বাংলা সংস্কৃতির সূতিকাগার রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্য, অভিনয়, নৃত্য, চিত্রকর্ম—সর্বক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত স্বমহিমায়। আমাদের যাপনের অংশ হয়ে গেছেন।
আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে ইংরেজি সাময়িকপত্র ‘এমডব্লিউ বাংলাদেশ’ ও স্কয়ার টয়লেট্রিজের ন্যাচারাল ওয়েলনেস ব্র্যান্ড ‘মায়া’র যৌথ উদ্যোগে ২৫ এপ্রিল আলোকি কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়েছে বেঙ্গল ইন মোশনের দ্বিতীয় আসর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী নাচের মেলবন্ধনের সৌন্দর্য উপস্থাপিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের শিল্পের নান্দনিকচর্চার উদাহরণ বলা যেতে পারে বেঙ্গল ইন মোশন: টাইমলেস টেগোর। বৈশাখের এক পড়ন্ত বিকেলে উৎসবস্থলে পৌঁছে মন ভালো হয়ে যায় বেলি ফুলের সুবাসে। প্রবেশমুখেই আমন্ত্রিত অতিথিদের বেলি ফুলের মালা হাতে পরিয়ে স্বাগত জানানো হয়। প্রবেশের পরেই আলোকির চিরচেনা আবহের রূপান্তরে অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করে। পুরোটা দেখে মনে হচ্ছিল, একটুকরা জোড়াসাঁকো। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি, ঘটনাকালসহ ঝুলছে দেয়ালে। জহরলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী, আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো মহারথীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছবি। ব্রিটিশ শাসনকালে প্রথম লন্ডন সফরে গেলে তাঁকে রাজকীয়ভাবে স্বাগত জানানো হয়, দারুণ সেই মুহূর্তও দেখা গেল।
স্মৃতিময় ঘটনার দারুণ উপস্থাপনা মুগ্ধ করে। পুরোনো কার্পেটের ওপর পাতা ছিল বেত আর কাঠের আরামকেদারা, যেখানে বসে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যচর্চা করতেন। এক কোণে গ্রামোফোন আর দেয়ালে ভিনটেজ ঘড়ি, নেপথ্যে বাজছে রবীন্দ্রসংগীত।
ঝাড়বাতি আর লন্ঠন নিয়ে যাচ্ছিল সেই চল্লিশ দশকে। নতুন সময়ে পুরোনোকে উদ্যাপনের এক অনন্য প্রয়াস। আরেকটি টেবিলে ছিল একটি চিত্রকর্ম– পুত্রবধূ ও তাঁর মেয়ে মাধুরীলতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ; পাশেই কাঁসার ফুলদানি সাজানো হয়েছে জিপসি ফুল দিয়ে।
আলোকির দ্বিতীয়তলার সিঁড়ির কাছেই শোলার কদমফুল দিয়ে দারুণভাবে সাজানো ছিল। ন্যাচারাল ওয়েলনেস ব্র্যান্ড মায়ার একটি সুন্দর বুথ ঘুরে দেখছিলেন অতিথিরা, ফটোবুথসহ দৃষ্টিনন্দন সজ্জা ভালো লাগছিল দেখতে। শিল্প সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনের রবীন্দ্র ভক্তদের উপস্থিতিতে মুখর ছিল অনুষ্ঠানস্থল। অনুষ্ঠানে পরিবেশন হয় চারটি শাস্ত্রীয় নৃত্যরূপ— ভরতনাট্যম, কত্থক, মণিপুরি ও ওডিশি।
সূচনা পরিবেশনায় ছিল আগুনের পরশমণি গানের নৃত্যরূপ। আনিসুল ইসলাম হিরু ও মাহবুবা মাহনুর চাঁদনীর সঙ্গে সাদা নাচের পোশাকে আসেন শিল্পীরা। আলো–আঁধারিতে এই নাচ অন্য আবহ তৈরি করে। কনটেম্পোরারি ঘরানার নাচ অনুষ্ঠানে যোগ করে অন্যতর মাত্রা। রবীন্দ্রনাথ আর নৃত্য একে অপরের পরিপূরক।
বাঙালির সৃষ্টিশীলতার প্রায় সব শাখাতেই প্রবলভাবে উপস্থিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই সূত্রে শিল্পের রূপময় শাখা নাচের ভুবনেও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল বিশ্বকবি। সমকালীন সমাজে নৃত্যের যে কদর লক্ষ করা যায়, তা–ও সম্ভব হয়েছে তাঁরই কল্যাণে। রবীন্দ্র-নৃত্যের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও প্রতিষ্ঠা নিয়ে শান্তিনিকেতনেই কাজ শুরু করেন।
রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে সমকালীন নৃত্যধারার বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন; নানা শাস্ত্রীয় নৃত্য, যেমন মণিপুরি, ভরতনাট্যম, কত্থক, ওডিশি, মোহিনীআট্টম, কথাকলি প্রভৃতির শৈলী নিজের বাণী, সুর ও সংগীতের মাধ্যমে ধারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
উদ্বোধনী নৃত্যের পরেই মঞ্চে আসেন বরেণ্য নৃত্যশিল্পী, মডেল ও অভিশিল্পী সাদিয়া ইসলাম মৌ ও তাঁর দল। তাঁরা পরিবেশন করেন রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য শ্যামা। নীল পোশাকে ভারী গহনায় মৌকে স্বর্গের দেবীর মতোই লেগেছে। একেবারে রবীন্দ্রনাথের রাজসভার নর্তকী শ্যামা। মেঘে ঢাকা চাঁদের ম্রিয়মাণ আলোয় গাঢ় বেগুনি পোশাকে শ্যামার বিরহী রূপ ফুটে ওঠে।
আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে গানে ওড়িশি নৃত্য পরিবেশন করেন বেনজীর সালাম ও তাঁর দল। ওডিশি নৃত্যে ত্রিভঙ্গি এবং চৌকা ওডিশিকে অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী থেকে পৃথক করে। রঙিন পোশাকে ওডিশি নৃত্য দৃষ্টিনন্দন ছিল।
এর পরেই শান্তিনিকেতনে কবিগুরু রচিত ‘দারুণ অগ্নিবাণে রে’ গানে সূর্য রঙের পোশাকে ভরতনাট্যম পরিবেশন করেন সাবরিনা শফি নিশা ও তাঁর দল।
‘এসো শ্যামল সুন্দর’ গানে কত্থক নৃত্য পরিবেশন করেন আনিকা কবির শখ ও তাঁর দল। কত্থক নৃত্যের প্রধান পোশাক গোড়ালি অব্দি লম্বা পেশোয়াজ (সিল্কের জামা ও চুড়িদার পাজামা, হালকা ধুসর পোশাকে মঞ্চে ঝড় তুলেছিলেন আনিকা কবির শখ। সঙ্গে উজ্জ্বল প্রসাধন ও অলংকারে দারুণ লাগছিল তাঁকে।
‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানে মণিপুরি নৃত্য পরিবেশন করেন তামান্না রহমান ও তাঁর দল। বলা বাহুল্য মণিপুরি নাচের পোশাক সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন। শেষ এই নাচের মাধ্যমে আয়োজনের সমাপ্তি হয়।
অনুষ্ঠানে মূল্যবান বক্তব্য দেন স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অঞ্জন চৌধুরী। তিনি বলেন, বেঙ্গল ইন মোশনের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশি শিল্পীদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে তারা নিজেদের মেধা ও দক্ষতার পরিচয় তুলে ধরার পাশাপাশি স্বীকৃতি অর্জনের পথে এগিয়ে যাবেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দর্শক এবং পৃষ্ঠপোষকদের সামনে শিল্পীদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও এই আয়োজনের অন্যতম লক্ষ্য।
‘এমডব্লিউ’ ম্যাগাজিন বাংলাদেশের সম্পাদক ও প্রকাশক রুমানা চৌধুরী বলেন, গত বছর বেঙ্গল ইন মোশন-আয়োজনের পর সুধী মহলে ব্যাপক সাড়া পাই। সেই ধারাবাহিকতায় এই আয়োজন। এবছরের দ্বিতীয় আয়োজনের থিম ছিল ‘টাইমলেস টেগোর’। নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাট্যকর্ম থেকে অনুপ্রাণিত নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হবে মঞ্চে। আমাদের লক্ষ্য রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মকে দর্শকদের সামনে জীবন্ত করে তোলা এবং নৃত্যের ভাষায় তাঁর অমর সৃষ্টিকে প্রকাশ করা।
আজরা মাহমুদ ও মীর রাব্বিরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত।
আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে ২৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টায় মাছরাঙা টেলিভিশনে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হবে।
ছবি: সান কমিউনিকেশন ও হাল ফ্যাশন