আপনি কি কখনো জোনাকি দেখেছেন? বিলুপ্তির পথে এই মায়াময় আলোকপতঙ্গ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আপনি কি কখনো নিজের চোখে জোনাকি দেখেছেন? দুয়েক দশক আগে যাঁদের ছেলেবেলা কেটেছে ঝলমলে আলো জ্বলতে থাকা শহর থেকে অনেক দূরে, তাঁদেরই মূলত সখ্যতা গড়ে উঠেছে আঁধারে মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা জোনাকিদের সঙ্গে। আজকাল সেই সময়গুলো যেন ঠিক রূপকথার গল্পের মতো। কয়েক দশক আগে গ্রাম কিংবা মফস্বলগুলোতে বিদ্যুৎ সেভাবে পৌঁছাতে পারে নি আর পৌঁছালেও ছিল ভয়াবহ লোডশেডিং। সন্ধ্যার পরপর বিদ্যুতের কোনো অস্তিত্ব থাকত না বললেই চলে। এমন সময় তীব্র গরমে ঘরে বসে থাকা ছিল বেশ মুশকিলের কাজ। তাই বাধ্য হয়েই হোক কিংবা অভ্যাসের বশেই হোক সবাই বেরিয়ে আসত ঘরের বাইরে।

গবেষণা বলছে পৃথিবী থেকেই ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় জোনাকিরা
গবেষণা বলছে পৃথিবী থেকেই ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় জোনাকিরা

সে সময়ে প্রতিটি বাড়ির বাইরেই থাকত মাঠ কিংবা পুকুরপাড়। সে এক যেন ভিন্ন সময়। চারপাশে প্রাকৃতিক হাওয়া, ঘুটঘুটে অন্ধকারে জ্বলতে থাকা জোনাকির আলো, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক সব মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ। কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। গবেষণা বলছে পৃথিবী থেকেই ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় জোনাকিরা। পৃথিবী থাকবে কিন্তু জোনাকিরা থাকবে না ভাবতেই যেন মনটা খারাপ লাগে।

বিজ্ঞাপন

পরিবেশ ও কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা এখন উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। তাঁরা বলছেন আমরাই হয়তো শেষ প্রজন্ম, যাঁরা জোনাকির আলো দেখে বড় হয়েছি।
বেলজিয়ামের গবেষক রাফায়েল দ্য কক তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, গত কয়েক দশকে পৃথিবীর বহু অঞ্চলে জোনাকির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এ প্রকাশিত তাঁর এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমরা আগের তুলনায় এখন আর জোনাকি পোকা দেখি না কারণ জোনাকির বিভিন্ন প্রজাতি সত্যিই বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে চালানো জরিপ ও ক্ষেত্রভিত্তিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু অঞ্চলে আগের তুলনায় জোনাকির সংখ্যা কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত।

হারিয়ে যাচ্ছে জোনাকিরা
হারিয়ে যাচ্ছে জোনাকিরা

এর কারণ কী? সত্যিই কী আমাদের পৃথিবীতে থেকে হারিয়ে যাবে জোনাকিরা? জোনাকি পোকার সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। যেগুলো তাদের অস্তিত্বের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। যেমন–

১। জলাভূমি ও বনভূমি হ্রাস

জোনাকি পোকা সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। তারা সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আর্দ্র পরিবেশে যেমন জলাভূমি, পুকুরপাড়, ভেজা বনভূমি, ঝোপঝাড়, পাতার নিচের স্যাঁতসেঁতে মাটি ইত্যাদি জায়গায়। কিন্তু নগরায়ন, কৃষিতে সম্প্রসারণ এবং অব্যবস্থাপনার কারণে দিন দিন এসব প্রাকৃতিক জায়গা কমে যাচ্ছে। যার ফলে জোনাকিরা তাদের প্রয়োজনীয় বাসস্থান হারিয়ে ফেলছে।

২। আলো দূষণ

জোনাকির আলো নিছক সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং এটি তাদের যোগাযোগের একটি মাধ্যম। বিশেষ করে সঙ্গী খোঁজার সময় তারা এই আলোর মাধ্যমে সংকেত প্রদান করে। কিন্তু বর্তমানে চারপাশে স্ট্রিট লাইট, দোকান-পাট-ঘর-বাড়ির সার্বক্ষণিক আলো, মোবাইল টাওয়ার কিংবা বিলবোর্ডের কৃত্রিম আলো জোনাকির প্রাকৃতিক আলোকে ঢেকে দেয়। এতে তারা সঠিকভাবে সঙ্গীর সংকেত ধরতে পারে না। ফলে প্রজননের হার কমে যায়।

বিজ্ঞাপন

৩। কীটনাশকের ব্যবহার

আধুনিক কৃষিতে ব্যবহৃত নানা ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক শুধু ক্ষতিকর পোকা নয়, উপকারী পোকামাকড়ও ধ্বংস করে। জোনাকি শূককীট বা লার্ভা অবস্থায় মাটিতে বসবাস করে। আর জোনাকিরা শূককীট অবস্থায়  শামুক ও বিভিন্ন ছোট ছোট প্রাণী খায়। কিন্তু কীটনাশকের কারণে এসব প্রাণী মারা যায়, ফলে খাদ্য সংকট তৈরি হয়। সেই সঙ্গে মাটি ও পানিও দূষিত হয়, যা তাদের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর।

৪। জলবায়ু পরিবর্তন

বৈশ্বিক উষ্ণতা ও মৌসুমি ভারসাম্যের পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে জোনাকির জীবনচক্রেও। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তাদের প্রজনন ও আলো জ্বালানোর সময়সূচি বিঘ্নিত হয়। আবার অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি বা খরার কারণে প্রজননের জন্য উপযোগী পরিবেশ আর তৈরি হয় না। এতে তাদের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

আমরাই যেন শেষ প্রজন্ম না হই, যারা জোনাকি দেখেছি
আমরাই যেন শেষ প্রজন্ম না হই, যারা জোনাকি দেখেছি
বিশ্বব্যাপী জোনাকির সংখ্যা রক্ষা ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে
বিশ্বব্যাপী জোনাকির সংখ্যা রক্ষা ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে

এসব বাড়তে থাকলে সত্যিই পৃথিবী থেকে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে জোনাকিরা। তাদের সংরক্ষণে তাই প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। বিশ্বব্যাপী জোনাকির সংখ্যা রক্ষা ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এই উদ্যোগগুলোর মধ্যে হলো আবাসস্থল পুনরুদ্ধার যেমন জোনাকিদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সরবরাহ করার জন্য জলাভূমি এবং বনভূমি পুনর্বাসন। আলোক দূষণ কমানো অর্থাৎ কৃত্রিম আলো হ্রাস করার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন। টেকসই কৃষি চর্চা যেমন পরিবেশ বান্ধব কীটনাশক ও চাষাবাদের কৌশল ব্যবহার প্রচার করা। সেই সঙ্গে প্রয়োজন জোনাকির গুরুত্ব এবং কীভাবে তাদের রক্ষা করা যায় সে সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা। আমরাই যেন শেষ প্রজন্ম না হই, যারা জোনাকি দেখেছি।

তথ্য: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

ছবি: ইন্সটাগ্রাম

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ০৫: ০৪
বিজ্ঞাপন