ক্যাপসুলা মুন্ডি প্রথম এই ধারণাকে বাস্তবে নিয়ে আসে। তারা বলে, ‘আমরা চাই মৃত্যু যেন প্রকৃতির অংশ হয়, আলাদা নয়।’

ইতালির ডিজাইন স্টুডিও ক্যাপসুলা মুন্ডি প্রথম এই ধারণাকে বাস্তবে নিয়ে আসে
ইতালির ডিজাইন স্টুডিও ক্যাপসুলা মুন্ডি প্রথম এই ধারণাকে বাস্তবে নিয়ে আসে

প্রতিটি বৃক্ষই যেন হয়ে ওঠে এক জীবন্ত স্মৃতিস্তম্ভ, একজন প্রিয় মানুষকে মনে রাখার নতুন উপায়। পাথরের নিচে নিস্তব্ধ হয়ে থাকা নয়, বরং পাতা, ফুল আর বাতাসে মিশে থাকা চিরন্তন উপস্থিতি।

এভাবেই বেড়ে উঠবে গাছ
এভাবেই বেড়ে উঠবে গাছ

একটি অর্গানিক বারিয়াল পড বস্তুত বলে দেয়, প্রকৃতির সন্তান মানুষ ফিরে আসবে প্রকৃতির অংশ হয়ে।
ছবি: এআই, উইকিমিডিয়া কমন্স ও ক্যাপসুলা মুন্ডিয়াল

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১: ০০
বিজ্ঞাপন