তুমুল আলোচনায় এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'ম্যাডম্যান থিওরি'-র বাস্তব প্রয়োগ। বিবিসির সাম্প্রতিক সাড়া জাগানো প্রতিবেদনে ব্যখ্যা করা হয়েছে কীভাবে ট্রাম্প এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করে পুরো দুনিয়ার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছেন সফলভাবে। পাগলাটে আচরণ ও কথাবার্তা একেবারে সহজাত বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এখন। মানুষ অনেকটা মেনেই নিয়েছে তিনি এমনই। অন্য কেউ এই কথাগুলো বললে বা এমন আচরণ করলে যেখানে তোলপাড় হয়ে যেত,সেখানে ট্রাম্পের সঙ্গে ডিল করতে গিয়ে বিশ্বনেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও কিছুটা স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে ব্যপারগুলো। আর এর মধ্যেই এই আলোচিত ও সমালোচিত 'ম্যাডম্যান থিওরি' বা 'উন্মাদ তত্ব' কাজে লাগিয়ে বড় বড় সাফল্য পাচ্ছেন ট্রাম্প।
আসলে এটি কিন্তু ট্রাম্পের উদ্ভাবন নয়। আরেক ঝানু মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কৌশল ছিল এটি। বিতর্কিত আর সমালোচিত নিক্সন ছিলেন যুদ্ধবাজ ও কন্ট্রোল ফ্রিক। মূলত শত্রুপক্ষের সঙ্গে এই তত্ব অনুযায়ী চলতেন তিনি। ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও আসলে এই কথাগুলো মিথ্যা নয়। তবে বলা হচ্ছে, ট্রাম্প মিত্রপক্ষের সঙ্গেও এই একই স্ট্র্যাটেজিতে চলেন। আসলে ব্যাপার হলো, আমাদের জীবনেও মাঝে মাঝে এমন কিছু সময় আসে, যখন ভালোমানুষির কোনো দাম পাওয়া যায় না। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে অনেক সময় আঙুল বাঁকাতেই হয়। আর তখনই আমাদের জীবনে কাজে আসতে পারে এই ম্যাডম্যান থিওরি। শুনে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ম্যাডম্যান মানে কিন্তু পাগল হয়ে যাওয়া নয়, বরং কিছটা ইচ্ছা করেই পাগলাটে আচরণ করা। এতে আপনার বিপরীত দিকের মানুষ বা প্রতিপক্ষ আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে কোনো ধারণাই পায় না। এদিকে এই তত্ব ব্যবহার করে আপনি নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নিজ হাতে নিয়ে আসতে পারবেন।
'ম্যাডম্যান থিওরি' বা 'উন্মাদ তত্ত্ব'কে ব্যক্তিগত জীবনের এমন একটি কৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যেখানে আপনি জেনেশুনেই নিজেকে কিছুটা খেয়ালি বা পাগলাটে ইমেজে উপস্থাপন করেন, যাতে আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বা লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন। এর উদ্দেশ্য হলো অন্যদের মনে এই ধারণা তৈরি করা যে আপনি চাইলেই হঠাৎ করে অস্বাভাবিক বা কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, ফলে তারা আপনাকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহস পায় না বা আপনার কথা মেনে নিতে বাধ্য হয়। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আসলে এমন হতেই হবে। চলুন দেখে নিই ম্যাডম্যান থিওরি কীভাবে ব্যক্তিগত জীবনের নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়।
১. আলোচনা ও দ্বন্দ্ব সমাধানে সীমারেখা স্থাপন করা
সব কিছুরই একটা সীমা থাকা উচিত। বাউন্ডারি লাইনটা আপনাকেই টানতে হবে। যদি আপনি সব সময় অন্যদের কাছে মাথা নিচু করেন, তারা বারবার সেটা কাজে লাগাতে পারে। এ অবস্থায় আপনি একটু 'ম্যাডম্যান' ভাব দেখিয়ে, যেমন, কখনো দৃঢ়ভাবে নিজের অবস্থান জানান, আবার কখনো সম্পূর্ণ চুপ থেকে থেকে সরে আসেন, তাহলে অন্যরা আপনাকে হালকাভাবে নিতে ভয় পাবে।
২. নিজের সুবিধা অনুযায়ী ডিল বা চুক্তি করা
যদি আপনি দাপ্তরিক ক্ষেত্রে, টাকাপয়সার লেনদেন বা জমিজমা ইত্যাদির ভাগবাটৈয়ারার সময় দরকষাকষিতে এমন ভাব দেখান যে আপনি নিজের অংশটা কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিতে আগ্রহী নন তাহলে আপনি সম্ভবত বঞ্চিতই হবেন বারবার। আপনাকে কেউ সিরিয়াসলি নেবে না।
সবাই যদি বোঝে যে শর্ত পছন্দ না হলে আপনি আলোচনা ছেড়ে চলে যেতে পারেন, তাহলে এটি আপনাকে একটি আপনি শক্ত অবস্থান দেবে। এটি অন্য পক্ষকে আপনাকে ঠকানোর আগ্রহ কমিয়ে দিতে পারে। কারণ তারা বুঝবে যে আপনি ছেড়ে কথা বলবেন না। আর যেকোনো সময় যেকোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেন আপনি পূর্বাভাস ছাড়াই।
৩. সামাজিক যোগাযোগে বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে সীমা নির্ধারণ করা
এটা খুব জরুরি। নয়তো এত বেশি নাক গলায় সবাই মাঝেমাঝে যে তা জীবন দূর্বিষহ করে তোলে। আবার যদি আপনি সবসময় অন্যদের অন্যায় আবদার মেনে নেন,অনুরোধে ঢেঁকি গেলেন আর বেগার খেটে চলেন তাহলে সেটা সবার অভ্যাসে পরিণত হতে পারে। এর পরিবর্তে আপনি মাঝে মাঝে না বলা শুরু করুন। এমনকি যদি কেউ অসন্তুষ্ট হয় তবুও। এতে অন্যরা বুঝবে, আপনি সবসময় সব কথায় সহজে রাজি হয়ে যাবেন না।
৪. টক্সিক বা নিয়ন্ত্রণপ্রিয় মানুষদেরকে সামাল দেওয়া
যদি কেউ আপনাকে বারবার প্রভাবিত করতে চায়,আপনাকে ডমিনেট করে আপনার ওপরে জোর বা কর্তৃত্ব খাটাতে চায় তাহলে খুবই সমস্যায় পড়বেন আপনি। এক্ষেত্রে আপনাকে 'ম্যাডম্যান' হয়ে উঠতে হবে। নিজের কথা, কাজ ও আচরণ অল্প একটু অপ্রত্যাশিত করে তুললে তারা পরের বার বেশি মাতব্বরি করার আগে কয়েকবার ভাববে।
৫. ব্যক্তিগত লক্ষ্য অর্জনে
কখনো কখনো নিজের লক্ষ্য পূরণে কিছুটা ঝুঁকি নিতে হয়। আপনি নিজের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ নির্ধারণ করতে পারেন এবং এমন কিছু করতে পারেন যা আপনার স্বাভাবিক রুটিনের বাইরে। আর সেজন্য আপনাকে ম্যাডম্যান থিওরির মূলমন্ত্র অনুযায়ী ভ্রুক্ষেপহীন হতে হবে। লোকলজ্জা বিসর্জন দেওয়ার জন্য এ এক ভালো স্ট্র্যাটেজি। এতে আপনি নিজের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা ও প্রবল আত্মবিশ্বাস পাবেন।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
ম্যাডম্যান হতে গিয়ে সত্যিই উন্মাদ হয়ে গেলে চলবে না। অনেকটা সেয়ানা পাগল হতে হবে এক্ষেত্রে। এই কৌশলটি কেবল ভাবমূর্তি তৈরি করার জন্য, সত্যিকারের পাগল হওয়ার জন্য নয়। উদ্দেশ্য হলো অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি প্রভাব ফেলা। বলা যায়, এ এক ডিফেন্স সিস্টেম। এই স্ট্র্যাটেজি যদি আপনি এটি মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করেন, তাহলে সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে বা অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। তাই সচেতনভাবে এবং পরিমিতভাবে ব্যবহার করা জরুরি।
ম্যাডম্যান হতে গিয়ে আপনার আসল ব্যক্তিত্ব যেন হারিয়ে না যায়। আপনি যদি নিজের স্বাভাবিক চরিত্রের বাইরে গিয়ে অন্য মানুষ বনে যেতে চান, তাহলে সেটা বুমেরাং হতে পারে। বরং আপনি নিজের স্বাভাবিক শক্তি ও বৈশিষ্ট্য ধরে রেখে কৌশলে কিছুটা শক্ত, পাগলাটে, অনমনীয় ও অপ্রত্যাশিত আচরণ যোগ করুন প্রয়োজন অনুযায়ী। ব্যক্তিগত জীবনে ট্রাম্পের আলোচিত ম্যাডম্যান থিওরি ব্যবহার করা মানে হলো শক্তি ও প্রভাবের খেলা বোঝা এবং নিজের অপ্রত্যাশিত ও খেয়ালি আচরণের প্রবণতা ব্যবহার করে নিজের অবস্থান মজবুত করা। এতে আপনি নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারবেন, যা নরম হয়ে সবসময় আপনি পারবেন না। তবে এসব মাইন্ড গেম খেলার ক্ষেত্রে সবসময় সাবধানতা ও ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, উইকিপিডিয়া
ছবি: পেকজেলস ও ইন্সটাগ্রাম